তিতুমীর : পরিচিতির বিষণ্ণতা, সময়হারা সংশয়
Titumir Drama Review : নাটকটি বহু মানুষ দেখলেন, হল উপচে পড়ল, এই ধরনের রাজনৈতিক নাটকের বাজার সাফল্যই এই কসাইখানায় সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত।
বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজনীতির ময়দানে একটা লব্জ বেশ চালু, তা হল- সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ভোট রাজনীতির লোকেরা সমাজের সমস্ত বর্গকে ভেঙে টুকরো করে। তারপর প্রতিটি বর্গের কাছে চাওয়া-পাওয়াগুলি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু দেখা যায়, ভোটতরণী বেয়ে এ আসে সে যায়, পিছিয়ে পড়া মানুষ কখনই আর এগিয়ে আসে না। এর কারণ শুধুই অর্থ নয়, পিছিয়ে পড়ার পরিচিতি সত্তাও। ভারত মানে তাবরেজকে পিটিয়ে মারা আর অগণিত দলিতের করোনা সংক্রমিত দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া পরম সত্য।
এই পরম সত্য বুঝেই শারজিল ইমাম মুসলিম ভাইদের এক হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। পরিণতি সবার জানা, দেশের অন্যতম মেধাবী মন জেল কুঠুরিতে পচছে। ধর্ষকও বাড়িতে ফোন করার সুযোগ পান। শারজিল ইমাম পান না। পরিচিতি সত্তার কারণেই৷ এমন পরিণতি হতে পারে, সেটা কি শারজিল বোঝেননি? আমার ধারণা, জেনে বুঝেই ডাক তিনি দিয়েছিলেন। যে পরিচিতির জন্য মাশুল দিতে হয়, অপর হতে হয়, তাকেই তিনি আঁকড়ে ধরে মরণকামড় দিতে চেয়েছিলেন। এই উথালপাতাল সময়ে হয়তো তাঁর খিদে পাচ্ছিল অন্য দিনের চেয়ে বেশি৷ চোখে ঘুম নেমে আসছিল। কিন্তু মানুষী সব অক্ষমতা দূরে সরিয়ে জেহাদের ডাক দেওয়া ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না। 'আমি অন্য কোথাও যাব না, এই দেশেতেই থাকব', বলার জায়গায় রাষ্ট্র তাঁকে রাখেনি।
একটি নাটকের মঞ্চায়নের সঙ্গে আপাত সম্পর্কহীন কিন্তু গভীরে প্রবল অন্তর্লীন এই কথাগুলি ভাবছিলাম জয়রাজ ভট্টাচার্য পরিচালিত তিতুমীর নাটকটি দেখে বেরিয়ে। উৎপল দত্ত-র লেখা নাটকটি আজ আদৌ প্রাসঙ্গিক? আমায় প্রশ্ন করেছিলেন অতি প্রিয়জন, তাঁকে উত্তর দিইনি, নিজের মনে এই উপরে লেখা কথাগুলি ভাবছিলাম স্রেফ। নাটকটিই ভাবাচ্ছিল।
তিতুমীর প্রযোজনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই এই, ইসলামফোবিয়ায় আক্রান্ত দেশে, বিলকিস বানুর ধর্ষকদের দেশে তা পরিচিতি সত্তার যুদ্ধ, সংশয়, বিপন্নতা, ক্লান্তি, মরণোন্মুখ যাত্রাকে তুলে ধরে। এই অসহায়তাকে এক ব্যাগ প্রিভিলেজ-সহ বোঝা সম্ভবই না। স্পষ্টভাবে বলছি, এই নাটক আজকের রাজনৈতিক আবহে মঞ্চস্থ করতে ধক লাগে। বারবার প্রযোজনা করতে ধক লাগে। জয়রাজ-অনির্বাণ-শ্রাবন্তী সহ এই নাটকের সমস্ত কলাকুশলীরা এই জুতোয় পা রেখেছেন, আরও একবার বুঝিয়ে দিয়েছেন পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল, সব ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তই আদতে রাজনৈতিক। এই সাহসকে সেলাম জানাই। নাটকটি বহু মানুষ দেখলেন, হল উপচে পড়ল, এই ধরনের রাজনৈতিক নাটকের বাজার সাফল্যই এই কসাইখানায় সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত।
