নতুন টালা ব্রিজে মজে কলকাতা! উচ্ছেদ হওয়া শ্রমজীবী-বস্তিবাসীদের সুদিন আসছে কবে?
Chitpur Slum Eviction: চিৎপুর সেতুর কাছে থাকে প্রায় আশিটির কাছাকাছি পরিবার, ব্রিজ ভাঙার কাজ শুরু হলে তাদের কোথায় পাঠানো হতে পারে, এ বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা করা হয়
এবছরের দেবীপক্ষের সূচনার আগেই গত ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতাবাসী নতুনরূপে ফিরে পেল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত টালা ব্রিজ, ইতিহাসের পাতার ‘কাউ ক্রসিং ব্রিজ’। প্রত্যাশিতভাবেই উদ্বোধক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ব্রিজের দরুন শহরের উত্তরাংশের যানজট অনেকাংশেই লাঘব হবে বলে মনে করছেন অনেকে। এসব সংবাদ এতক্ষণে সকলেরই জানা। ২০১৮ সালে মাঝেরহাট ব্রিজ দুর্ঘটনার পরই কলকাতার বিভিন্ন অংশের প্রাচীন ব্রিজগুলির স্বাস্থ্যপরীক্ষা শুরু করে কেএমডিএ। এরপর প্রাথমিকভাবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হয় টালা ব্রিজ ভাঙার কাজ। জানা যায়, প্রাথমিকভাবে শ্যামবাজারগামী ফ্ল্যাঙ্কে হালকা যান চলচলের মাধ্যমে সেতুটিকে পরীক্ষাধীন রাখতে চায় সেতু প্রস্তুতকারী সংস্থাটি, অপর ফ্ল্যাঙ্কটি চালু করতে আরও কিছুদিন সময় নিতে চায় তারা। খুব স্বাভাবিভাবেই প্রায় আড়াইবছর পর এই সেতুর কামব্যাকে অনেকটাই ঝাড়া হাত-পা হবে বিটি রোড, বেলগাছিয়া, চিৎপুর, টালাপার্ক, চিড়িয়ামোড়, সেভেন ট্যাংকসের মতো এলাকাগুলি এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নেবেন বহু বেসরকারি বাস মালিকরাও।
তবে যে গল্পটা অনেকেরই অজানা, তা হল, নবরূপে টালা সেতুকে আনার প্রকল্পে ভিটে-মাটিহারা হয়েছে প্রায় দেড়শোটির কাছাকাছি পরিবার। গত ২২ সেপ্টেম্বর, সেতু উদ্বোধনের দিন সেই সমস্ত বস্তিবাসী সাধারণ মানুষেরা মানববন্ধনের মাধ্যমে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, তাদের পুনর্বাসন, বিদ্যুৎ-জল-শৌচাগারসহ সুব্যবস্থার দাবিতে। এই সময়ে দীর্ঘদিন বস্তিবাসী মানুষদের আন্দোলনের পাশে থাকা বেশ কিছু কর্মীকে রাজ্য সরকারের পুলিশ উল্টোডাঙ্গা থানায় আটক করে রাখে বলেও খবর পাওয়া যায়। শেষে বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি (বিএসএআরসি) টালা শাখার নির্দিষ্ট প্রস্তাব মোতাবেক উদ্বোধন মঞ্চ থেকে খোদ মুখ্যমন্ত্রী এবং ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করেন এবং রেল কর্তৃপক্ষের কাছে জমি চেয়ে তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনার কথা সর্বসমক্ষে জানান।
পরিকল্পনা মতো সুষ্ঠুভাবে তাদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত টালা অঞ্চলের বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষ তাদের অন্দোলন চালিয়ে যাবেন, এই আশা রাখা যায়। খুব স্বাভাবিক চোখেই দেখা যেতে পারে, এই আড়াই বছর অস্বাস্থ্যকর, ভয়ানক দাহ্য, কালো প্লাস্টিকের ছাউনির ঘরে, তাদের জীবন ঠিক কেমন ভাবে অতিবাহিত হয়েছে! সঙ্গে দীর্ঘদিন ভয় ছিল মারণব্যাধি করোনারও।
আরও পড়ুন- গরু পারাপারের সেতু থেকে আজকের টালা ব্রিজ! যে ইতিহাস অনেকের অজানা
টালা ব্রিজের নবরূপে বিনির্মাণের পরই উত্তরাংশের ব্যস্ততম চিৎপুর ব্রিজ রেনোভেশনের কথা বহুদিন আগে থেকেই পূর্ত দপ্তরের পরিকল্পনায় ছিল। বিপজ্জনক এবং শহরের উত্তরাংশের সঙ্গে শহরতলির গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম এই সেতু ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হবে। সোমবার কলকাতা পুরসভায় চিৎপুর সেতু নির্মাণ নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক হয়। সম্প্রতি মেয়র ববি হাকিম ও ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষও সেকথা জানিয়েছেন এবং তারা উপস্থিতও ছিলেন ওই বৈঠকে। নতুন সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভের কাজ শেষ করেছে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)।
