সেলিম আলিকে কি ভুলে গেলাম আমরা? কে আর মনে রাখে অজয় হোমকে...

আঠেরো-উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পাখি সংরক্ষণ ঠিক কী তা ভারতীয়দের ভাবনা চিন্তার বাইরে ছিল। ভারতীয় পক্ষী সংরক্ষণের পথিকৃৎ সেলিম আলিও পাখি শিকারের মধ্যে দিয়েই পাখি ভালবাসতে শুরু করেছিলেন। কালে কালে তিনি হয়ে উঠবেন ‘বার্ডম্যান অফ ইন্ডিয়া’ তা কে আর ভাববে। নিজের ডায়েরিতে নিজের পাখি শিকারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে সেলিম লেখেন, “বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল করে অতর্কিতে গুলি করলাম। পুরুষ চড়াইটি মরে গেল আমার গুলিতে। তার খানিক পরেই দেখি স্ত্রী চড়াইটি আরেক পুরুষ চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরে একই জায়গায় পাহারায় বসে। এই চড়াইটিকেও আমি মেরে ফেললাম। তারপর দেখি আবার এক পুরুষ চড়াই এসে বসেছে। এইভাবে গোটা সাত দিনে আমি আটটি চড়াই মেরেছিলাম।’’ এই সেলিমই একদিন লিখবেন, যান্ত্রিক এই জগত থেকে আমার মুক্তির একমাত্র পথ হলো পাখি দেখা।

সেলিম যখন এই শিকারকথা লিখছেন ডায়েরিতে তখন তাঁর বয়স নয় কি দশ বছর। পাঁচ ভাই ছাড় বোনের সংসারে বড় হয়ে ওঠা সেলিমের মামা আমীরউদ্দিন ছিলেন শিকারি। মামার কাছ থেকেই শিকার শিখেছিলেন সেলিম। এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকারে রীতিমত রপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।কিন্তু একদিন এক চড়াই পাখি শিকারের পর সেলিমের চোখ যায় পাখির গলায়। পাখির গলায় অদ্ভুত হলদে ছোপ দেখে সন্দেহ জাগে সেলিমের। কারোর কাছ থেকেই সঠিক উত্তর না পেয়ে চিঠি লেখেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির’ তৎকালীন সেক্রেটারি ডাবলু এস মিলার্ডকে। সোস্যাইটির ভিতরের দেওয়ালে সংরক্ষিত জীবজন্তু, পাখি, প্রজাপতি দেখে ছোট্ট সেলিম কৌতূহলী হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই বদলাতে শুরু করে সেলিমের জীবন। আত্মজীবনী 'দ্য ফল অব আ স্প্যারো'-তে তিনি লিখছেন, “অস্থিতপঞ্চক সভ্যতার দ্রুতবেগের এই যান্ত্রিকযুগের কোলাহলময় ডামাডোল থেকে আমার মুক্তির রাস্তা হল পাখি দেখা।“

পাখিও যে সংরক্ষণ ও গবেষণার উপাদান হতে পারে তা হাতে কলমে প্রমাণ করেছিলেন সেলিম। পাখির প্রজাতি থেকে শুরু করে তাদের বাসস্থান, প্রজনন, দিনযাপন সব নিয়েই খুঁটিয়ে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর লেখা অসামান্য বই 'বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস' আজও ভারতীয় পক্ষী বিশারদদের কাছে আকর গ্রন্থ। পাখির সন্ধানে নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, আফগানিস্তানের মতো অজস্র দেশ ঘুরেছেন। প্রতিটি সমীক্ষার উপর বই লিখেছেন। সেলিমের পর্যবেক্ষণ ছিল, কেবল পাখি নয় তাঁর গায়ে বসে থাকা পোকারা ও সমীক্ষা ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ সব পোকা সব প্রজাতির পাখির গায়ে বসে না। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০- দুইদশক সেলিমের পরীক্ষাগার ছিল হায়দরাবাদ। সেখান থেকেই পক্ষীকুলের বংশবিস্তারের সুলুকসন্ধান চালিয়েছিলেন। 

