ওআরএস-এর জন্মদাতা! ডায়েরিয়া নিরাময়ে ইতিহাস গড়েছিলেন দিলীপ মহলানবিশ
Dilip Mahalanbis: ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন দিলীপ মহলানবিশ। যাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ চিকিৎসা-মহল।
ব্রিটিশ সাহায্যে তখন উদ্বুদ্ধ পাকিস্থানি বাহিনী। রাজাকারদের অত্যাচারে অতিষ্ট পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষ। বিশেষত, সে দেশের সংখ্যালঘুদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচার। ১৯৭১ সালের আগে থেকেই ঘর ছাড়ছেন একাধিক। জীবন বাঁচাতে চলে আসছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকে। আর এখানেই তৈরি হচ্ছে একের পর এক উদ্বাস্তু শিবির। থাকার সংকীর্ণ জায়গায় তখন গিজগিজ করছে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। বর্তমানের রোহিঙ্গা-ভিড়ের তুলনায় সেই অবস্থাও কোনও অংশেই কম ভয়াবহ ছিল না। ঠিক এই সময়েই শুরু হলো আর এক বিপদ। বনগাঁর উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মড়ক লাগল ফের। একের পর এক আক্রান্ত হলেন ডায়েরিয়ায়। কলেরার জীবাণু-অস্ত্র শেষ করতে থাকল ঘর-হারানো বহু মানুষকে। কীভাবে বাঁচবেন ওঁরা? কী করণীয় ওঁদের জন্য? ঠিক এই পরিস্থিতিতেই মানুষ বাঁচানোর কারিগর হিসেবে উঠে এসেছিলেন দিলীপ মহলানবিশ। হয়ে উঠেছিলেন উদ্বাস্তু শিবিরের ঈশ্বর।
১৫ অক্টোবর, ২০২২। শনিবার রাতে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন সেই ঈশ্বর। ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন দিলীপ মহলানবিশ। যাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ চিকিৎসা-মহল। রবিবার শোকবার্তা আসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে।
শ্রীরামপুরের দিলীপ থেকে চিকিৎসক দিলীপ
১৯৩৪ সালের ১২ নভেম্বর জন্ম নেন দিলীপ মহলানবিশ। অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জ ছিল তাঁর জন্মস্থান। ছোটবেলায় চলে এলেন অবিভক্ত ২৪ পরগনার বরাহনগরে। তারপর হুগলির শ্রীরামপুরে বাস। ছোট থেকে মেধাবী ছিলেন দিলীপ, বরাবর চাইতেন চিকিৎসক হতে। স্কুলপর্ব ছাড়িয়ে ১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। তারপর ওই একই হাসপাতালে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিলেন কাজে।এরপর লন্ডনে চালু হলো জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা। যে পরিষেবায় যুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বহু চিকিৎসকের। মেধাবী দিলীপ আবেদন করলেন ওই পদে। সুযোগ পেলেন তিনি। এরপর লন্ডন থেকেই ডিসিএইচ ডিগ্রি সম্পূর্ণ করলেন দিলীপ। এরপরও বিদেশ। অল্প বয়সেই এডিনবরা থেকে এমআরসিপি সম্পন্ন করে কুইন এলিজাবেথ শিশু হাপাতালের রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ শুরু করলেন। প্রথম এই পদে বসলেন কোনও বাঙালি ডাক্তার। শুধু তাই নয়, তখন দিলীপের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই রেকর্ডের পরে আমেরিকায় জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা-সংক্রান্ত একটি বিভাগে ফেলো পদে যোগ দিলেন তিনি।
কলকাতায় ফেরা
