বাংলাদেশ|| রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র এখন নষ্টদের অধিকারে
শেখ হাসিনার সেই অনুমেয় প্রতিশোধস্পৃহার কারণেই কি প্রায় দুই দশক পেরিয়ে সাম্প্রতিক গত দশদিন ধরে দাউদাউ পুড়ছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ?
আপাত স্বাভাবিক দেখতে তরতাজা বয়সের কেউ যদি কখনও কোথাও বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে মাথা নুয়ে চলাচল করে, চারপাশের অনুভূতিপ্রবণ চোখ তখন উৎসুক হয়। তারা ভাবে, ব্যাঙ্গাত্মক হাসে অথবা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায় কুশল। আবার এমন কথাও জনপরিসরে বহুকাল ধরে প্রচলিত যে, একটা মিথ্যা বা ভুল বা অন্যায় যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে, কালক্রমে সেটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতে অভ্যস্ত হয় মানুষের মন। এই ধারণা বা অভিজ্ঞতার বস্তুগত একটা উপাদানের সাথে মানবজাতির পরিচয় ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে; পল জোসেফ গোয়েবলস ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নাৎসি জার্মানির তথ্যমন্ত্রী ছিল, ছিল ফ্যাসিস্ট হিটলারের প্রধান সহযোগী। সেই গোয়েবলসের বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ ইতিহাসে, গোয়েবলস বিখ্যাত এই পরিচয়েও যে, সে ছিল প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা বিশেষজ্ঞ। এই ধারণার স্বপক্ষে জলজ্যান্ত প্রমাণ, তারই ডিকটেশন দেওয়া লিখিত একটি ডায়েরি। যুক্তরাষ্ট্রের এক সরকারি কর্মকর্তা, লুইস লচনারের উদ্ধার করা সেই ডায়েরি পরে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়েছে লিওনার্দ ডব্লিও ডুব-এর হাতে। পৃথিবী জেনেছে গোয়েবলস এবং হিটলারের ‘প্রোপাগান্ডা নীতিসমূহ’র আদ্যোপান্ত। গোয়েবলসের উনিশটি এবং হিটলারের পাঁচটি মিলে সর্বমোট চব্বিশটি ‘প্রোপাগান্ডা পদ্ধতি’ পাঠ শেষে যে কোনও পাঠক এই উপলব্ধিতে পৌঁছে যাবেন অনায়াসে যে, ‘সত্য’ নামের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করা কতটা দুরূহ হয়ে ওঠে ‘মিথ্যা'র অবিরাম ঢক্কানিনাদে।
২০২৪ সালের চলমান এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল কথা খুব স্পষ্ট: সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের বর্তমান ব্যবস্থার সংস্কার। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ—পুরোনো এই বিধান বাতিল করে সরকার যে পরিপত্র ঘোষণা করেছিল , তাকে অবৈধ ঘোষণা করে এ বছর ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ রায় দেয়। পরের দিন, ৬ জুন, আদালতের এই রায় প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। রাষ্ট্রপক্ষ, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে ৯ জুন। ১০ জুলাই আপিল বিভাগ কোটা ইস্যুতে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা'র আদেশ দেয়। এরপর ৭ জুলাই সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের ছাত্রলিগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু করে। অন্যদিকে, কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে ১০ জুলাই হাইকোর্ট, সরকারের অনুকূলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাতেই, এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপক্ষের ‘পোষ্য দালাল’ হিসাবে জনমানসে আসন গেড়ে বসা বেসরকারি টেলিভিশন সংবাদ প্রতিষ্ঠান ‘একাত্তর টিভি'র প্রতিবেদকের শ্লেষাত্মক ও তোষামুদে প্রশ্নের উত্তরে ততোধিক শ্লেষ, বিদ্রূপ এবং আক্রমণাত্মক মুখাবয়বে যখন বলে ওঠে যে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না তো, রাজাকারারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে নাকি! ’ তখন এই ব্যঙ্গ দল-মত নির্বিশেষে অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীদের মনে বহুবছর থেকে ধারাবাহিক বেকারত্বের যাতনা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকারী সুপারিশ-চামচাগিরি-স্বজনপ্রীতিতে গড়ে ওঠা ‘দাহ’কে ঝলসে দিলে অগ্নিগর্ভ উচ্চারণ সমস্বর হয়ে বলে ওঠে, ‘তুমি কে আমি কে / রাজাকার রাজাকার /কে বলেছে কে বলেছে / স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ তারপরের ঘটনাসমূহ ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘ টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড' হয়ে প্রচারিত হচ্ছে; আর এদিকে, বাংলাদেশে এই মুহুর্তেও অবিরাম গণহত্যা, গুম , কারফিউ, ঘরে ঘরে রেইড- গ্রেফতার, ইন্টারনেট বন্ধ রেখে বাকী পৃথিবী থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীপরিষদ এবং বেশিরভাগ ভীত ও পোষ্য সংবাদমাধ্যম গোয়েবলসীয় ‘প্রপাগান্ডা নীতিসমূহ’ অনুসরণ করে চলেছে।
