"আমি ভারতের প্রথম চাঁড়াল কবি!" জন্মদিনে আড়ালেই কবিতার মগ্ন সাধক বিনয় মজুমদার

Binay Majumdar: বিনয় মজুমদার ঠিক ‘পাগল’ ছিলেন না, ছিলেন কাব্যোন্মাদ, আত্মভোলা এক শিশু এবং কবিতার সাধক, যাঁকে বুঝতে, আত্মস্থ এখনও বহু বছরের সাধনার প্রয়োজন পাঠকের।

একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে

দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে

পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে

বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হল ফল।

আসলে যিনি চলে যান, তিনি কি একেবারেই ছেড়ে যান? কবি তো যান না ছেড়ে পাঠককে! তাঁর হৃদয়ের গভীর প্রভাব ছায়া ফেলে পাঠকের মননে আজও! তাঁর ব্যক্তিজীবন আর কবি জীবন অবলীলায় মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। কখনও তিনি পালন করেছেন মৌনব্রত আবার কখনও হাসির ফাঁকে বলছেন জীবন সত্যের গভীর মনস্তত্ত্বকে। আবার পালন করেছেন বছরের পর বছর একটি শব্দও না লেখার কঠিন জেদকে। থেকেছেন আড়ালে, অথচ তিনি নিজেই বেরিয়ে পড়েন জোনাকি, প্রজাপতি, হাঁস, পাখি আর অদ্ভুত মানুষ দেখতে। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী, সদা কম্পমান হাতে হ্যারিকেন জ্বালাতে গিয়ে একের পর এক ফুরিয়েছে দেশলাই কাঠি। অথচ জ্যামিতির উপপাদ্য আঁকার সময় নির্ভুল ৯০ ডিগ্রি কোণ। বাড়ি বয়ে পুরস্কার দিতে এলে দরজা এঁটে স্বেচ্ছাবন্দি তিনি। পুরস্কার, আত্মপ্রচারের ঘোর বিরোধী ছিলেন বিনয়। জীবনের ‘চাকা’কে তিনি চালিয়েছেন নিজের মতো করে। এই সবটা মিলিয়েই তিনি ‘ফিরে এসো চাকা’র কবি বিনয় মজুমদার। তাঁর ৮৮তম জন্মদিন আজ।

কবি বিনয় মজুমদার মায়ানমারের মিকটিলা জেলার টোডো শহরে ১৯৩৪ সালে এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। বিপিনবিহারী মজুমদার এবং বিনোদিনী দম্পতির ছয় সন্তানের মাঝে বিনয় মজুমদার (মংটু) ছিলেন সবচেয়ে ছোট। ১৯৪২ সালে বাংলাদেশের একটি স্কুলে ভর্তি হন কবি। ১৯৪৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করার পর ১৯৪৬ সালে তাকে বৌলতলী উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় সপরিবারে তাঁরা ভারতের কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫১ সালে আইএসসি (গণিত) পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম হন তিনি। ১৯৫৮ সালে ছাত্রজীবন সমাপ্ত হবার কয়েকমাস পরেই এনবিএ থেকে প্রকাশিত হয় ‘অতীতের পৃথিবী’ নামক একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এই বছরেই গ্রন্থজগৎ থেকে বের হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা, গণিত নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণাধর্মী লেখা, একের পর এক চাকরি ছেড়ে শুধু কবিতাকে আঁকড়ে বাঁচা। বিনয়ের কথায়, “জড়, উদ্ভিদ, কীট পতঙ্গ, মানুষ সবার সৃষ্টিরহস্য এক। সে কথা উপলব্ধির পরেই শুরু হল কবিতা নিয়ে পথ চলা, আমার নিজস্বতা।”

আরও পড়ুন- ভালবাসা মরে গেলেও থাকে স্মৃতিতে! ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা চেনায় অন্য প্রেম

কর্মজীবন, সাহিত্য জীবন ও মানসিক কেন্দ্রে থাকার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি একাকিত্বের সময়টা, স্বেচ্ছায় নিজেকে গৃহবন্দি রেখেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর স্টেশন ছোঁয়া শিমুলপুরে, নিজের ভিটেবাড়িতে। এই বাড়িতে থাকার সময় মাঝে মাঝে ভোরে গিয়ে বসতেন ঠাকুরনগর স্টেশনে। ঘরে ফিরে দরজার ছোট্ট ফুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন, কখন আসবে খাবার। রাতে ছিল আকাশ দেখার নেশা—

শুধু চাঁদ দেখবার জন্য আমি বিছানায়

উঠে বসি, চাঁদ আছে বলে

ঘুমোতে বিলম্ব হয়।

এই বাড়িতে বসেই নিজের স্বভাবভঙ্গিমায় তিনি বলেছিলেন,

আমি ভারতের প্রথম চাঁড়াল কবি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, লেখা ছেড়ে দেওয়ার পরেও, আমি যে কবি নই— এ কথা বলে কিংবা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। আমি এখন কয়েক জনকে চাঁড়াল কবি বানানোর চেষ্টা করছি।

