Ram Jethmalani: রাজীব গান্ধীকে সপাট উত্তর থেকে ধর্মেন্দ্র-কে চুম্বন! বিতর্ক কখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি
Ram Jethmalani: আগামী বছর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে রাম জেঠমালানি-র।
ডবল প্রোমোশন পেয়ে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছিলেন তেরো বছর বয়সে। সতেরো বছর বয়সে বম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এলএলবি ডিগ্রি। তখন নিয়ম ছিল, একুশ বছর বয়সের আগে আইনজীবী হওয়া যাবে না। শুধু এই মেধাবী ছাত্রটির জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছিল। তিনি রাম জেঠমালানি। রাম জেঠমালানি বলতেন, কোনও মানুষ যদি বেআইনি অর্থ নিজের পকেটে ভরে আমার চেম্বারে আসে, তাহলে তার পকেটের ভার কমানো আমার কর্তব্য। এমনই ছিলেন তিনি।
জন্ম ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বম্বে প্রেসিডেন্সির সিন্ধ প্রদেশে। বম্বে তখনও মুম্বই হয়নি। বাবা বুলচন্দ গুরমুখদাস জেঠমালানি এবং মায়ের নাম পার্বতী বুলচন্দ। জেঠমালানি পড়তেন করাচির এসসি সহানি আইন কলেজে। রামের বাবা এবং ঠাকুরদা নিজেরা দুঁদে উকিল হলেও চাননি তাদের ঘরের ছেলে উকিল হোক। তারা চেয়েছিলেন রাম জেঠমালানি একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার হোন। কিন্তু বরাবরই বিদ্রোহী স্বভাবের ছিলেন তিনি। এই স্বভাবের কারণে ইতিহাসের পাতায় অন্যতম বর্ণময় চরিত্র হয়ে রয়েছেন ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে দামী উকিল রাম জেঠমালানি।
১৮ বছর বয়সে আত্মপ্রকাশ পেশাদার আইনজীবী হিসেবে। ওই বয়সেই প্রথম বিয়ে। সনাতন ভারতীয় রীতিতে বিয়ে করেছিলেন পরিবারের পছন্দের পাত্রী দুর্গাকে। দেশভাগের আগেই সিন্ধ প্রদেশে মামলা লড়েছিলেন তিনি। করাচিতে শুরু করেছিলেন ল ফার্ম। কিন্তু উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্য করাচি ছাড়তে বাধ্য হন। প্রথম বিয়ের ছ'-বছর পরে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঠিক আগে দ্বিতীয় বিয়ে। এবার নিজের পছন্দের পাত্রী আইনজীবী রত্না সহানির সঙ্গে ঘর বাঁধলেন রাম। ১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের জন্ম হলে করাচি ছেড়ে দুই স্ত্রী-সহ বম্বে চলে আসেন রাম। শরণার্থী শিবিরে কয়েক দিন কাটিয়েই ফের বম্বে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন তিনি। দেশভাগের পর পকেটে আর কানাকড়িও ছিল না। রীতিমতো শূন্য থেকেই শুরু করেন রাম জেঠমালানি। উদ্বাস্তু জেঠমালানি-র বম্বেতে প্রথম মামলা ছিল শরণার্থীদের জন্যই। সে-সময়ে সদ্য চালু হওয়া বম্বে রিফিউজিস অ্যাক্ট ছিল শরণার্থীদের প্রতি অমানবিক। এই আইনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন এবং জয়ী হয়েছিলেন রাম জেঠমালানি।
আরও পড়ুন: কোনও পুরুষই সামলাতে পারেননি কোহিনূর! কোন মন্ত্রে ‘অভিশপ্ত’ হিরের নতুন মালিক হচ্ছেন ক্যামিলা!