বাংলাদেশের চলমান দিনরাত পর্যবেক্ষণ করে এমন ধারণা গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, সম্ভবত শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতা খামচে ধরেছে তার সাইকোপ্যাথ হাতে, প্রায় ২৫০-এর বেশি নিরস্ত্র মানুষ, যাদের বেশিরভাগই তরুণ ও যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদেরকে প্রকাশ্যে ছাত্রলিগের সশস্ত্র কর্মী, পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনী এবং সামরিক বাহিনী রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, হাসপাতালে ঢুকে, আবাসিক এলাকার বাসা-বাড়িতে দরজা ভেঙে স্বজনের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরও হাসিনার মধ্যে সামান্যতম অনুতাপ, মায়া, কুন্ঠা-অপরাধবোধ প্রাত্যহিক জীবনাচরণে প্রকাশিত হতে দেখছে না কেউ। ইংরেজি শব্দ ‘ডিনায়াল’ (বাস্তবকে অস্বীকার করার সচেতন বিভ্রম)-এর মূর্ত রূপ হচ্ছে তার মুখাবয়ব, কণ্ঠনিঃসৃত স্বর ও তাবৎ কোরিওগ্রাফি। এই অসুস্থতার ভাইরাস কবে তার মস্তিষ্কে ঢুকল এবং দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে ছারখার করে দেয়ার বিধ্বংসী ক্ষমতা অর্জন করল?
প্রাসঙ্গিকভাবেই আমাদের এবার একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) অবিসংবাদিত নেতা ছিল। সাড়ে নয় মাস বাঙালি জাতি মরণপণ এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার পরে শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু, মাত্র তিন বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই সংসদীয় ব্যবস্থার মুখোশে সংবিধানে একের পর এক অগণতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক-জনস্বার্থবিরোধী সংশোধনী আনা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিকটাত্মীয়ের পদায়নসহ ভিন্নমত দমনে ‘রক্ষীবাহিনী’র হাতে নিপীড়ন-নির্যাতন-গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নানাবিধ জনরোষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে মুজিব খুন হওয়ার সময় শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিল বাংলাদেশের বাইরে থাকায়। কিন্তু, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কি শেখ হাসিনার মগজে গেঁথে দিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধস্পৃহা?
শেখ হাসিনার সেই অনুমেয় প্রতিশোধস্পৃহার কারণেই কি প্রায় দুই দশক পেরিয়ে সাম্প্রতিক গত দশদিন ধরে দাউদাউ পুড়ছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ? চলছে বিরামহীন হত্যা। অপহরণ। বাড়ছে নিখোঁজ তালিকা। আকাশে সামরিক হেলিকপ্টারের টহলদারি, বাতাসে কারফিউ , তারমধ্যেই ঘাপটি মেরে চুপ করে আছে ওরা, যারা গোয়েবলসীয় ‘প্রোপাগান্ডা নীতিসমূহ’ আউড়ে চলেছে; নবারুণ ভট্টাচার্য যাদেরকে চিহ্নিত করেন ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ প্রত্যাখ্যানে, ‘...যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী / প্রকাশ্যপথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না / আমি তাকে ঘৃণা করি-…!’ ওরা চায় না, কারণ ‘প্রোপাগান্ডা নীতিসমূহ'র বারোতম রূপরেখা: ‘স্টেটাস সম্পন্ন কর্তাব্যক্তি ও নেতাদের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা সহজে করা যায়।’ তাই কি বাংলাদেশে ‘জাতির বিবেক’-এই পরিচয়ে ইতিপূর্বে যারা খ্যাতিমান হয়েছিল, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ইত্যাদি বিশিষ্ট ও ‘স্টেটাস সম্পন্ন কর্তাব্যক্তি’গণ এখন অগণতান্ত্রিক শাসক ও দুঃশাসনের পক্ষে প্রপাগান্ডার প্রধান মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে চলছে?
