আনন্দধারা : পাঠকের বেআব্রু অনন্ত রক্তস্নান
Review of Anandadhara by Sadique Hossain : সাদিক প্রলুব্ধ করেন এই লেখার প্রেমে পড়তে বা আকর্ষণে। তারপর রূপোলি জালে পড়া পোকার মতোই ছটফট করেন পাঠক।
চারদিকে যখন বিষের হাওয়া বইছে, শিরদাঁড়া মাথার চুলের মতো পাতলা হয়ে খসে খসে পড়ছে, শিরদাঁড়াচূর্ণ প্রতি কেজিতে বিক্রি হবে নাকি ভরিতে- এই নিয়ে নীতি কমিটি বৈঠক ডাকবে ডাকবে করছে, বোমা এসে বাচ্চার গাল খাবলে নিচ্ছে, সেই মাংস পোড়া গন্ধ কি আতরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে যখন প্রায় ঘুম চলে আসছে- একজন সাহিত্যিক তখন কী করছেন? প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল, “একজন সাহিত্যিকের তখন কী করা উচিত?” কিন্তু ঔচিত্যবোধের পিছনে বাঁশ গুঁজে কবেই তা নামহীন চৌরাস্তায় টাঙানো হয়ে গেছে। উচিত বলে কিছু হয় না, সবটাই মাই রুল, সবটাই মাই চয়েস। সাহিত্যিক বলবেন, এই মুহূর্তে তাঁর চয়েস ঝিঙে আলুপোস্ত রঙের একটা বিকেলকে লিখে রাখা। অথবা এই মুহূর্তে তাঁর চয়েস প্রেমিকার আলতো বুকের পাশে প্রাক্তন ট্যাটু দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়া। ঈর্ষার বাহুতে, পশ্চাতে, নিম্নে একটু ম্যাজিক রিয়ালিজম, একটু সাররিয়ালিজম, একটু আনরিয়ালিজম মাখিয়ে প্রকাশকের হোয়াটস্যাপে ভাসিয়ে দেওয়া। অথবা... অথবা সাহিত্যিক চয়েসের নামে এমন অনেক কিছুই করতে পারেন। তবে, 'চয়েস'-এর গোড়ায় গিয়ে, এসব ফুল-মধু-চাঁদের ঘাড় ধরে কেউ কেউ গণকবরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, অথবা হাঁটিয়ে দেন ভাঙা আয়নার পথে। চয়েস সেখানে রক্তাক্ত হয়, একা হয়, নগ্ন হয়। তবেই নিজেকে চেনে। সাদিক সেই পথের মানুষ। সাদিক হোসেন কি গল্পকার? সাদিক কি সাহিত্যিক? সাদিক কি একজন বুদ্ধিজীবি? সাদিক হোসেন একজন সন্ধানী, ভিড়ে মিশে থাকা মানুষ। 'চয়েস'-এর নামে কোনও ভণ্ডামি তাঁর নেই। মান্দাস থেকে প্রকাশিত তাঁর আনন্দধারা বইটি আসলে একটি আয়না। দু'পিঠেই তার কাঁচ।
