আমাদের শরীরে লুকিয়ে প্রাচীন ভাইরাসের জিন! নতুন গবেষণায় তোলপাড় বিশ্বজুড়ে
Viral Genome: নতুন গবেষণা বলছে, মানব-শরীরের ভিতরে থাকা ভাইরাসের অংশবিশেষ বাইরের ভাইরাস দ্বারা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ভাইরাস কি আমাদের বন্ধু হতে পারে? কোভিড অতিমারীর ভয়াবহতা পেরিয়ে এসে এমন ধারণা করা বেশ কঠিন। কোভিড ছাড়াও মাঙ্কিপক্স ও আরও অনেক ভাইরাস-ঘটিত রোগ আজকাল মহামারীর আকার নিচ্ছে। কিন্তু, এমনটা যদি বলা হয় যে, মানুষের শরীরে এমন কিছু ভাইরাস প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে, যা আমাদের আরও অনেক রোগ জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে সাহায্য করে, তবে সেকথা খানিক অবিশ্বাস্য মনে হবে। সন্দেহের অবকাশ যতই থাকুক না কেন, বিজ্ঞানীদের গবেষণা এমনটাই দাবি করছে। দু'দশক আগে থেকেই বিজ্ঞানীগোষ্ঠী মানবশরীরে বসবাসকারী ভালো ভাইরাসের সন্ধান পান।
তবে, সম্প্রতি ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় ‘এভলিউশন এন্ড অ্যান্টিভাইরাল অ্যাক্টিভিটি অফ আ হিউম্যান প্রোটিন অফ রেট্রোভাইরাল অরিজিন’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্র এই বন্ধু ভাইরাসের যাবতীয় কার্যকলাপ প্রমাণ-সহ ব্যাখ্যা করেছে। উক্ত গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, একজাতীয় ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মধ্য দিয়ে সেই ভাইরাস মা-বাবার শরীর থেকে ভ্রুণের শরীরে ঢুকে পড়ে এবং ভাইরাসের জিনোম সংযুক্ত হয় সদ্যোজাতর জিনোমের সঙ্গে। তারপর মানব-শরীরের ভিতরে থাকা ভাইরাসের অংশবিশেষ বাইরের ভাইরাস দ্বারা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। গবেষণাপত্রটির প্রথম লেখক হলেন আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক জন ফ্রাঙ্ক। গবেষণাটি সবিস্তারে বুঝে নেওয়া যাক।
মানুষের জিনে ভাইরাসের জিন সংযুক্ত হয় কীভাবে?
একটি প্রাণীদেহে সমস্ত কাজ নির্দেশিত হয় প্রাণীকোশে থাকা জিন দ্বারা। জিন তার মধ্যে থাকা সংকেতের সাহায্য নিয়ে দেহের সমস্ত কাজ পরিচালনা করে। এই জিনের উপাদান হলো DNA বা ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। এছাড়াও থাকে RNA বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। আমাদের শরীরে প্রোটিন সংশ্লেষে DNA ও RNA-র গুরুত্ব অপরিহার্য। নির্দিষ্ট এক সেট জিনকে জিনোম বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: সম্পূর্ণ নতুন মানুষ প্রজাতির সন্ধান এনে দিল নোবেল! যে রহস্যর সমাধান করল বিজ্ঞান
একটি ভাইরাসের শরীর মূলত প্রোটিন দিয়ে গঠিত। প্রাণীকোশে প্রবেশ করার জন্য, ভাইরাসের একেবারে বহিঃস্তরের প্রোটিন কোশের পৃষ্ঠে থাকা এক ধরনের প্রোটিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়। এই প্রোটিন-বন্ধন প্রক্রিয়া ঠিক যেন একটি তালার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট চাবি লাগানোর মতো। সমগ্র রেট্রোভাইরাস গোত্রের যে কোনও ভাইরাসের এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। প্রোটিন বন্ধন দ্বারা একটি রেট্রোভাইরাস প্রাণীকোশের মধ্যে নিজের RNA প্রবেশ করিয়ে দেয়। আক্রান্ত কোশে সেই RNA রূপান্তরিত হয় DNA -তে। এইভাবে রেট্রোভাইরাসের জিনোম প্রাণীদেহের জিনোমের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। তারপর প্রাণীকোশ জিনের সংকেত অনুযায়ী ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম হয়। এরকমই একটি রেট্রোভাইরাস হলো HIV, যা থেকে আমাদের AIDS রোগ হয়।