১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ টানা এই সময় জুড়ে ভুটানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংগ্রহ অভিযানে যান সেলিম। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে পাখির বিচিত্রতা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ ফিল্ড গাইড টু দ্য বার্ডস অফ দি ইস্টার্ন হিমালয়াজ।' গোটা দেশের পাখি সংরক্ষণের  কাজে সেলিম ছিলে একা প্রহ্লাদ। কীভাবে পাখির যত্ন নেওয়া যায়, কীভাবে দুস্প্রাপ্য পাখি সংরক্ষণ করতে হয় তার উপর  অজস্র প্রবন্ধ, চিঠি লিখেছেন। ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে পাখি শিকার শুরু করেন বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো। মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৪,২৭৩ টি হাঁস, রাজহাঁসের। এই নির্মম পাখি শিকার বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সেলিম।

১৯৫০ সালে একমাত্র ভারতীয় হিসেবে সেলিম সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষীতাত্ত্বিক কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ভারতে পক্ষী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে সেলিমের নামে নামাঙ্কিত হয়েছে গোয়ার বার্ড স্যাংচুয়ারি, কেরলের থাত্তেকাড বার্ড স্যাংচুয়ারির, বাদ যায়নি পাখির নামও। ২০১৬ তে হিমালয়ে পাওয়া যায় এক নতুন প্রজাতির পাখি যার নাম হিমালয়ান ফরেস্ট থ্রাস যার বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে-জুথেরা সেলিম আলি।

আরও পড়ুন-২১ দিনে তিন বাঙালির ভূস্বর্গ জয়, দু’চাকায় ইতিহাস লিখলেন চন্দনরা

আমাদের গল্পটা এখানেই থেমে যেতে পারত। ১২৪ পেরিয়ে ১২৫ এ পদার্পণের বছরে সেলিমকে সেলাম জানিয়ে। কিন্তু এখান থেকেই যেন ব্যাটন ধরলেন এক বঙ্গসন্তান। পাখিদের অজানা জগত চেনানোয় তাঁরও কৃতিত্ব কিছু কম নয়। মেজর ফ্র্যাঙ্কলিন, স্যামুয়েল টিকল, সেলিম আলির সঙ্গেই এক সারিতে উচ্চারিত হয় অজয় হোমের নাম। বাংলায় পরিবেশকে চেনার বিষয়ে তাঁর সমকক্ষ পাওয়া মুশকিল। ছোটবেলা থেকেই পাখির প্রতি ভালবাসা আর উৎসাহই তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল বার্ডম্যান অফ বেঙ্গল হিসেবে। জীবনের দীর্ঘ চল্লিশ বছর পাখির গবেষণায় জড়িয়ে ছিলেন অজয়। অবিভক্ত আসাম, বাংলা এবং বিশেষত সুন্দরবনের পাখিদের ওপর তাঁর অসামান্য কাজ রয়েছে। সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃতি ও পাখির নিবিড় সহাবস্থানের কথা বোঝাতে গিয়ে নিজের উদ্যোগে প্রকাশ করতেন ‘প্রকৃতি জ্ঞান’ বলে একটি পত্রিকা।

বাঙালি নানা পেশার নানা নেশার মানুষকে কদরই করে এসেছে। কিন্তু অজয় হোমের মতো প্রকৃতিপ্রেমী যে কেন এত অল্পশ্রুত, কেন যে প্রচারের আলো থেকে এত এত দূরে, সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না। বাংলার পাখি নিয়ে তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফসল ‘ বাংলার পাখি’ বইটিও তেমন প্রচার পায় না। জহুরি সোনা চেনে। অজয় হোমের বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সচেতনতার প্রসারে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে তাঁকে সায়েন্স এডুকেশন অফ বেঙ্গল বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করে। জাতীয় পক্ষীদিবসে আমরা কি তাঁকেও একবার কুর্ণিশ জানাব না? 

More Articles