ভাইরাস ছড়িয়ে ক্ষমতা দখল, বিশ্বের শাসকদের কেন দেখা উচিত এই সিনেমাটি?
এক অদূর ভবিষ্যতের পৃথিবী, যখন ইংল্যান্ড দুনিয়ার একচ্ছত্র পরাশক্তি। আর সেই ইংল্যান্ডের মসনদে বসে আছে একজন টোটালিটেরিয়ান ডিক্টেটর, অ্যাডাম সাটলার। নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে যে হরণ করে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, আর এই সুযোগে কুক্ষিগত করে নেয় আরও অধিক ক্ষমতা। যার অধীনে নিরাপত্তা-বাহিনীগুলো পরিণত হয়েছে নীতিহীন দাবার ঘুটিতে আর মিডিয়াগুলো একেকটি হয়ে উঠেছে প্রোপাগান্ডা মেশিন। মিথ্যার ঝুরি, মানুষের মনে অনবরত ভীতির সঞ্চার আর জাতিগত ঘৃণার বয়ান শোনানোই যাদের কাজ।
কারফিউ, সার্ভেইলেন্স, আর নিপীড়নের এই পুলিশি ইংল্যান্ডের এক রাতের কথা। বিটিএন টিভি চ্যানেলের কর্মচারি ইভি, কারফিউ রুল ভেঙে গোপনে নিজের বস গর্ডন ডিট্রিচের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আর তখনই রাস্তায় তার যাত্রাপথ রুখে দেয় সাটলারের সিক্রেট পুলিশবাহিনি ফিঙ্গারমেনের সিভিল ড্রেস-পরিহিত তিন সদস্য। তারা ইভিকে ধর্ষনে উদ্যত হলে এক মুখোশধারী, কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তির সেখানে আবির্ভাব ঘটে। ইভিকে সেই তিন ফিঙ্গারমেনের থেকে উদ্ধার করে মুখোশধারী ব্যক্তি নিজেকে এক নাটকীয় সংলাপের মাধ্যমে পরিচয় দেয় ‘ভি’ নামে।
ভি ফর ভেন্ডেটা, ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া এক ডিসটোপিয়ান রাজনৈতিক থ্রিলার। অরওয়েলিয়ান স্টোরিটেলিং ধাচের এই সিনেমাটি পরিচালনা করেন জেইমস মেকটিগ। চিত্রনাট্য রচনা করেন লানা এবং লিলি ওয়াচওস্কি। ইভি চরিত্রে দেখা যায় নাতালি পোর্টম্যানকে এবং ভি চরিত্রে অভিনয় করেন হিউগো উইভিং। সিনেমার শুরুতেই ১৬০৫ সালের ইংল্যান্ডের এক ঘটনা দেখানো হয়। গাই ফক্স নামে এক বিপ্লবী তৎকালীন শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সেখানের পার্লামেন্ট ভবনে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শাসকবাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। এই অপরাধে গাই ফক্সকে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। সেই দিনটি ছিল ৫ নভেম্বর।
আরও পড়ুন: ভারত মানে শুধুই দারিদ্র আর আবর্জনা? হলিউডে যেভাবে দেখা যায় আমাদের দেশ
সেন্ট মেরির ভাইরাস এবং ভি-এর পুনর্জন্ম
কুড়ি বছর আগে লারখিল নামের এক ডিটেনশন ক্যাম্পে নিরীহ মানুষদের বন্দি করে অত্যাচার করা হতো। সেই ক্যাম্পকে ঘিরে সাটলার নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে এক চক্রান্ত রচনা করে। সাটলার লারখিলে এক মারাত্মক ভাইরাস বানানোর গোপন ছক আঁটে। ভাইরাসটি সেন্ট মেরির ভাইরাস নামে পরিচিত এবং সেই ভাইরাসের প্রতিষেধকের ব্যবস্থাও তার সহচরদের দিয়ে সে তৈরি করিয়ে রাখে। ভাইরাস গবেষণার ট্রায়ালের জন্য ব্যবহার করা হতো নিরীহ বন্দিদের।
ভাইরাসটি ছড়িয়ে গেলে ১ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। আর এই সুযোগে সাটলার ভ্যাকসিন প্রদান করে অর্জন করে নেয় সিভিলিয়ানদের আশ্বাস। এবং এই চক্রান্তই তার ক্ষমতাকে আরও সুদৃঢ় করে। অ্যাডাম সাটলার পরিণত হয় এক টোটালিটেরিয়ান শাসকে। এক রাতে, লারখিল ডিটেনশন ক্যাম্পে বিস্ফোরণ হলে ক্যাম্পে থাকা অগ্নিদগ্ধ এক ব্যক্তিকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এই ব্যক্তিই পরবর্তীতে ফিরে আসেন সিনেমার প্রতিশোধপরায়ণ মূল চরিত্র ভি হয়ে।