উৎপল দত্তের প্রযোজনা আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু উৎপল দত্তের জীবনের অভিমুখ জানি বলেই মনে হয় তিনি নিশ্চয়ই শ্রেণিসংগ্রামের ধারণা থেকেই তিতুমীরকে ধরতে চেয়েছিলেন। ক্লাসিক পুনর্মঞ্চায়নের বিপজ্জনক দিকটাই এই। লোকে প্রতিতুলনা খোঁজে। গণস্মৃতির ভয়ে অভিনেতা তাই কপিবুক মেনে পা ফেলে। তাই আম দর্শক হিসেবে আমার কৌতূহল ছিল অনির্বাণ কোন পথে হাঁটেন তা দেখার। অনির্বাণ মেধাবী অভিনেতা। তিতুমীরকে সময়ের তাগিদে, নিজের বোধের তাড়নায় বিনির্মাণ করেছেন। মূল টেক্সট-সংলাপ থেকে সরেননি। শুধু মুসলমানির ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঠিক যে ভাবে একজন নিগ্রো নিজেকে নিগ্রো বলে বারবার।
একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৫৫ সালে আমেরিকার মন্টেগোমারি শহরের সিটি লাইসেন্সে বাস চলেছে। তখন মার্কিন বাসে আসন সংরক্ষিত থাকত শ্বেতাঙ্গদের জন্য। একটি নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে তিন শ্বেতাঙ্গ বাসে ওঠে। তাদের দেখে দুজন জায়গা ছেড়ে দেয়। এক কালো দরজির দোকানে কাজ করা মেয়ে বেঁকে বসে। বলে আমি উঠব না। আমি কালো বলে আমি টিকিটের সমান দাম দিয়ে যাব এটা হয় না। সাদারা বসলে আমাকেও বসতে দিতে হবে। মেয়েটির নাম রোজা পার্কস। তার কণ্ঠ সেদিন শক্তি দিয়েছিল মার্টিন লুথার কিং-কে। রাজপথে লাখো নিগ্রো নেমে এসে বলে আমি নিগ্রো, আমাকে বসতে দিতে হবে। এই তুকটাই ব্যবহার করেছেন অনির্বাণ। পরিচিতির ভারসাম্য তৈরি করেননি। বরং উচ্চারণে, আচরণে, চলায় বলার পরিচিতির দৃপ্ততা, পরিচিতির সংশয়, পরিচিতির ক্লান্তি, বিপন্নতা শরীরে আলাদা আলাদা ভাবে। শ্রেণির থেকেও অনেক বেশি তিনি পরিচয়ের প্রতিনিধি।
এই রাজনীতি তাঁর নিজের, উৎপল দত্তের সময়তটে এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা বামেরা অনুভব করেননি; কেন না তখনও বাবরি ভাঙা হয়নি, গোধরা হত্যাকাণ্ড হয়নি। গোমাংস ফ্রিজে রাখার জন্য মুসলমান মারা জলভাত হয়ে যায়নি। আমার যে পরিচিতির কারণে তুমি আমায় মারছ তাকেই আমি জয়ধ্বজা করব এ কথা বলার পরিস্থিতি হয়নি, ভারতরাষ্ট্রে সমদৃষ্টির একটা আবহ ছিল। অনির্বাণের বিমর্ষতায় ভারতাত্মার ক্ষয় ধরা পড়ে। গায়ে ভস্ম মেখে উঠে দাঁড়ায় মনুষ্যেতর তিতুমীর, যাকে ক্রনি ক্যাপিটালিজম/ ভাই- বেরাদারি পুঁজিবাদ তথা হিন্দু জমিদার ইংরেজ প্রভুর দিল্লাগি থেকে আদানি-মোদীর পৃষ্ঠকুণ্ডায়ন - এই ক্রোনোলজির উল্টোপিঠে দাঁড়াতেই হয় মরণজয়ী হয়ে অথবা মরণের তরে। অনির্বাণ এই সময়হারা চরিত্রটিকে নতুন আলো দিতে পেরেছেন।
