সমপ্রেমের আলোয় রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা'-কে নতুন করে দেখেছিলেন ঋতুপর্ণ

ঋতুপর্ণ ঘোষের 'চিত্রাঙ্গদা' রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা'-র শরীরে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে। 'চিত্রাঙ্গদা' হয়ে ওঠে একটি ইচ্ছের গল্প।


মনের চোখ দিয়ে যা আমরা দেখি, আর চামড়ার চোখ যা বুঝি, তাতে একথা বলাই যায়, আমাদের মনখারাপ কিংবা আনন্দ, যে-কোনও অভিব্যক্তির পাশে এসে চুপ করে দাঁড়ান রবি ঠাকুর। আমরা নির্ভরশীল তাঁর ওপর। ভাগ্যিস রবিঠাকুরের কোনও রবীন্দ্রনাথ ছিল না, তাই তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন। তাঁর মতো করে শিকড়ে পৌঁছে তাঁকে বোঝার সাধ্য বোধহয় আগামী কিছু জন্মেও লাভ করতে পারব না আমরা। তবে তাঁকে বুঝতে পেরেছিলেন নিজের আঙ্গিকে আরও একজন, তিনি ঋতুপর্ণ ঘোষ। নিজের যাপন আর রবীন্দ্রনাথের কলমের রহস্যকে তিনি দিয়েছিলেন মিলিয়ে।

মহাভারতে অর্জুনের স্ত্রী-দের মধ্যে একজন ছিলেন চিত্রাঙ্গদা। মণিপুর রাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে, তার বংশে কেবল পুত্রসন্তানই জন্মগ্রহণ করবে। কিন্তু রাজকুলে কন্যাসন্তান চিত্রাঙ্গদার জন্ম হলেও, রাজা তাকে সমস্তরকম অস্ত্র বিদ্যা ও রণকৌশলের শিক্ষা দিয়ে পুত্রের মতোই বড় করেছিলেন। অন্যদিকে, ব্রহ্মচর্য ব্রত গ্রহণ করে অর্জুন যখন মণিপুরে এসে উপস্থিত হলেন, তখন চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে উভয়ের মধ্যে প্রণয়ের জন্ম হয়। মহাভারতের এই কাহিনিকে প্রেক্ষাপটে রেখে ১৮৯২ সালে রবি ঠাকুর রচনা করলেন নৃত্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা'। নতুনভাবে জন্মলাভ করল মণিপুরের রাজেন্দ্রনন্দিনী। এখানে সে মণিপুরের একমাত্র উত্তরাধিকারী, রাজ্যের রক্ষক। আবার অর্জুন-দর্শনের পরে প্রণয়ে বিগলিত এক সাধারণ মেয়ে। অর্জুনের ভালবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে সুরূপা করে তুলতে ছুটে গেছে সে মদন দেবের কাছে।

অন্যদিকে, ঋতুপর্ণ ঘোষের 'চিত্রাঙ্গদা' রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা'-র শরীরে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে। 'চিত্রাঙ্গদা' হয়ে ওঠে একটি ইচ্ছের গল্প। এখানে ঋতুপর্ণ চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের হুবহু চলচ্চিত্র রূপ তো দেনইনি, বরং বর্তমান সমাজজীবন ও মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে কেবল ইচ্ছের আলোটুকু ফেলেছেন। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রে চিত্রাঙ্গদার ছায়াচরিত্র হিসেবে পাওয়া যায় রুদ্র নামের একটি চরিত্রকে, যে ভূমিকায় ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজে। আর অর্জুন এখানে পার্থ, অভিনয়ে যিশু সেনগুপ্ত। রুদ্র মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত যে, শিল্পের আত্তীকরণের জন্যে লিঙ্গের প্রয়োজন হয় না, তাই সে নাচকে অন্তর দিয়ে ভালবেসেছে। রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা'-য় চিত্রাঙ্গদা কন্যা হলেও বেড়ে উঠেছে একজন পুরুষের চালচলনে, ঠিক তেমনই এই এই ছবিতে রুদ্র জন্মগতভাবে পুরুষ হলেও অন্তরাত্মায় সে একজন নারী। সে তার নাচের দলের ডিরেক্টর আর সেই নাচের দলেই পার্কার্সনিস্ট হিসেবে ঘটে পার্থের আবির্ভাব। অর্জুন যেমন মুগ্ধ হয়েছিল চিত্রাঙ্গদার যুদ্ধবিদ্যা দেখে, এই সিনেমায় পার্থও রুদ্রের নৃত্যশৈলীতে মুগ্ধ হয়েছে। এই ছবিতে ঋতুপর্ণ, একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নশীল সমাজে থেকেও এখনও মানসিতার দিক থেকে যে পিছিয়ে রয়েছি, সেই পিছিয়ে থাকার কাঁটাকে তুলে ফেলার প্রয়াস দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুন: কীভাবে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে তৈরি হলো গোটা রামায়ণ, কথাবার্তায় স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদায় শিবের বর দেওয়ার প্রসঙ্গ পাওয়া যায় যা ঋতুপর্ণ ঘোষের 'চিত্রাঙ্গদা'-য় নেই। ঋতুপর্ণের চিত্রাঙ্গদা অনেকটা বাস্তব প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা'-য় চিত্রাঙ্গদা কুরূপা থেকে সুরূপাতে রূপান্তরিত হতে চেয়েছিল যাতে অর্জুন তাকে গ্রহণ করে। কিন্তু ঋতুপর্ণ তাঁর ছবিতে রূপান্তরের কারণ হিসেবে দেখালেন সামাজিক ও আইনি বাধাকে। চিত্রাঙ্গদা যে-সময় ঋতুপর্ণ তৈরি করেন, তখনও আইনের চোখে সমকামিতা অপরাধ ছিল। ছবিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল রুদ্রের নৃত্যশৈলীতে পারদর্শিতা। সে একজন বিখ্যাত কোরিওগ্রাফার, যার কাজ দেশে-বিদেশে আলোচিত ও প্রশংসিত। এই রুদ্র তার পরিচালিত 'চিত্রাঙ্গদা' নৃত্যনাট্যে মদনদেবকে দেখিয়েছেন একজন কসমেটিক সার্জন হিসেবে, যে রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে সুরূপার রূপ দান করছে; এখানে খুব সাবধানেই যেন রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা'-র নবনির্মাণ করেছেন পরিচালক।

