মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়
Durgapuja 2022: নদিয়া জেলার বহু বনেদিবাড়ি যুগ যুগ ধরে শামিল হচ্ছে এই উৎসবে। আজ মায়ের বিদায়-লগ্নে ছুঁয়ে দেখা সেইসব ঐতিহ্যকে।
ওরে নবমী নিশি, না হইও রে অবসান।
শুনেছি দারুণ তুমি, না রাখ সতের মান।।
আজ আকাশে-বাতাসে রয়েছে বিষাদ আর মনখারাপের সু্র। আদুরে বেলার মতো কেটে যায় মায়ের আগমনের চারটি দিন। আলোর গতিবেগের চেয়েও বেগে ছুটে চলে এই সময়! মফসসলে যারা বড় হয়েছে, তাদের কাছে এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। যেমন, নদিয়া জেলার বহু বনেদিবাড়ি যুগ যুগ ধরে শামিল হচ্ছে এই উৎসবে। আজ মায়ের বিদায়-লগ্নে ছুঁয়ে দেখা সেইসব ঐতিহ্যকে।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি
চারদিকে এখন থিমপুজোর রমরমা। কিন্তু এর মধ্যেও অক্ষুন্ন রয়েছে রাজবাড়ির ঐতিহ্য ও সাবেকিয়ানা।রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরীর হোম চলে নবমী পর্যন্ত। এটাই প্রাচীন রীতি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির। প্রতিপদ থেকেই শুরু হয় রাজমাতার হোমকুণ্ড প্রজ্জ্বলন। রীতি অনুযায়ী মহালয়ার পর, প্রতিপদের দিন থেকেই কৃষ্ণনগরে রাজরাজেশ্বরীর হোমকুণ্ড জ্বলে ওঠে। প্রচুর পরিমাণে ঘি, বেলকাঠ-সহ নানা সরঞ্জাম দিয়ে যজ্ঞ শুরু হয়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর প্রতিষ্ঠিত এই পুজোর হোমের আগুন জ্বলে নবমী তিথি পর্যন্ত। উলটো রথের পরের দিন পাট পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণের কাজ। বর্তমান রানিমা অমৃতা রায় জানান, শুধু রাজপরিবারের মঙ্গল নয়, সমগ্র নদিয়াবাসীর মঙ্গলকামনায় এই হোমকুণ্ডলী জ্বালানো হয়। প্রচলিত দুর্গাপ্রতিমার থেকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরীর মূর্তি একেবারেই আলাদা। রাজপরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, এই মূর্তি তৈরি করতেন বিখ্যাত শিল্পী সাধন পাল। একচালায় ঘোড়ায় চেপে আগমন হয় রাজরাজেশ্বরীর, রাজমাতার সামনের দু'টি হাতই বড়। পিছনের আটটি হাত অপেক্ষাকৃত ছোট হয়। দেবীর গায়ে থাকে বর্ম। দেবী থাকেন একেবারে যুদ্ধের বেশে, রণংদেহি সাজে।
রাজার বাড়ির পুজো বলে কথা, সেখানে ভোগের আয়োজনও হয় এলাহি। খিচুড়ি, ভাজা, ছেঁচড়া-সহ একাধিক তরকারি, চাটনি, সুজি, পায়েস থাকে পুজোর ভোগে। সপ্তমীতে সাতরকমের ভাজা হয়। অষ্টমীতে পোলাও, ছানার ডালনার সঙ্গে ভাত, আটরকম ভাজা, মিষ্টি, ক্ষীর-সহ একাধিক পদ থাকে। নবমীতে নয়রকম ভাজা, তিনরকম মাছ, ভাত, মিষ্টি থাকে। দশমীতে গলা ভাত, সিঙি মাছ, খই, ফল, দই, চিঁড়ে ভোগ দেওয়া হয়। দশমী মানেই বিষাদ। সিঁদুরখেলায় মেতে ওঠেন রাজপরিবারের গৃহকর্ত্রী অমৃতা রায়-সহ অন্যান্য মহিলা সদস্যরা। বর্তমান রানিমায়ের উদ্যোগেই শুরু হয় এই সিঁদুরখেলা।
আরও পড়ুন: ‘মা’ ডাকে বলি, ডুবন্তকে দেবীর উদ্ধার, রহস্য-কথকতায় ভরা শীতলগ্রামের চৌধুরীদের দুর্গাপুজো
কৃষ্ণনগর রায়বাড়ি
