স্নায়ুযুদ্ধে ডাক্তারদের কাছে জিতে গেলেন মমতা?
CM Mamata Banerjee: পদত্যাগ করতে রাজি আছি।’ — রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, এই বাক্যেটি আসলে বহুকৌণিক। একদিকে থেকে বোঝা যায়, তিনি নিঃস্বার্থ এবং সমস্যা সমাধানে ব্রতী।
তেরো বছর রাজ্য শাসন করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কখনও তাঁকে এমন কথা বলতে শোনা যায়নি। বেনজির কথা বলে বসলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃতীয়বার যখন আরজি কর কাণ্ডে অবস্থানরত চিকিৎসকদের বৈঠকের সম্ভাবনা ব্যর্থ হল, তখন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন করে কথায় কথায় বলে ফেললেন, পদত্যাগ করতে রাজি আছি। রাজনৈতিক মহলে শোরগোল। তেরো বছরে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রীকে কেন এ কথা বলতে হল? সত্যিই কি তিনি এমন কোনও সিদ্ধান্তের কথা ভাবছেন? নাকি স্নায়ুর লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে একটা নতুন চাল দিলেন দক্ষ কূটনীতিবিদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
- আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত সমস্ত দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করা, অপরাধের উদ্দেশ্য সামনে আনা এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ।
- তথ্যপ্রমাণ লোপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচার।
- সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে ‘ব্যর্থ প্রমাণিত’ কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলের ইস্তফা।
- রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
- রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়া এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সুনিশ্চিত করা।
- স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা, স্বাস্থ্য আধিকারিকের পদত্যাগ।
— সুপ্রিম কোর্ট মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা অবধি সময় দিলেও এই ছ'টা দাবি নিয়ে অবস্থানে অনড় ছিলেন আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারেরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছেন, তিনি ইমারজেন্সি চান না। কোনও রকম দমন-পীড়ন করতে চান না। এদিনও বলেন, তিনি আন্দোলন থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু এই কথার ফাঁকেই তিনি কেন বলছেন পদত্যাগের কথা? চিকিৎসকদের এই ছ'টা দাবির মধ্যে কি পদত্যাগের কথা ছিল? তার মানে এই কথার মধ্যে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি তাঁর রাম-বাম তত্ত্বেই অনড় রইলেন। অতীতেও দেখা গিয়েছে, যখন ভাঙচুর হয়েছে, মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় বলেছেন রাম-বাম। এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাকে অনেক অসম্মান করা হয়েছে। সমাজমাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ওরা বিচার চায় না, চেয়ার চায়। আমি মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে পারি।’’
আরও পড়ুন: ক্ষমা চাইলেন মমতা, আরও একবার ফিরে যাচ্ছেন চিকিৎসকেরা
‘পদত্যাগ করতে রাজি আছি।’ — রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, এই বাক্যটি আসলে বহুকৌণিক। একদিকে থেকে বোঝা যায়, তিনি নিঃস্বার্থ এবং সমস্যা সমাধানে ব্রতী। এর সঙ্গে কৌশলে তিনি জুড়ে দেন চিকিৎসা সঙ্কটের কথা। তাঁকে বলতে শোনা যায়, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের কারণে এখন পর্যন্ত ২৭ জন মারা গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে।’’ কার্যত বলটা এদিন তিনি চিকিৎসকদের কোর্টে ঠেলে দিলেন। খুব সহজেই ডাক্তারদের সঙ্গে জনতার ভুল বোঝাবুঝির একটা রাস্তা প্রশস্ত করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার মানুষের কাছে এদিন ক্ষমাও চেয়েছেন মমতা। তার মানে কি স্নায়ুযুদ্ধে এগিয়ে থাকতে খুব বুঝেশুনে পরিকল্পিতভাবেই এ কথা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? এ কি শুধু স্নায়ুর লড়াই? ডাক্তারদের এক গোল দিয়ে এগিয়ে থাকতেই এই অমোঘ বক্তব্য রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল ঘটনার বিচারে তিনি ডাক্তারদের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল, 'ওরা বিচার চায় না' মন্তব্য করে সেটাই কি তুলে ধরতে চাইলেন মমতা?
প্রসঙ্গত, এদিন নিজেরাই ব্যবস্থা করে আরজি করের জুনিয়র ডাক্তারেরা নবান্নে পৌঁছন। মুখ্যমন্ত্রী আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন, কোনওরকম শর্ত তিনি মানবেন না। গণতান্ত্রিকভাবে যে সরকার নির্বাচিত হয়েছে, তার সঙ্গে বসে আলোচনা করতে হবে শর্তশূন্য ভাবে। কিন্তু ডাক্তাররা অন্যান্য বিষয়ে নমনীয় হলেও লাইভ সম্প্রচারের বিষয়ে অনড় ছিলেন। শেষ মুহূর্তে মুখ্যসচিব জানিয়ে দেন, লাইভ সম্প্রচার সম্ভব নয়। ভিডিও রেকর্ড করে পরে ছাড়া যেতে পারে। চিকিৎসকেরা তাতে রাজি হয়নি। কার্যত তাতে মুখোমুখি আলোচনার জায়গাটা মাঠে মারা যায়। এইরকম পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন। এক্ষেত্রে যে প্রশ্ন ওঠে, চিকিৎসকেরা সংবাদ মাধ্যমের কাছে নিজেদের বার্তা দিতে পারেন, এমন সম্ভাবনা তৈরির আগেই মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সুযোগটা ব্যবহার করলেন। প্রশাসক মমতার এটাও কি একটা অমোঘ চাল নয়?
এই সমস্যার সমাধান কী? কোন পথে এর মোকাবিলা সম্ভব— এখন গোটা বাংলা তাকিয়ে থাকবে সেই দিকেই। আমাদের রাজ্যের জন্য সাংবিধানিক সঙ্কট অপেক্ষা করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তাঁর উত্তরসূরি হবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়? তাহলে তো সেই বিশেষ আসনে ছ'মাসের মধ্যে আবার নির্বাচন হবে? সেক্ষেত্রে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে অভিষেককে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ-মন্তব্য বহুকৌণিক, বহুমাত্রিক প্রশ্ন তুলে দিল।
আরও পড়ুন:পদত্যাগে রাজি আছি, কেন এ কথা বললেন মমতা?
চেয়ারের কথা বলে মমতা এদিন বুঝিয়ে দিলেন, বাইরের কোনও শক্তি মদত জোগাচ্ছে ডাক্তারদের। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বিঘ্নিত করে স্থিতবস্থা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। এ কথা সত্যি বরিষ্ঠ ডাক্তারদের একটি অংশের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এমনকী শহরের একজন নামকরা চিকিৎসক বিজেপির সঙ্গে টিকিট নিয়ে সমঝোতাও করতে চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারেরা কি সেই প্রভাবে আদৌ প্রভাবিত? একাধিক বিজেপি ঘনিষ্ঠ নেতা-নেত্রীকে ফিরিয়েছেন তাঁরা। তবে কি স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগকে হাতিয়ার করে পদত্যাগ মন্তব্যে সেই জায়গাটাই উস্কে দিতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একটি মন্তব্য করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি ওদের ক্ষমা করলাম। আর এ কথা বলে কার্যত তিনি নিজের উদারতাকেই মানুষের সামনে পৌঁছে দিতে চাইলেন আরও একবার সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করে।