ছয়ের দশকের শেষভাগ থেকেই একের পর এক কারণের জন্য শিরোনামে থাকতে শুরু করেন এই বর্ষীয়ান উকিল। আজ তার জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক এমনই কিছু ঘটনা।
‘স্কচ’ বলছি মানে সিঙ্গল মল্ট, হাই কোয়ালিটি স্কচ
রাম জেঠমালানির স্কচের প্রতি অদম্য ভালবাসা কারও অজানা নয়। ওঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল সিঙ্গল মল্ট স্কচ। ঘটনাটি ঘটে ছয়ের দশকের শেষভাগে। তখনও বম্বে মুম্বই হয়নি এবং সেই সময় মদ বিক্রি নিয়ে খুব কড়াকড়ি ছিল। সেই সময় এক ব্যক্তির থেকে প্রায় এক ডজন মদ বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। যথারীতি স্মাগলিংয়ের কেস লাগে। এবার সেই লোকটি বাঁচতে চেয়ে দ্বারস্থ হন রাম জেঠমালানির। সেই সময়ে রাম যথেষ্ট বড় উকিল ছিলেন, কিন্তু সেই কারণে ওই ব্যক্তি তাঁর কাছে ছোটেননি। রাম জেঠমালানি-র সিঙ্গল মল্ট স্কচপ্রীতি সর্বজনবিদিত। আর ঘটনাচক্রে বাজেয়াপ্ত হয়েওছিল সিঙ্গল মল্ট স্কচই। প্রিয় মদের খাতিরে যথারীতি রাম জেঠমালানি কেসটি নিলেন। কোর্টে যখন উঠলেন, তখন জজসাহেব রাম জেঠমালানি-কে বললেন, আপনি আমায় যদি একটিও কারণ দেখাতে পারেন, কেন আপনার মক্কেলকে ছেড়ে দেওয়া উচিত, আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেকসুর খালাস করে দেব। রাম জেঠমালানি সদর্পে বললেন, “ওঁকে ছেড়ে দিন। উনি দারুন স্কচ সাপ্লাই করেন, স্কচ বলছি মানে সিঙ্গেল মল্ট হাই কোয়ালিটি স্কচ।” শুনতে অবাক লাগলেও জজসাহেব ওই স্মাগলারকে তক্ষুনি বেকসুর খালাস করে দেন, কেননা জজসাহেব নিজেই একজন স্কচভক্ত ছিলেন। আর তা রাম জেঠমালানি এটা খুব ভালোভাবেই জানতেন। এরপর বহু চোরাচালান-সংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্তদের হয়ে মামলা লড়ায় তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘স্মাগলার্স লইয়ার’।
আপনি ‘পিস্কি’ খান, আমায় হুইস্কি খেতে দিন
১৯৭৫-'৭৭ সালে রাম জেঠমালানি ছিলেন বার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। ইন্দিরা গান্ধীর সমালোচনা করায় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। পরে দেশজুড়ে এর বিরুদ্ধে আইনজীবী মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় তা নাকচ হয়ে যায়। এই বিতর্কের মধ্যেই জেঠমালানি কানাডা চলে যান। দেশে ফেরেন দশ মাস পরে, জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পরে। শুরু হয় তাঁর পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক জীবন। '৭৭-এর নির্বাচনে বম্বে নর্থ ওয়েস্ট লোকসভা সিট থেকে জনতা পার্টির টিকিটে ভোটে লড়েন জেঠমালানি এবং জেতেনও। সারা দেশে বিপুল আসন জিতে ক্ষমতায় আসে জনতা পার্টি এবং প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই। গান্ধীবাদী মোরারজি দেশাই বিন্দুমাত্র মদ্যপান সহ্য করতে পারতেন না। তিনি রাম জেঠমালানি-কেও অনুরোধ করেন জনসমক্ষে পান না করতে। প্রত্যুত্তরে রাম বলেন, “আপনি পিস্কি খান, আমায় হুইস্কি খেতে দিন।” ‘পিস্কি’-র অর্থ হলো গোমূত্র। মোরারজিভাই ইউরিন থেরাপি অর্থাৎ গোমূত্র-র মাধ্যমে রোগ নিরাময়ে বিশ্বাসী ছিলেন। এই মন্তব্যের জন্যই মনে করা হয় সেই সময়ে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হতে পারেননি রাম জেঠমালানি।
কুকুররা চোরকে দেখেই ঘেউ ঘেউ করে
২৬ জুন, ১৯৮৭, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নাম না করে কটাক্ষ করেন রাম জেঠমালানি-কে। তিনি বলেন, “কুকুররা ঘেউঘেউ করতেই থাকে, সবার দিকে তো আর ফিরে তাকানো যায় না।” ২৭ জুন এই খবরটি প্রকাশিত হলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর কর্ণধার রামনাথ গোয়েঙ্কা রাম জেঠমালানি-র মহারানি বাগের ফ্ল্যাটে যান দেখা করতে। রাম জেঠমালানি-র কাছে এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া চাইলে তিনি একটি চিঠি লিখে রামনাথ গোয়েঙ্কা-র হাতে ধরিয়ে দেন। সেটি পড়ে হাসিতে ফেটে পরেন রামনাথ গোয়েঙ্কা। পরদিন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর হেডলাইন ছিল, ‘কুকুররা চোরকে দেখেই ঘেউ ঘেউ করে’।
আমার প্রথম বউ তোমার একমাত্র বউয়ের থেকে বেশি সুখী