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রেই ১৯৬৪ সাল নাগাদ তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়। এবার অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে। সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে। যে কেন্দ্রে মূলত কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হত। চিকিৎসার সঙ্গেই এই কেন্দ্রেই শুরু করলেন ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওআরএস ও স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে কাজ, গবেষণা। সাফল্য পাচ্ছিলেন ঠিকই কিন্তু গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়নি তখন।
নুন, চিনির জল- ওআরএসের সফল প্রয়োগ
মড়ক লেগেছে উদ্বাস্তু শিবিরে। একের পর এক আক্রান্ত কলেরায়। ৩৭ বছরের দিলীপ ডাক্তার ছুটলেন বনগাঁ। সঙ্গে কয়েকজন। তাঁদের প্রায় কেউ-ই চিকিৎসক নন। শুরু হল লড়াই। ছড়িয়ে থাকা রোগী, যত্রতত্র মল, দুর্গন্ধে তখন নরক হয়েছে শিবির। কী করবেন! সবাইকে তো আর স্যালাইনের মাধ্যমে সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না! কোনও উপায় না দেখে নিলেন সাহসী সিদ্ধান্ত। শুরু করলেন নুন, চিনির জলের প্রয়োগ।
নুন, চিনি আর বেকিং সোডার মিলিত মিশ্রণ বানিয়ে একের পর রোগীকে খাওয়াতে শুরু করলেন। কাজ হল ভালোই। একের পর এক রোগী চোখ খুললেন। ডায়ারিয়ার মূল সমস্যা রিহাইড্রেশন কমতে থাকল ধীরে ধীরে।
কীভাবে করলেন এই কাজ
এক লিটার জলে ২২ গ্রাম গ্লুকোজ় বা চিনি, সোডিয়াম ক্লোরাইড বা নুন ৩.৫ গ্রাম। আর তার সঙ্গে প্রায় ২.৫ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বনেট অর্থাৎ বেকিং সোডা দিয়ে তৈরি করলেন মিশ্রণ। কিন্তু তীব্র চাহিদায় কম পড়ল ওআরএস। ডাক্তার দিলীপ নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন কলকাতার বড়বাজারে। কিনে নিয়ে গেলেন নুন, চিনি, সোডা। ফের গেলেন বনগাঁ। ১৬ লিটারের ড্রামে করে তৈরি করা হল ওই মিশ্রণ। প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলল লড়াই। আইভি অর্থাৎ ইন্ট্রাভেনাসের বিকল্প হিসেবে বিশ্বের কোণায় কোণায় স্বীকৃতি পেল ওআরএস।
সফল ডাক্তার দিলীপ
উদ্বাস্তু শিবির, লড়াইয়ে সঙ্গেই গবেষণায় অসাধ্যসাধন করলেন তিনি। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা জার্নালে ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পেল তাঁর গবেষণাপত্র। ল্যানসেট স্বীকৃতি দিল সদ্য। ১৯৮৪-'৮৫ সাল নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়ারিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডে চিকিৎসক নিযুক্ত হলেন তিনি। ডাক পড়ল ইউনিসেফ থেকেও। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ডায়েরিয়া রোগ গবেষণা-কেন্দ্রের প্রধান নিযুক্ত হলে দিলীপ মহলানবিশ। এর মধ্যেই ১৯৯১ সাল নাগাদ সল্টলেকে নিজের বাড়িতে তৈরি করলেন 'সোসাইটি অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ'। তিনি যুক্ত ছিলেন পার্ক সার্কাস অঞ্চলের একটি শিশু হাসপাতালে। ১৯৯৪ সালে রয়্যাল সুইডিশ বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সদস্য হন তিনি। ২০০২ সালে পান 'পুলিন' পুরস্কার। ২০০৬ সালে পান থাইল্যান্ডের 'রাজা মহিদুল পুরস্কার'।
দিলীপ ডাক্তার ফের খবরের শিরোনামে আসেন কয়েক বছর আগেও। পার্ক সার্কাস অঞ্চলের শিশু হাসপাতালে দান করেন ১কোটি টাকা। তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী মহলনাবীশের অবদানও তাঁর জীবনে ছিল গুরুত্বের, এমন বলতেন তিনি।