এই গোত্রের ভাইরাস এমন কোশগুলিকে আক্রমণ করে, যা সাধারণত একটা প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয় না। কিন্তু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই ধরনের ভাইরাস জননকোশকে (মানুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) আক্রমণ করতে পারে। সেই ভাইরাস আক্রান্ত জননকোশের নিষেকের ফলে উৎপন্ন ভ্রুণের মধ্যে ওই ভাইরাস স্থায়ীভাবে সংযুক্ত হয়। আর এভাবেই পূর্ণাঙ্গ প্রাণীর শরীরে ভাইরাল জিন স্থায়ী বসতি তৈরি করে। প্রাণীদেহে ঢুকে পড়া ভাইরাল জিন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষিত হয়। মানুষের শরীরে এই ধরনের ভাইরাল জিনোম মোট জিনোমের ৮ শতাংশ। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে মানুষের শরীরে এইসব ভাইরাস কয়েক লক্ষ প্রজন্ম ধরে রয়েছে। ভাইরাসের সর্বকনিষ্ঠ যে জিন আমাদের শরীরে পাওয়া গেছে, তা প্রায় দেড় লক্ষ বছর আগেই আমাদের শরীরে ঢুকে পড়েছে। এই ধরনের ভাইরাসের জিন বহু বছর শরীরের মধ্যে থাকতে থাকতে বারবার পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে না, প্রচ্ছন্ন হয়েই থেকে যায়। তবে কোনও কোনও সময় আমাদের শরীরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এই ধরনের অনুপ্রবেশকারী ভাইরাসের জিনের নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়। এখন এই ঘটনা বোঝার পর আমাদের দুশ্চিন্তা হতে পারে, তাহলে কি শরীরের মধ্যে যে কোনও সময় যে কোনও ভাইরাসঘটিত রোগ দেখা দিয়ে উঠবে? না, তেমন দুশ্চিন্তা অর্থহীন। জন্মাবধি আমরা এরকম অনেক ভাইরাস শরীরে নিয়েই ঘুরে বেড়াই।
আরও পড়ুন- ব্রিটিশকে বোকা বানিয়ে ছদ্মবেশে বিদেশ পাড়ি! বিজ্ঞানে-বিপ্লবে বিস্মৃতপ্রায় শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ
প্লাসেন্টা ও ভ্রূণের কোশে ভাইরাস প্রোটিনের সংযুক্তিকরণ ও তার ফলাফল
‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত পূর্ব-উল্লিখিত গবেষণায় গবেষকরা গণনামূলক জিনোমবিদ্যার সাহায্য নিয়ে মানুষের শরীরে থাকা সমস্ত জিনগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ করেন এবং তা থেকে তাঁরা মানব-জিনোমে বহু বছর ধরে লুকিয়ে থাকা ভাইরাল জিনোমের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। তারপর সেই সমস্ত ভাইরাল জিনোমের মধ্যে যেগুলি এখনও সক্রিয়, অর্থাৎ যারা একটি ভাইরাল প্রোটিনকে অন্য কোশের সঙ্গে প্রোটিন-বন্ধন দ্বারা যুক্ত করার সংকেত দিতে পারে, সেই সমস্ত জিনগুলিকে চিহ্নিত করেন। পরীক্ষার পরবর্তী ধাপের জন্য গবেষকরা বেছে নেন মানব-শরীরে পাওয়া যায় এমন সক্রিয় ভাইরাল প্রোটিন স্ট্রাকচার