ভি এবং ইভি-র সম্পর্ক
ইভি-র ছোট ভাই সেন্ট মেরির ভাইরাসের আক্রমণে মারা গেলে, ইভি-র বাবা-মা সাটলারের শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দু’জন অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে ওঠে। সাটলারের বাহিনী ইভির বাবা-মা কে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে এবং মেরে ফেলে। সিনেমায় ইভি চরিত্রটি মুখ্য দুই প্রোটাগোনিস্টের একজন। নাতালি পোর্টম্যানের অনবদ্য অভিনয় চরিত্রটিকে করে তুলেছে আরও বাস্তবিক। ইভি চরিত্রটি 'ভি ফর ভেন্ডেটা' সিনেমায় সমাজের সেইসব চরিত্রের প্রতীক, যারা অত্যাচারিত হয়েও নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় নানাবিধ ভয় এবং অভিনয়ের আড়ালে। যারা অপেক্ষা করে এক অবতারের আগমনের, অথচ নিজের ভেতরকার অবতারটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। ভি এখানে ইভি-কে সাহায্য করে তার ভেতরে থাকা সেই ঘুমন্ত অবতারকে জাগিয়ে তুলতে এবং সাটলারের বিরুদ্ধের একজন নির্ভীক সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে।
অন্য কিছু কথা
অ্যালান মুরের রচনা এবং ডেভিড লয়েডের ইলাস্ট্রেশনে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত কাল্ট ক্লাসিক কমিকস সিরিজ 'ভি ফর ভেন্ডেটা' থেকে সিনেমার প্লটটি নেওয়া। যদিও অ্যালান মুর পরবর্তীতে সিনেমাটির সমালোচনা করেন এবং মূল কমিকস সিরিজের সঙ্গে আদর্শিক পার্থক্য থাকায় সিনেমাটির সঙ্গে নিজের সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। অনেক সমালোচকের মতে, এই সিনেমায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম উসকে দেওয়ার মতো উপাদান আছে, যা তরুণদের ভেতর সহিংস মনোভাবের জন্ম দিতে পারে। এমনকী সাম্প্রতিক, ২০২০ সালে চিনের আভ্যন্তরীন সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্ট্রিমিং চ্যানেলগুলো থেকে সিনেমাটিকে সরিয়ে ফেলারও অভিযোগও উঠেছে।
২০১৯ সালে হংকং-এ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অনেককেই গাই ফক্স-এর মাস্ক পরে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বিকেন্দ্রীকরণ হ্যাকারগ্রুপ ‘অ্যানোনিমাস’-এর সদস্যরাও গাই ফক্সের মাস্কটি ব্যবহার করে থাকে।
তবে, সমালোচনার বাইরে যে দু'টি বিষয়ে এসে দ্বিমতের ব্যবধান কমে আসে, তা হচ্ছে সিনেমার প্রতিটি চরিত্রের অভিনয়-দক্ষতা এবং অনবদ্য সংলাপ।
সিনেমার শেষের দিকের এক দৃশ্যে, সাটলারের সিক্রেট পুলিশবাহিনীর হেড পিটার ক্রিডি ও তার সহযোগীরা ভি-এর শরীরে অনবরত গুলিবর্ষণ করে। তাতে ভি মারা না গেলে ক্রিডি বিস্মিত হয় এবং ভি-কে তার মারা না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করে। প্রত্যুত্তরে ভি বলে, 'এই মুখোশের নিচে যা আছে তা হচ্ছে একটি আইডিয়া, আর আইডিয়া হচ্ছে বুলেটপ্রুফ।' এমন আরও অসাধারণ সংলাপে সাজানো এই সিনেমাকে কেউ বলে ডিসটোপিয়ান থ্রিলার, কেউ বলে অ্যাকশন, কেউ বলে রাজনৈতিক, কেউ আবার বলে সুপারহিরো মুভি। কারও মতে সিনেমাটি একটি মাস্টারপিস, আবার কারও মতে সিনেমায় আছে হিংসা উসকে দেওয়ার মতো উপাদান।
ভিন্ন জনের ভিন্ন মত। তবে এটা অবশ্যই বলা যেতে পারে, 'ভি ভর ভেন্ডেটা' নিঃসন্দেহে বিগত দুই দশকের ভেতর মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলোর একটি।