Chitrangada-The-Crowning-Wish-

ছবির একটি দৃশ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ ও কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সমপ্রেম- শব্দটাই এত তীব্র যে, তার আলোকে গ্রহণ করতে সময় লাগে দীর্ঘ। সমকামিতা এই সমাজের কাছে এমন একটা বিষয় এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের 'চিত্রাঙ্গদা'-তে তা যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাকে সহ্য করার শক্তি এই সমাজের খুব কমই ছিল এবং বর্তমানেও আছে। আগেও উল্লেখ করেছি যে, তিনি যে সময় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন তখন আইনের চোখে সমকাম ,সমপ্রেম দুটোই ছিল অন্যায়ের। বর্তমানে আইনের শেকল ভেঙে গেলেও সমাজের বাঁকা চোখের থেকে মুক্তি মেলেনি। সমকাম নিয়ে করা এই চলচ্চিত্রকে বিভিন্ন দোষে দুষ্ট অনেকেই বলেছেন, কিন্তু একে 'অশ্লীল', 'কুরুচিকর' বললেও এই ছবিকে তাঁরা কোনওভাবে অস্বীকার করতে পারেননি, এবং পারবেনও না আশা করা যায়! মেনে নেওয়া ও মনে নেওয়া ব্যাপার দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ,একটা করতে হয় বলে করা, অন্যটা ইচ্ছে। ঋতুপর্ণ 'Memories in March', 'আরেকটি প্রেমের গল্প' এবং তাঁর নিজের পরিচালিত 'চিত্রাঙ্গদা'- এই তিনটি ছবিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এতদিনের বন্ধ থাকা গোপন সমস্ত দরজা খুলে দিলেন,চারিদিক থেকে এল আলো। 'চিত্রাঙ্গদা'-কে কোনও কোনও দিক থেকে তাই মনে হতেও পারে তাঁর আত্মজৈবনিক প্রকাশনা। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে নিজেকেই প্রকাশ করেন, তাই ঋতুপর্ণও হয়তো এখানে নিজেকেই এঁকেছিলেন!

Revisiting Chitrangada

'চিত্রাঙ্গদা'-র নবনির্মাণ ঘটিয়েছেন ঋতুপর্ণ

 

রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা' পড়া হয়েছে, দেখা হয়েছে, শোনাও হয়েছে- কিন্তু ঋতুপর্ণের মতো করে ভাবা হয়নি। কুরূপা আর সুরূপা একই দেহে অবস্থিত, এই বিপরীত সত্তার সংঘাতের মধ্য দিয়েই এগিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। আর ঋতুপর্ণ এই রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে পাথেয় করেই এক সত্তা থেকে আরেক সত্তায় উত্তরণ ঘটালেন। 'চিত্রাঙ্গদা'-কে গড়ে তুললেন একটি 'ইচ্ছের গল্প', 'Chitrangada,The Crowning Wish'।

 

 

More Articles