কৃষ্ণনগরের অন্যতম প্রধান বনেদিবাড়ি রায়বাড়ি। রায়বাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্য। অনেকটা রাজবাড়ির আদলেই তৈরি রায়বাড়ির ঠাকুরদালান। এখানেও উলটো রথের দিন দেবীর পাটপুজোর মাধ্যমে বেজে ওঠে আগমনী সুর। দেবী এখানেও আসেন যোদ্ধার সাজে। বর্ম পরে, ঘোড়ায় চেপে রাজরাজেশ্বরী রণংদেহি হয়ে। কথিত আছে, রাজবাড়ি এবং রায়বাড়ির দুই মা-ই নাকি দুই বোন। যদিও এই সবই লোকমুখে প্রচলিত।
তিন ইঞ্চি দুর্গাবাড়ি
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে থিম পুজো, ঠাকুরের উচ্চতা নিয়ে কতই চিন্তাভাবনা করতে হয় উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বংশ পরম্পরায় কৃষ্ণনগরের নগেন্দ্রনগর সংলগ্ন এলাকার তিন ইঞ্চি দুর্গা বাড়িতে আজও পুজো হয়ে চলেছে তিন ইঞ্চি সাইজের দুর্গা। আজও তাঁরা সাবেক রীতি মেনেই পুজো করে আসছেন মায়ের। বছরের এই সময় বাইরে থেকে বাড়ির সকল সদস্যরা উপস্থিত হন।
নীল দুর্গাবাড়ি
কৃষ্ণনগরের নাজিরাপাড়া চট্টোপাধ্যায় বাড়ির এই পুজো প্রায় ২৯০ বছরের পুরনো। আসলে স্বাধীনতার আগে, দেশভাগের আগেও ওপার বাংলাতে এই পুজো শুরু হয়। তবে দেশভাগের পর ১৯৪৭ থেকে কৃষ্ণনগরের নাজিরাপাড়াতেই শুরু হয় পুজো। এখানে দেবীর গায়ের রং নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একাধিক কাহিনি। যদিও মার্কণ্ডেয় পুরাণেও নীল দুর্গার কথা পাওয়া যায়।
মায়ের গায়ের রং বদলে যাওয়ার পিছনে কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, এটি মৃৎশিল্পীর একটি ভুল। রাত জেগে কাজ করতে গিয়ে নাকি বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী ভুল করে দুর্গা প্রতিমাকে অপরাজিতা রঙে রাঙিয়ে ফেলেন। এদিকে রাত পোহালেই পুজো। হাতে সময়ও নেই নতুন করে রং করার। সকাল হতেই নাকি পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা প্রতিমা দেখতে এসে অবাক! কথিত রয়েছে, সবকিছু শুনে তাঁরা শিল্পীর পাশে দাঁড়ান। চট্টোপাধ্যায় বাড়ির এক বয়স্ক সদস্য জানান, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এমন একটা কিছু হবে। কারণ, রাতেই দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন, চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারে তিনি অপরাজিতা রূপেই পূজিত হবেন। সেই শুরু। তারপর থেকে মৃৎশিল্পীর ভুলই হয়ে উঠল ঐতিহ্য। আজও কৃষ্ণনগর নাজিরাপাড়ায় পুজো করা হয় দেবী নীলা রূপেই।
এই প্রতিমারও বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। শাক্ত মতে এই পুজোয় প্রথমে মোষ বলি দেওয়া হতো। পরে শুরু হয় পাঁঠাবলির প্রথা। এখন অবশ্য আর বলি হয় না। সন্ধিপুজোর আগে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল দিয়ে পুজো করা হয় দেবীকে। দুর্গার ভোগেও আছে নানা বৈচিত্র। মহাপ্রসাদের পাশাপাশি পোলাও, মাছ, পাঁচরকম ভাজা, তিনরকম সবজি থাকে মায়ের ভোগে।নবমী বিষাদের সুর বয়ে আনলেও এই বাড়িতে নবমী একটু অন্যরকম। এখানে নবমীর দিন হয় শত্রুনিধন পর্ব। আতপচালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় ‘নর’ অবয়ব। তাকে লাল শালুতে মুড়ে পরিবারের বয়োঃজ্যেষ্ঠ সদস্য খাঁড়া দিয়ে বলি দেন। একচালা প্রতিমার ধরনেও রয়েছে বৈচিত্র। উলটোদিকে অর্থাৎ বাম দিকে থাকেন সরস্বতী, গণেশ এবং ডান দিকে থাকেন লক্ষ্মী ও কার্তিক। এবং গণেশকে শুভ্র বর্ণে সাজানো হয়।