আর জি কর কাণ্ড উপলক্ষ্য মাত্র, ক্ষোভের বারুদ জমতে দেখেও দেখেনি শাসক দল

RG Kar Doctor Rape and Murder case : প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবার মানুষ উগড়ে দিয়েছেন ,সেই ক্ষোভের আগুন এখনও জ্বলছে। এটি এত সহজে নিভে যাওয়ার নয়।

এ কথা স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অস্বীকার করতে পারবেন না যে, তিনি তাঁর শাসনকালে এই ধরনের গণবিক্ষোভের সম্মুখীন হবেন এটি স্বপ্নেও ভাবেননি। ২০০৮ সালের নভেম্বরে নন্দীগ্রামের গণহত্যার পর কলকাতা শহর যে নাগরিক মিছিল দেখেছিল, তার পরে এই প্রথম রাজ্য জুড়ে (এবং বাইরেও) এমন স্বতস্ফূর্ত গণ জমায়েত ও মিছিল দেখা গেল ২০২৪ সালের ১৪ অগাস্ট।

হ্যাঁ ক্ষোভের কারণ অবশ্যই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে এক তরুণী ডাক্তারের ভয়ঙ্কর ভাবে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা। দিকে দিকে জনগণ এই ঘটনার বিচার চাইছেন। কিন্তু এই ক্ষোভের একমাত্র কারণ এই ঘটনাটি নয়।

শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের সরকার ভাবছে যে আর জি করের ঘটনার কিনারা হয়ে গেলেই এই বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাবে। অথবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবছেন যে, ধর্ষণ ও হত্যার মামলায় দোযীরা সাজা পেলেই এই ক্ষোভ কমে যাবে। রাজ্য়ের শাসক দলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবছেন ধর্ষককে গুলি করে মেরে দিলেই জনগণের ক্ষোভের উপশম হবে।

ব্যাপারটি একটি সরলরেখায় দেখা ভুল হবে।

এই ঘটনার সঙ্গে মূল তিনটি বিষয় জড়িত। এক, এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত, কাউকে রেয়াত না করে দোষীদের গ্রেফতার, বিচার ও সাজা। দুই, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার ও কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা। তিন, পুলিশ ও প্রশাসনের উপর সাধারণ জনগণের আস্থা।

তিনটি বিষয় সামলাতেই সরকার চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, তদন্ত পুরোদমে চললেও, যে ভাবে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষকে তদন্ত থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে এবং যখন একাধিক ব্যক্তির জড়িত থাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে (পরে খোদ মুখ্যমন্ত্রী এই সন্দেহ প্রকট করেছেন তাঁর নিজের বক্তব্যেই), প্রমাণ লোপাটের সম্ভাবনা জোরাল হচ্ছে, তখন কলকাতা পুলিশের দক্ষ অফিসারদের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে। অভিযোগ দানা বেঁধেছে যে নিরপেক্ষ তদন্ত না করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই তদন্ত করছেন তাঁরা।

যে ভাবে কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল প্রথম ধৃত সঞ্জয়ের 'সিভিক ভলান্টিয়ার' পরিচয়কে সামনে রাখতে অস্বীকার করেছেন, তাতে সন্দেহ আরও দানা বেঁধেছে যে সত্যিকারের তদন্ত করে বিচার করা হবে কিনা।

পুলিশ ও প্রশাসন ভেবে নিয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র মৃতার পরিবারকেই এই তদন্তের ব্যাপারে জানালেই তাদের কাজ শেষ। কিন্তু রাজ্যের মানুষও এই তদন্তের গতিপ্রকৃতি না জানতে পেরে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। ফলে অপতথ্যের ছড়াছড়ি দেখা গেছে।

এখনও পর্যন্ত তাঁরা জানতেই পারলেন না যে এই ধর্ষণ ও হত্যার পিছনে আসল উদ্দেশ্যটি কী! একটি সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়ম বহির্ভূত ভাবে একটি সরকারি হাসপাতালের একটি সেমিনার রুমে ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে গেলেন এবং খুঁজে পেতে সেই সেমিনার রুমে একজন মহিলা ডাক্তারকে দেখে তার যৌন বিকৃত মনকে শান্ত করলেন! ব্যাপারটি এতটাই সরল?

দ্বিতীয়ত, একটি সরকারি হাসপাতালের সুরক্ষা নিয়ে সরকার এতটা উদাসীন কী করে হতে পারে! এই বীভৎস ঘটনাটি ঘটে যাবার পরেও, সরকার নামমাত্র কয়েকজন আধিকারিককে সরিয়ে দিয়ে দায় সেরে ফেলল, কিন্তু যিনি সেই প্রতিষ্ঠানের কর্তা সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ন্যূনতম কারণ দর্শানোর নোটিশও দিল না। বরং গণমাধ্যমের চাপে সেই অধ্যক্ষ সরকারি কাজ থেকেই ইস্তফা দেওয়ার কথা বললেও, তাঁকে অন্য একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাল। একটি প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার ও জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তা দিতে যিনি ব্যর্থ হলেন, তাঁকে সমপদমর্যাদার দায়িত্ব দিয়ে অন্য একটি মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দিয়ে কোনও চিকিৎসক বা হাসপাতালের কর্মীদের আস্থা অর্জন করতে পারে এই সরকার!