আবার, ‘প্রোপাগান্ডা নীতিসমূহ'র চৌদ্দতম রূপরেখা হল, ‘প্রোপাগান্ডায় অবশ্যই বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ঘটনা, ইস্যু, প্রোগ্রাম ও জনগণকে বিশেষ স্লোগান ও বক্তব্য দিয়ে লেবেল দেয়া হবে।’ হিটলারের প্রোপাগান্ডার তৃতীয় নীতি: ‘কোনও যুক্তি বা বক্তব্যের শুধু একটি দিক প্রচার করো’ ও চতুর্থ নীতি : ‘বিরামহীনভাবে বিরোধী পক্ষের সমালোচনা চালিয়ে যাও’ এবং পঞ্চম নীতি : ‘বিশেষ ধরণের নিন্দা ও কুৎসা রটানোর জন্য একটি বিশেষ 'শত্রু' ঠিক করে নাও’। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বিশেষ ‘লেবেল’ দিয়ে জনসমর্থনপুষ্ট শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে ‘জামাত-শিবির-জঙ্গি-রাজাকার-বিএনপি’ নামে বিরামহীন সমালোচনা এবং নিন্দা-কুৎসার একটি ‘বিশেষ শত্রু’ হিসাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে, তখন গোয়েবলসীয় ও হিটলারীয় ষড়যন্ত্রের ‘নষ্টামি’র উৎকট মুখচ্ছবি বাংলাদেশের ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র (?) চাঁদমুখে ঝলমল করে উঠছে।
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি যেহেতু তার রাজনৈতিক সমাজ ও সংস্কৃতি বিকাশে সূচনালগ্ন থেকেই তারুণ্য এবং যৌবনের দীপ্তিতে রুচি ও স্পর্ধার বুক চিতানো ভঙিমায় হাঁটার অভ্যাস চর্চা করে এসেছে এবং এভাবেই বারবার তিমিরবিনাশি আলোর স্ফুলিঙ্গ ঝলসে তুলেছে, সুতরাং চলমান এই আন্দোলন তার অনিবার্য বিজয়কেতন ওড়ানোর আগে থেমে যাওয়ার অলীক দু:শ্চিন্তার পরিসীমার অনেক বাইরে এসে গুণগত দিক থেকে উৎকর্ষের দিকে এখন ধাবমান । ফরাসি বিপ্লবের এক বিপ্লবীর উদ্ধৃতি মনে পড়ে যাবে আমাদের: ‘বধিরকে শোনানোর জন্য কখনও কখনও উচ্চ শব্দের প্রয়োজন হয়।’ মুক্তিযুদ্ধের তিপ্পান্ন বছর পরের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র নষ্টামি করে করে এখন হুমায়ুন আজাদের ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’র মত কালোছায়ায় ঢাকা। সেই অন্ধকারে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, খুন হয়ে গুম হয়ে নিখোঁজ হয়ে, একটি উচ্চ শব্দে প্রকম্পিত করছে চারপাশ; ওরা জানিয়ে দিচ্ছে, ওরা অন্য এক প্রজন্ম। যারা ভয়হীন। যারা বাঁকা মেরুদন্ড ও নোয়ানো মাথার ‘বুড়োত্ব’ এবং ‘জড়ত্ব'কে পচা আবর্জনার মতো ভাগাড়ে ছুঁড়ে বুক টান টান করে দাঁড়ায় এবং বুঝিয়ে দেয়, মানবদেহে মেরুদন্ডের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে । যারা নষ্ট সময়, সমাজ, স্বদেশ ও পৃথিবীর চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, ‘ভয় নেই। একবার ঘুরে দাঁড়ালেই আর ভয় নেই। চোখে চোখ রেখে তাকালেই আর ভয় নেই।’
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
তথ্যসূত্র :
মিথ্যা প্রপাগান্ডার গোয়েবলসীয় ও হিটলারীয় নীতিসমূহ
(শাহাদাৎ তৈয়ব / মুক্তমত - BANGLA NEWS 24)