সাদিক নিজের লেখার একটি ঘরানা তৈরি করে ফেলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে যাদের 'নবীন' লেখক বলা যায়, সাদিক সেই গোষ্ঠীর হয়েও স্বতন্ত্র। এবং এই স্বাতন্ত্র্যেরও স্পষ্ট দুই দিক আছে, একটি তাঁর লেখার শৈলী এবং দ্বিতীয়টি তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। সাদিক নিজের কলমকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করিয়ে নিতে পারেন। বিভিন্ন লেখাতেই নিজেকে চরিত্র করে আনা, নিজেকেই ভাঙা, একই গল্পে নিজেকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ফের নিজেরই মুখোমুখি দাঁড় করানো! নিজের গল্পে সাদিক নিজে কখনও একক, কখনও আবার সমষ্টি। আর এই সিঙ্গুলার থেকে প্লুরাল হওয়ার পথে অথবা প্লুরাল থেকে সিঙ্গুলার- সাদিক বারেবারে সামাজিক পরিচয়কে ব্যবহার করেছেন এবং অত্যন্ত সচেতন হয়েই করেছেন। শুরুতেই যে প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল, সাহিত্যিক এক বিষাক্ত সময়ে দাঁড়িয়ে কী করবেন? কলম কি কোনওকালেই তরোয়ালের চেয়ে ধারালো? এই প্রশ্ন যদি কামড়ায়, তাহলে সেই পাঠকের অবশ্য কর্তব্য সাদিক হোসেনের আনন্দধারা বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা। এক ডজন গল্প রয়েছে বইটিতে। কিন্তু গল্প বললে বড়ই অন্যায় বিশ্লেষণ হয়। সাদিকের এই লেখাগুলি এক ছাল ছাড়ানো ঘা। যে ঘায়ে পট্টি বাঁধার সহস্র চেষ্টাই চলছে নানাবিধ উপায়ে, তবু ঘা সারছে না। ঘায়ের শিকড় চাড়িয়ে যাচ্ছে মাথায়, মেরুদণ্ডে, নাভিতে। অথচ আমরা ভাবছি- অল ইজ ওয়েল।
আরও পড়ুন- রক্ত-মাংস-কফ-শ্লেষ্মায় গড়া ফাঁপা সময়ের গল্প: যাহা বলিব সত্য বলিব
কাঁথা, আনন্দধারা, লাফিং ইন্ডিয়া, মুকুন্দদার পাইস হোটেল অথবা কাটারা যেভাবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নাগরিকে পরিণত হলো- গল্পগুলি পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। অস্বস্তির নৌকা থেকে পালাতে যখনই পাঠক লাফ দেবেন অন্য নৌকায়, পড়বেন এক অতলান্তিকে। তলিয়ে যেতে যেতে উঠে আসবে এই ভূখণ্ডের স্বপ্ন, উঠে আসবে একই দেশে জন্মে পৃথক আচরণ পাওয়ার গ্লানি, পাক দিয়ে উঠবে রাষ্ট্রের ধর্মাচারণ, ভেস্তে যাবে সমস্ত অভিজাত ইস্তেহার। এই অস্বস্তি যাতে না যায়, সাদিক তাঁর লেখায় তেমনটাই নিশ্চিত করেন। সাদিক প্রলুব্ধ করেন এই লেখার প্রেমে পড়তে বা আকর্ষণে। তারপর রুপোলি জালে পড়া পোকার মতোই ছটফট করেন পাঠক। তাঁকে গিলে খেতে আসে দৈত্যাকার এক থুতু!