রাম জেঠমালানি প্রথম বিয়ে করেন ১৮ বছর বয়সে পরিবারের পছন্দের পাত্রী দুর্গাকে। প্রথম বিয়ের ছ'-বছর পরে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ঠিক আগে নিজের প্রেমিকা আইনজীবী রত্না সহানির সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ করেন রাম জেঠমালানি। সেই সময়ে হিন্দু আইন অনুযায়ী বহুবিবাহ বৈধ ছিল। পরবর্তীকালে রাম জেঠমালানি-কে এক টিভি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়, আইনজ্ঞ হয়েও আপনি কীভাবে একসঙ্গে দুই বউয়ের সঙ্গে সংসার করে গেলেন। উত্তরে দুঁদে আইনজীবী রাম জেঠমালানি বলেছিলেন, “আমার প্রথম বউকে তোমার একমাত্র বউয়ের থেকে বেশি সুখী রেখেছি আমি। তাহলে সমস্যা কোথায়?” খুব একটা ভুল বলেননি তিনি। জীবনের শেষ দিন অবধি দুই স্ত্রীকে নিয়েই অটুট ছিল সংসার। দুই পক্ষর স্ত্রী-দের থেকে মোট চার সন্তান তাঁর। প্রথম স্ত্রী দুর্গার তিন জন সন্তান। রানি, শোভা এবং মহেশ। দ্বিতীয় স্ত্রী রত্নার একমাত্র ছেলে, জনক। শোনা যায় দুই পত্নী থাকা সত্ত্বেও রাম জেঠমালানি-র একাধিক প্রেমিকা ছিল।
চুম্বন বিভ্রাট
জনসমক্ষে চুমু খেয়ে বহুবার বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন রাম জেঠমলানী। ২০১৪ সালে, জনপ্রিয় অভিনেতা ধর্মেন্দ্র রাম জেঠমালানি-র জন্মদিনে যান। ধর্মেন্দ্র ফুল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাম ধর্মেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন। যে সে চুমু নয়, পুরো লিপলক কিস। স্বভাবতই ঘটনায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন অভিনেতা। এরপর ২০১৫ সালে শোরগোল ফেলেছিল কিশোর কুমারের স্ত্রী লীনা চন্দ্রভরকরের সঙ্গে তাঁর চুম্বনরত ছবি। যদিও এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না রাম জেঠমালানি।
কার্যত শূন্য থেকে শুরু করে হাই কোর্টের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক-প্রাপ্ত উকিল হয়েছিলেন রাম জেঠমালানি। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, জীবনের ৯০ শতাংশ কেসে কোনও পারিশ্রমিকই নেননি তিনি। এই প্রসঙ্গে হাই কোর্টের এক জজসাহেব একবার বলেছিলেন, রাম জেঠমালানি শুধুমাত্র ১০ শতাংশ কেসের পারিশ্রমিক নিয়ে যা রোজগার করলেন, তা কোনও সাধারণ উকিল দশ জন্মেও করতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে। ব্ল্যাক লেবেল, মার্সিডিজ এবং ব্যাডমিন্টন-প্রিয় রাম জেঠমালানি সপ্তাহান্তে পুনের এক অনাথালয়ে গিয়ে শিশুদের বিনামূল্যে পড়াতেন। ওই অনাথালয়ের ভরণপোষণের দায়িত্বও তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। অত্যন্ত বর্ণময় জীবন কাটালেও সামাজিক কর্তব্য থেকে কখনও পিছিয়ে আসেননি তিনি। ঠিক যেমন তিনি কখনও পিছিয়ে আসেননি কোনও বিতর্কিত কেস নেওয়ার থেকে। অসংখ্যবার হাই প্রোফাইল অভিযুক্তদের হয়ে সওয়াল করেছেন আদালতে। হর্ষদ মেহতা, কেতন পারেখ, ডেইডি অ্যাঙ্গাস, হাওয়ালা-কাণ্ডে অভিযুক্ত লালকৃষ্ণ আদবানি, জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মনু শর্মা, আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হাজি মস্তান- সবার হয়ে সওয়াল করেছেন তিনি। ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডেও অভিযুক্তদের আইনজীবী হিসেবে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। টু-জি স্পেকট্রাম কাণ্ডে কানিমোজি, আর্থিক তছরূপে জগনমোহন রেড্ডি, খনি মামলায় ইয়েদুরাপ্পা, সোহরাবুদ্দিন মামলায় অমিত শাহ-র আইনজীবী ছিলেন জেঠমলানী। বাবা রামদেব, আশারাম বাপু, লালুপ্রসাদ যাদব, সাহারার মালিক সুব্রত রায়, জয়ললিতা, অরবিন্দ কেজরিওয়াল- জীবনের বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত হয়ে রাম জেঠমালানি-র শরণাপন্ন হয়েছিলেন এঁরাও। এত বিতর্কিত কেস কেন নেন ? এই প্রশ্নের জবাবে রাম জেঠমলানী বলতেন, “ভালো আইন ভালো মানুষদের কেসে নয়, খারাপ মানুষদের কেসেই তৈরি হয়।”
রাজনীতিকদের পাশাপাশি রাজনীতিতেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। ১৯৯৬ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে আইনমন্ত্রী হন, ১৯৯৮ সালে দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের। এর পর ১৯৯৯ সালে ফের আইনমন্ত্রী। ২০০৪ সালে নির্দল প্রার্থী হিসেবে লখনউ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিরুদ্ধে। কিন্তু পরাজিত হন। আবার ২০১০ সালে বিজেপি-র টিকিটে রাজস্থান থেকে রাজ্যসভার সদস্য হন। দলবিরোধী মন্তব্যের জেরে তিনি বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত হন ২০১২ সালে। ৯৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে ২০১৯-এর ৮ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন ভারতীয় রাজনীতি এবং আইনব্যবস্থার এই বর্ণময় চরিত্র।