চিৎপুর সেতুর কাছে থাকে প্রায় আশিটির কাছাকাছি পরিবার, ব্রিজ ভাঙার কাজ শুরু হলে তাদের কোথায় পাঠানো হতে পারে, এ বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা করা হয় বলে জানা যায়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে আলোচনায় যেতে পারে পুর কর্তৃপক্ষ। টালা ব্রিজ ভাঙার প্রাক্কালেও দেখা গেছিল, কোনও প্রকার পাকাপাকি পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়াই শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে বস্তিবাসীদের জন্য চলে আসে উচ্ছেদ নোটিশ। তবে জানা যাচ্ছে, এবার চিৎপুর সেতুর কাজ শুরুর পূর্বে আগেভাগেই ভেবে নিতে চাইছে কলকাতার পুরসভা। পার্শ্ববর্তী রেলের একটি জমিতে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হতে পারে। ইতিমধ্যেই পূর্ব রেলকে জমিটি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে পুরসভা। প্রয়োজনে পূর্ব রেলকে বার্ষিক ভাড়া দেবে রাজ্য সরকার। যদিও এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলেই পুরসভা সূত্রে জানা যায়।
বস্তিবাসী শ্রমজীবী মানুষদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, তাদের এ বিষয়ে রাজি করানো যথেষ্টই চ্যালেঞ্জের বিষয় হতে পারে পুরসভার কাছে। এরপর তাদের ‘বেআইনি জবরদখলকারী’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়াই প্রশাসনের কাছে দস্তুর। কলকাতার বস্তিবাসীদের দুর্দশা, তাদের জীবনধারণের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন আজকের নয়। বস্তিবাসীদের জন্য কোনও সঠিক আইন প্রণয়ন হয়নি এখনও। এই আইন প্রণয়নের দাবির জন্য, জীবনধারণের সমস্ত ন্যায্য অধিকারের জন্য বস্তিবাসী শ্রমজীবীদের আন্দোলন চলমান আজও। এর আগেও বেঙ্গল কেমিক্যাল, বাগবাজার বস্তি, নিউটাউন, সল্টলেকসহ বিভিন্ন জায়গায় বস্তিবাসীদের দুর্দশা ও সঠিক পুনর্বাসনের অভাব এবং প্রশাসনিক গাফিলতির ছবি সময়ের আর্কাইভেই বিদ্যমান। বস্তিবাসী মানুষের জন্য নিরাপদ ও বৈধ বাসস্থানের পরিকল্পনাকে স্থান না দিয়ে ‘স্মার্ট সিটি’, ‘গ্রিন সিটি’ বা শহর উন্নয়নের কোনও নীতি তৈরি করা অর্থহীন, যা পুঁজিবাদের সাকুল্যে পরিকল্পিত হচ্ছে প্রত্যহ। বস্তি সমস্যার সমাধান প্রথম চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত সমস্ত মেকি উন্নয়নের আড়ালে। নইলে এই শহরের প্রায়-প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোজ রাতে যেমন জতুগৃহে ঘুমোতে যেতেন, তেমনই যাবেন। অপেক্ষা করবেন পরবর্তী কোন নতুন দুর্দশাপর্বের জন্য।
সময়ের শিলালিপি ধরে একটু ভিন্ন আলোচনায় আসা যাক। সামগ্রিকভাবে এই চিৎপুর, বাগবাজার, শোভাবাজারসহ শহরের উত্তরাংশের অঞ্চলগুলিতে লুকিয়ে রয়েছে তখনকার অধিবাসীদের পুনর্বাসনের ইতিহাস। আঠারো শতকের শুরুয়াতে ইংরেজ বণিকদের আগমনের সময় থেকেই চিৎপুর (পূর্বের চিত্রপুর) ছিল এ শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ১৭০৬ সালে মাত্র আটটি পাকাবাড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই এই অঞ্চলে পাকাবাড়ি উঠে যায় প্রায় পাঁচশোর কাছাকাছি সংখ্যায়। যেগুলিতে তৎকালীন ইংরেজ বণিক ও তাদের লোকজনদেরই বসবাস ছিল বেশি। বর্তমান চিৎপুর রোড ছিল সেসময়ে এ শহরে তীর্থযাত্রার জন্য পরিচিত রাস্তা। এই রাস্তা ধরেই তীর্থযাত্রীরা যেতেন দক্ষিণে কালীঘাট কালীমন্দিরে কিংবা চিৎপুরেই স্থিত ঐতিহাসিক নবরত্ন মন্দিরে, যা বর্তমানে ভগ্নস্তূপ।
১৭৫০-এর দশকে গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হলে উক্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা উত্তর কলকাতায় চলে আসেন। চিৎপুর রোড ছিল কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তা। ধনীদের পাশাপাশি এই অঞ্চলে বহু সাধারণ ব্যবসায়ীর বাস ছিল। বাংলা পঞ্জিকা এখানে ছাপা হতো। এটিই ছিল বটতলা বইবাজারের কেন্দ্র। চিৎপুর রোডের সঙ্গে যুক্ত অনেক কিছুই কলকাতার বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল– পান, আড্ডা, যাত্রা ও বিবাহ উৎসবে ব্রাস ব্যান্ডের কেন্দ্রও ছিল এই রাস্তা।