“ক'বছর বিদেশ থেকে ফিরে এসে এলা গোলাপি হয়ে গিয়েছে। ফলে নাকের পাটায় ঘাম জমলে মনে হয় লুচির গায়ে রিফাইন অয়েল..." এইভাবে শুরু হয় কাঁথা গল্পটি। তারপর ঘুরে ফিরে আসে সিলেটের পাগলা মিঞা, ঘুরে ফিরে আসে কাঁথায় সুতোর পাক দিয়ে ফুটিয়ে তোলা লোকাচার। পাঠক যখন সদ্য সদ্য রাস্তা মাপতে চাইছেন, সাদিক হঠাৎ এমন নরম গালিচা পেতে দেন যে দিকভ্রষ্ট হতে প্রাণ চায়। যেন এবড়োখেবড়ো জমির উপর দুইখানি গোলাপগাছ, খানিক সেভাবেই যেন সাদিক লেখেন, “গোধূলি নামের কোনও ফুল নেই। ফুলের নাম কল্যাণীয়া হয় না কেন?” পাঠক যদি ভাবেন এমন এক লাইনের কাছে এসে একটু জিরিয়ে নেবেন, তাহলেই গলদ! পাতা উল্টোলেই সাদিক এক আশ্চর্য পথের বাঁক নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
আনন্দধারা বইটির দু'টি গল্প এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয়। লাফিং ইন্ডিয়া আর কাটারা যেভাবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নাগরিকে পরিণত হলো। গল্পের প্রেক্ষাপটে এসেছে ভারতের করোনাকালীন সময়। এসেছে ভারতের ২০১৪ পরবর্তী রাজনীতি, এসেছে সংখ্যালঘুদের চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া। লাফিং ইন্ডিয়া গল্পটি আমাদের ঘাড় ধরে নিয়ে যায় মোবাইলের স্ক্রিনের সামনে। ৩০ সেকেন্ডের রিল আর পরিযায়ী শ্রমিকদের হেঁটে চলাকে মিশিয়ে দেন সাদিক।
"লকডাউন সম্পর্কিত হাসির ভিডিও আপলোড করুন। প্রথম পাঁচ হাজার লাইক-এ কোনও টাকা নেই। তারপর প্রতি লাইক পিছু ১ টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকবে।"
বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না লেখক কোনও রাস্তায় হাঁটতে চলেছেন। পাঠকও হাঁটেন, হাঁটতে থাকেন, সেই হাঁটা কোনওদিনই পরিযায়ী শ্রমিকের হাঁটাকে ছুঁতেও পারে না, এত নিরাপদ গমন। অথচ শেষ প্রান্তে এসে পাঠক দেখেন গভীর খাদ! নিজের মূর্খামির উপর রাগ নয়, নিজেকে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করে, গণ আত্মহত্যার ইচ্ছা হয় অথচ গল্পের নাম লাফিং ইন্ডিয়া! মৃত্যুমুখী কী নির্মম হাসি! সাদিক এমন চরম অস্বস্তিতে পাঠককে রেখে ফাঁকা কলকাতায় মিষ্টি হাওয়া বইয়ে দেন। টেডিবিয়ারের চোখ দিয়ে কখনও কি দেশকে দেখেছেন পাঠক?
'কাটারা যেভাবে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নাগরিকে পরিণত হলো' গল্পটিতেও সাদিক লকডাউনের সময়টিকে লিখেছেন। এই লেখাটির গড়ন নিয়ে সাদিক যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তা অভাবনীয়। কোথায় নিজেকে রেখেছেন, কোথায় নিজেকে সরিয়ে আবারও নিজেকেই গুঁজে দিয়েছেন ধন্দে পড়ে যেতে হয়। রাষ্ট্র-শৃঙ্খলা-কবিগুরু-ডিসকভারি-মদনমিত্র-ফুকোর ককটেলে দাপিয়ে নেশা হয় পাঠকের। সাদিক লেখেন,
"এবার দৃশ্যটা ভাবুন-
পেছনে র্যাফ আর আমরা ভাইবোন দৌড়চ্ছি।
আরেকবার ভাবুন।
পেছনে র্যাফ আর আমরা ভাইবোন দৌড়চ্ছি।
দু-বার না ভাবলে দৃশ্যটা দেখতে পাবেন না।
ঠিক দু-বার ভাববার পর, এবার নিশ্চয় আপনারা কাটাদের দৌড় দেখতে পাচ্ছেন। মিঠুনের নাচ দেখতে পাচ্ছেন। বাপ্পির মিউজিক শুনতে পাচ্ছেন। নাড্ডা-গাড্ডা-চাড্ডা-হাড্ডার ডিস্কোলাইটে ইয়াব্বড়ো ব্যারিকেড ভাঙার জৌলুস দেখতে পাচ্ছেন?