আগেই বলা হয়েছে বিনয় মজুমদারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’। এছাড়াও তিনি লিখেছেন ‘ফিরে এসো চাকা’, ‘গায়ত্রীকে', যার উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন ‘আমার ঈশ্বরীকে’। লিখেছেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ ইত্যাদি। ‘গায়ত্রীকে’-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২৪ ফাল্গুন, ১৩৬৭তে এবং দ্বিতীয় সংস্করণের নাম হয় ‘ফিরে এসো, চাকা’, প্রকাশিত হয় ৩১ ভাদ্র, ১৩৬৯তে। জীবনানন্দ বললেই যেমন প্রথমেই মনে আসে রূপসী বাংলার কথা তেমনই বিনয় মজুমদারের নামের সঙ্গেই চলে আসে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্থের কথা। বিনয় লেখেন, “ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,/ রথ হ’য়ে, জয় হ’য়ে, চিরন্তন কাব্য হ’য়ে এসো।/ আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/ সুর হ’য়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” পয়ার ছন্দে বিনয়ের লেখায় সমস্ত কবিতাই যেন অন্তিম, অমোঘ এক গন্তব্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “যে কোনও বিষয়েই কবিতা লিখতে পারে বিনয়।”

book cover

'ফিরে এসো চাকা' বইয়ের প্রচ্ছদ

বিনয়ের ‘গায়ত্রীকে’— এক ফর্মার চটি বই, যেখানে রয়েছে মোট চোদ্দোটা কবিতা। নাম অনুযায়ী মনে হতেই পারে কবিতাগুলি জনৈক গায়ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই। এই গায়ত্রী কে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার করে বিনয় কখনও কিছু বলেননি, ইচ্ছে করেই হয়তো অনেকটা ঘনীভূত হতে দিয়েছেন রহস্য। যে রহস্যের উদঘাটন পাঠকমহল নিজেদের মতো করেই বারবার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। বিনয়ের সমসাময়িক অনেকের থেকেই জানা যায় যে, এই গায়ত্রী পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রী গায়ত্রী চক্রবর্তী, পরবর্তীকালে যিনি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক নামে পরিচিতি পেয়েছেন।

আরও পড়ুন- প্রাপ্য শুধুই সহমর্মিতা! উমরের মুক্তি চেয়ে কি আদৌ জোট বাঁধবে দেশ?

বাঙুর সাইকিয়াট্রি ইনস্টিটিউটে মাস দু’য়েক ভর্তি থাকার সময় কবিতা লিখলে তবেই ঠাকুরনগরের বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হবে, বুঝিয়ে তাঁকে লেখানো হয় কবিতা। বিনয় নিজেই বলেছেন, “কবিতা লেখা আমি মাঝে মাঝে ছেড়ে দিই। তখন এমন কাণ্ড ঘটে, যাতে ফের লিখতে বাধ্য হই। আমাকে হাসপাতালে পুরে কাগজ এবং কলম দিয়ে আমাকে বলা হল, ‘কবিতা লিখলে ছাড়া হবে। নচেৎ নয়’।” ২০০০ সালের বন্যা পরিস্থিতি, চারিদিকে উত্তাল জল! সেই জল ভাসিয়েছে বিনয়কে। ঝড়ে ঘর ভাঙা পাখির মতো তিনি তাঁর ঠাকুরনগরের বাড়িতে একা। সম্পাদকদের কাছ থেকে আসা লেখার সমস্ত অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থটি। শেষ কাব্যটিতেও হাসপাতালের নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে অমোঘভাবে এসে গিয়েছেন গায়ত্রী, “আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে, তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে, চিঠি লিখব না। আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।”

আসলে বিনয় কবিতা লেখার জন্য লেখেননি। তাঁর জীবনটাই হয়ে উঠেছে একটা আস্ত কাব্যগ্রন্থ। যেখানে প্রতি পাতায় লেখা হয়েছে কবিতা। নিজের জীবনবোধ আর রক্তের অক্ষরে তিনি সাজিয়েছেন সেই লেখাকে। আসলে বিনয় মজুমদার ঠিক ‘পাগল’ ছিলেন না, ছিলেন কাব্যোন্মাদ, আত্মভোলা এক শিশু এবং কবিতার সাধক, যাঁকে বুঝতে, আত্মস্থ এখনও বহু বছরের সাধনার প্রয়োজন পাঠকের।

ঋণ: ‘গায়ত্রীকে’ বিনয় মজুমদার

আনন্দবাজার পত্রিকা

More Articles