আবার তিতুমীরকে আঁকতে গিয়ে যেন বারবার ফিরে গেছেন বাইবেলের বিষাদসিন্ধুতে। ক্রুশ বহনকালে যিশুর বিমর্ষতা, বিষপানের সময় হাসানের বিষন্নতার যে ছবিগুলি আমাদের মনে আঁকা সেই অদ্ভুত আঁধার তিতুমীরের চরিত্রে ঢেলে দিয়েছেন অনির্বাণ।
লক্ষ্যণীয় তিতুমীরকে শরিয়তি মুসলমানের যে ছবিটা চেনা সেই পোশাক পরানো হয়নি। পরানো হয়েছে তাহবন্দ পোশাক যা মারফতি ঘরাণার কাছাকাছি। নদিয়া জেলায় এখনও এমন তাহবন্দ পোশাক পরা ফকির দেখা যায়। অর্থাৎ সে অপরের অপর, ডবল মার্জিন, প্রান্তের প্রান্ত, হিন্দুর তো বটেই, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখেও সে কাফের হতে পারে যে কোনও সময়, তস্য গরিব, তিতু ফকির, স্রেফ আত্মা জানে তাঁর ইমানের কথা, জানে বিশ্বাসার্থীরা।
বাংলা নাটকে ছাঁচ ভাঙার কাজ কম হয়। হলেও তাতে জমক থাকে বেশি। তিতুমীর এখানেও অন্যতর, মঞ্চ জুড়ে যেহেতু বাঁশের কেল্লা, যেহেতু মঞ্চে অভিনেতাদের ব্রিদিং স্পেস থাকে না, নির্দেশক গোটা হলটিকেই মঞ্চ হিসেবে কাজে লাগান। গোটা প্রেক্ষাগৃহের নানা প্রান্ত থেকে দৃশ্যের জন্ম হয়। যখনই কেউ অনেক দূর গ্রাম থেকে আসে সে আর উইং দিয়ে মঞ্চে ঢোকে না। ঢোকে প্রেক্ষাগৃহের দোতলা থেকে ঝোলানো মই বেয়ে নেমে। একই সময়তলে মঞ্চে এবং প্রেক্ষাগৃহের নানা প্রান্তে অভিনয় চলে ফলে গোটাটা শুষে নিতে দর্শককেও পরীক্ষা দিতে হয়। অনবরত দর্শক নাট্যকারের মধ্যবর্তী দেওয়াল ভাঙে। রিচার্ড শেখনারের দলের থিয়েটার দেখে এসে বাদল সরকার লিখেছিলেন,
Not limited to finding out best ways to project the lines of the script. it was a process of confronting, exploring and assimilating the meaning of the whole play through every situation...
তিতুমীরের এই প্রযোজনা এই সত্যের অনুসারী। দর্শকও এই সত্যের অংশ হয়ে যায়।
এই নাটকে তিতুমীরের ভূমিকায় অনির্বাণের অভিনয় যদি শারজিল ইমামকে মনে পড়ায় তবে জঞ্জালীর চরিত্রে শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য বা রাবেয়ার চরিত্রে শ্রমণারা মনে করাবেন বিলকিস বানু, ইশরাদ শানা মাট্টুদের, মনে করাবেন শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাস কারণ রাবেয়ারাই লড়তে জানে, ধর্ষকাম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনেক বেশি লড়তে হয় ওদের।
নাটকটি নিয়ে একটা প্রশ্ন মনে থেকে যায়। গানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের গান অথবা মারফতি গান স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারতেন না পরিচালক?
জয়রাজ ভট্টাচার্যের প্রতিটি কাজই দেখেছি অতীতে। নাটকের ক্ষেত্রে তিতুমীরই ওঁর এ যাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে হয়। শুনেছি তিতুমীর আর একবারই মঞ্চে অভিনীত হবে। চাইব দর্শক এই ধনুকভাঙা পণ ভেঙে দিক। চাইব তিতুমীর কলকাতার বাইরে যাক।