আরও পড়ুন- জাপানি বোমা থেকে আমফান, কিছুই টলাতে পারেনি শতাব্দী পার করা টালা ট্যাঙ্ককে
মজার ব্যাপার হল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার আগে শেঠ বা বাংলার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সুতানুটির জঙ্গল (যেটি ভবিষ্যতের কলকাতা শহরের একটি অংশ হবে) পরিষ্কার করা শুরু করেছিল এবং পশ্চিম থেকে পূর্বে একটি পথ তৈরি করেছিল (আজকের বাগবাজার স্ট্রিট) হুগলি নদীর বন্দরে, তাদের পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে। তারা নিজেদের জন্য ঘর তৈরি করেছিল এবং বাজার স্থাপন করেছিল যেখানে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য ক্রয় করতে আসত। ১৬৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই স্থানটি দখল করার পর, তাদের ভবিষ্যত নগরায়নের পরিকল্পনার জন্য শেঠদের অভিভাবক হিসেবে বেছে নেয়। ১৭০৭ সালে, কোম্পানি সুতানুটিতে শেঠদের এস্টেটের জন্য জমির ভাড়া কমিয়ে দেয়, ছাড়ের বিনিময়ে শেঠদের প্রভূত সুবিধাদান করে। এইভাবে, তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে (আজকের ডালহৌসি স্কোয়ারের জেনারেল পোস্ট অফিস) উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যাওয়া চিৎপুর রোড নামে পরিচিত তৎকালীন কলকাতার ধমনীসম রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সেসব বণিক ও শেঠদের ওপরই বর্তায়।
এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ঐশ্বর্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ‘বর্গি’, অর্থাৎ পরিচিত মারাঠা গুণ্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়টি মূলত একটি দুঃস্বপ্নের মতো। নির্মম বর্গিরা এর আগেও আলিবর্দী খানের শাসনামলে বাংলার সমৃদ্ধশালী পল্লীতে লুটপাট চালিয়েছিল। শেঠরা ভীত ছিল যে তারা চিৎপুরের আশেপাশে বসতি স্থাপনকারী নব্যধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কেও লুট করতে আসবে। তাই ১৭৪২ সাল নাগাদ কলকাতাকে বর্গিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ৩ মাইল লম্বা একটি পরিখা খনন করা হয়। এটি চিৎপুরের একটি প্রধান খালে পরিণত হয় যা ১৮২৪ সালে পুনরুজ্জীবিত হয়, যখন তৎকালীন পৌরকর্তৃপক্ষ পরিবহনের জন্য জলপথ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। যোগাযোগের জন্য একটি সেতু নির্মাণেরও প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল এবং একারণেই ১৮৪৩ সালে ক্যাপ্টেন জন থমসনের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চিৎপুর সেতু তৈরি হয়, যিনি তৎকালীন ব্রিটিশদের পরিখা সুপারিনটেনডেন্ট এবং আয়রন সাসপেনশন সেতুর এজেন্ট ছিলেন। তৎকালীন মূল্যে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হয় প্রায় ৯৯ ফুট বিস্তৃত এই সেতু নির্মাণে। এর উপর রাস্তাটি ছিল প্রায় ২২ ফুট চওড়া। এটি জনপ্রিয়ভাবে ‘বাগবাজার সেতু’ নামেও পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে, ১৯৩৪ সালে মূল সেতুর একটু পূর্বে একটি নতুন সেতু নির্মিত হয়, এটিই ‘চিৎপুর সেতু’ নামে পরিচিত হয়।
আজ চিৎপুর সেতুর পর বেলগাছিয়া ব্রিজের কাজ শুরু হতেই পারে, যদি ১৮-র মাঝেরহাট ব্রিজের ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি স্মৃতি থেকে মুছে না গিয়ে থাকে আমাদের। একের পর এক ঐতিহাসিক ও শতাব্দীপ্রাচীন সেতুর রেনোভেশন প্রয়োজন এ শহরেরই মানুষদের স্বার্থে, তেমনই প্রয়োজন সেই সেতুগুলির নীচে দিন কাটানো মানুষদের স্বার্থে, তাদের শ্রমের স্বার্থে সঠিক ভাবনার।