Suppressyn (SUPYN)। এই নির্বাচনের পিছনে দু’টি কারণ রয়েছে। প্রথমত, Suppressyn মানবকোশের ASCT2 নামক প্রোটিন-আবদ্ধকারী অংশের সঙ্গে সহজেই জুড়ে যেতে পারে। মানব-কোশে যেসব অংশ রেট্রোভাইরাসের প্রোটিন গ্রহণে সক্ষম, তার মধ্যে ASCT2 সবচেয়ে কার্যকর। দ্বিতীয় কারণ হলো এই Suppressyn জাতীয় প্রোটিন স্ত্রী-দেহের গর্ভপত্র বা প্লাসেন্টায় (Placenta), এবং প্রায় প্রত্যেক মানবভ্রূণে পাওয়া যায়।
তারপর গবেষকরা প্লাসেন্টায় যে ধরনের কোশ পেয়েছেন, ঠিক সেরকম কোশ পরীক্ষাগারে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। তারা এই কোশগুলির মধ্যে RD114 নামক একধরনের রেট্রোভাইরাসের আক্রমণ ঘটান। দেখা যায় যে, প্লাসেন্টা কোশ ওই ভাইরাস-কর্তৃক আক্রান্ত। এরপর তারা নতুন এক সেট প্লাসেন্টা কোশ নিয়ে তার মধ্যে Suppressyn যোগ করেন। তারপর আবার RD114-এর আক্রমণ ঘটান। কিন্তু এবারে দেখা যায় যে, প্লাসেন্টা কোশগুলি ওই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছ। পরীক্ষার ফলাফল আরও নিশ্চিত করতে এইবার গবেষকরা বেছে নেন ভ্রূণের কিডনিকোশ, যা খুব সহজেই RD114 ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এরপর সেই কোশগুলির মধ্যে Suppressyn সংযুক্ত করা হয়। আবারও দেখা যায় যে, Suppressyn সংযোজিত কোশ RD114 ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
মানবদেহে ভাইরাল জিনোমের তাৎপর্য
গবেষকদের মত অনুযায়ী, আমাদের জিনোমে ভাইরাল প্রোটিনের এমন এক আধার সংরক্ষিত আছে, যা অন্যান্য রেট্রোভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। এককথায় বলা যায়, আমাদের শরীরে প্রাচীনকাল থেকে লুকিয়ে থাকা ভাইরাসের অংশাবশেষ আমাদের রোগ -প্রতিরোধে বড়সড় ভূমিকা নেয়। আণবিক জীববিজ্ঞান এবং জেনেটিক্সের অধ্যাপক তথা উক্ত গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক সেড্রিক ফেসকট (Cedric Feschotte) জানিয়েছেন যে, প্রাচীনকাল থেকে যে রেট্রোভাইরাসগুলি মানবশরীরে সংযোজিত হয়েছে, তারা ওই গোত্রের অন্য ভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে জঠরে বৃদ্ধিরত ভ্রুণকে রক্ষা করে। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে তাদের গবেষণা মানব-জিনোমে লুকিয়ে থাকা অন্যান্য ভাইরাসজাত প্রোটিনেরও অ্যান্টিভাইরাল কার্যকলাপ পরীক্ষা করবে। এই ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গবেষকদের আরও অনুসন্ধান প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে সংরক্ষিত অ্যান্টিভাইরাল প্রোটিনের একটি আধার উন্মোচন করতে পারে, যা আমাদের স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়াই চিকিৎসার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। উক্ত গবেষণার কাজ জিনোমবিদ্যায় বিজ্ঞানীদের ধোঁয়াশা কাটিয়ে জিনোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সম্ভাবনাকে নতুন করে উসকে দিয়েছে, যার ফলাফল চিকিৎসা-বিজ্ঞানেও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠবে। তাই আশা করাই যায় যে, এহেন গবেষণায় তৎপরতা আরও বাড়বে।