এসব না দেখতে পেলে আপনি গল্পটা এখানেই পড়া থামিয়ে দিন। বাকি অংশ বোঝা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।"
ধর্মের ভাগে মানুষ ভাগ নিয়ে সাদিকের লেখা নতুন নয়। সাদিক সচেতনভাবে অধিকাংশ লেখাতেই গেরুয়া সরকারের এই প্রকট নীতিকে নিয়ে আসেন। পাঠকদেরও নিয়ে আসেন। সরকারের নীতি ও পাঠকদের বোধকে একই অভিজাত টেবিলে নৈশভোজে বসিয়ে দেন। সে খানা রোচেও না, সে খানা উগরানোও দায়। পাঠক, যে কিনা এই দেশের নাগরিকও, ভোটারও, সে খাবি খেতে থাকে। গলায় কাঁটার মতো বিঁধে যেতে থাকে ধর্মের পেরেক, আখলাখের ফ্রিজে রাখা মাংস দলা পাকিয়ে ওঠে গলার কাছে। পাঠক গিলতে পারে না। পাঠক আসিফার ছবি উগরে দিতে পারে না। কেবল গোঙাতে থাকে 'সারে জাহাঁসে আচ্ছা...’
আরও পড়ুন- ৫১বর্তী – বাঙালির হারানো ৫১ পদ : স্বাদের শিকড় সন্ধানে এক সফর
আনন্দধারা বইটির শিরোনাম গল্পটি সম্ভবত সাদিকের এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠ লেখা।
"ন-বছরের মেয়েটির মৃত্যু নিয়ে প্রথমে আমরা বিশেষ কিছু ভাবিনি। কারণ মেয়েটি আমাদের গোষ্ঠীর নয়। ওরা মেষপালক। কিন্তু কিছুদিন পর আমাদের টনক নড়ল। দেখা গেল, রাজপথে একটি বিজয় মিছিল বার করেছে ওরা। সরকারের তরফ থেকে একটা ময়ূরপঙ্খী রথ দেওয়া হয়েছে...”
নিজেকে কোথায় সমষ্টিবিচ্যুত করেন সাদিক, কোথায় একাত্ম হয়ে যান সকলের সঙ্গে, ধন্দ ফের কামড়ায় পাঠককে। "ওরা আমাদের বিভিন্ন জিনিসের নাম পাল্টে দিচ্ছিল... হয়তো যেতে চাইছিলাম এনায়েতনগর; পৌঁছে গেলাম স্বর্ণপুর।" সাদিক বিষাক্ত সময়ে আরোগ্যনিকেতনের খোয়াব দেখাতেই চাননি। এই বসবাসকালীন সময়েই বাঁচতে চেয়েছেন, পুড়তে চেয়েছেন আর, প্রশ্ন করতে চেয়েছেন। যে প্রশ্নের উত্তর তাঁর অবশ্যই জানা। তাহলে প্রশ্ন কীসের? মাঝেমাঝে জানা উত্তরের ওপারে আরেক অজানা গহিন থাকে। সাদিক, সাদিকের চরিত্ররা সেই গহিনে হাত ভরে দেন। হাত দিল্লি ছাড়িয়ে, উন্নাও হয়ে হাথরাস হয়ে, বাংলা হয়ে, আরবসাগর হয়ে ছুটে বেড়ায়। হাতে নাড়িভুঁড়ি লেগে যায়, ভাঙা বোতল লেগে যায়, আখলাখ, আসিফা, মোল্লাপাড়া, আলিনগর সব লেগে যায়। 'শিল্পসামগ্রী'-তে ভরে ওঠে দেশের তোরঙ্গ। সাদিক দেখেন, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। সাদিক সেই আনন্দধারায় নিজেও স্নান করেন। পাঠকদেরও স্নান করান। পাঠক রক্তে ভিজে ওঠে, ভেজা গায়ে সে উত্তর খোঁজে। বিষাক্ত সময়ে, একজন সাহিত্যিকের ঠিক কী লেখা উচিত?
আনন্দধারা
সাদিক হোসেন
প্রচ্ছদ– সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
বিনিময় – ২৭০/-