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল সাধারণ জনমানসে এই পুলিশ ও প্রশাসনের উপর থেকে আস্থা চলে যাওয়া। পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনীর গণধর্ষণের ঘটনার পরে যে অমানবিক মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা গিয়েছিল, এবারে কিন্তু তাঁর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সংযত ও সংবেদনশীল ছিল। কিন্তু তবুও তদন্তে কাউকে আড়াল করার অভিযোগ, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া এবং তিনি প্রভাবশালী বলে সন্দেহ তৈরি হওয়া — এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এই ঘটনার তদন্তে স্বচ্ছতার অভাব প্রকট হয়ে উঠছিল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছে ঠিকই। কিন্তু সরকার হয়ত বুঝতে পারছে না যে আর জি কর একটি উপলক্ষ্য মাত্র। আর জি করের ঘটনাক্রম সাধারণ মহিলা ও পুরুষদেরও মাঝ রাতে রাস্তায় নামিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছে গত প্রায় দেড় দশক ধরে।

সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা হয়েছে কীভাবে তৃণমূল দলের ছত্রছায়ায় পাড়ায় পাড়ায় দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। লুম্পেনদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়েছে মানুষ। তৃণমূলের সাধারণ নেতাদের দাপটে কোনঠাসা হয়েছে তারা। সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগের তো শেষ নেই। পাড়ার তৃণমূল নেতাদের বিলাস-বৈভবে ফুলে ফেঁপে ওঠা তো নেত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন বার বার। নিজের দলের কর্মীদের সতর্ক করতে হয়েছে তাঁকে। তার উপরে সরকার ও প্রশাসনের কাজে অস্বচ্ছতা, সুবিচার পেতে দেরি হওয়া এসব তো আছেই।

সেই প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবার মানুষ উগড়ে দিয়েছেন ১৪-১৫ অগাস্ট মধ্য রাত্রে। সেই ক্ষোভের আগুন এখনও জ্বলছে। এটি এত সহজে নিভে যাওয়ার নয়।

সাধারণ মানুষের সঙ্গে সমাজের বিশিষ্টজন ও তৃণমূল দলেরও একাংশের এই গণবিক্ষোভে যোগদান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নাড়িয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই। একটি রাজনৈতিক দল বরাবর বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মোকাবিলা করার ছক তৈরি করে রাখে। কিন্তু যখন দলীয় রাজনীতির বাইরে (অরাজনৈতিক নয়) গিয়ে একটি গণ আন্দোলন তৈরি হয়, তখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক তাই হয়েছে।

সেই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী বার বার এটিকে রাম-বামের (বিজেপি-সিপিআইএম) চক্রান্ত প্রতিপন্ন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এতে তাঁর রাজনৈতিক লড়াইয়ের সুবিধা। তিনি বার বার মহিলাদের জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা রাজ্যের ছাত্রীদের জন্য কন্যাশ্রীর প্রসঙ্গ তুলে আনছেন। ভাবছেন সেই চেনা ছকেই তিনি রাজ্যের মহিলাদের মন জয় করবেন। ভেঙে দেবেন এই গণ আন্দোলন।

অন্যান্য বারের মতো এখনও পর্যন্ত তিনি মৃতার পরিবারকে 'হাইজ্যাক' করে সম্ভাব্য আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার রাস্তায় সফল হয়নি শাসক দল। কারণ এই আন্দোলন মৃতার পরিবার ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। যা মুখ্যমন্ত্রী নিজের দলের লোকজনকে রাস্তায় নামিয়েও থামাতে পারবেন না।

১৪ অগাস্ট রাতে আর জি করে হামলার ঘটনার মাধ্যমে পুরো গণ আন্দোলন থেকে চোখ সরিয়ে দেওয়ার একটি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল বটে। একটি প্রতি-আলেখ্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু প্রতিবাদী ডাক্তারদের মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে সেই আলেখ্যে জল পড়ে গেছে।

বাম আমলের বা বিজেপি শাসিত রাজ্যের ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা এই ঘটনার ভার লাঘব করার চেষ্টা করলেও সেটি বালখিল্যতা। সেই ঘটনাগুলির জন্য তৎকালীন বা সেই রাজ্যগুলির সরকারের যেমন দায় রয়েছে, তেমনই বর্তমানের দায় বর্তমান সরকারকে নিতে হবে। ওরাও করেছে বলেছে আমার দায়িত্ব লঘু হয়ে যায় না। এই ঝগড়া পাড়ার ছোটদের মধ্যে হতে পারে, দায়িত্বশীল সরকার বা শাসক দলের মধ্যে হতে পারে না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশা করতেই পারেন যে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার চলে যাওয়াতে তিনি মুক্ত। সরকারি ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যা মামলার কিনারা না করতে পারলে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে দুষবেন। কিন্তু প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ কী তাঁকে ছেড়ে দেবে! সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষকে আড়াল করার অভিযোগ কী তাঁকে ছেড়ে দেবে!

তার থেকেও বড় কথা রাজ্যের মানুষের অরাজকতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এত সহজে মুছে যাবে না। তাদের তখন বিজেপির জুজু দেখিয়ে বা বামেদের কীর্তি কলাপ মনে করিয়ে বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের লোভ দেখিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না। ২০১১ সালেও গণ বিক্ষোভের সময় রাজ্যের জনগণের কাছে বামেদের থেকে তৃণমূল খারাপ হতে পারে, কে সরকার চালাবে, কীভাবে নতুন সরকার চলবে এই সব বিষয় গৌণ ছিল। সেদিনও সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, লোকাল-কমিটির দৌরাত্মের মতো বিষয়গুলিই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। তখনও '২৩৫'-এর জোর ছিল সদ্য জিতে আসা সরকারের কাছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই শাসক, নিজেই বিরোধী এই দুই ভূমিকাতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন এতদিন ধরে। এবার শুধু বিরোধী-চোখ দিয়ে তিনি দেখুন কীভাবে সামাল দেবেন এই গণবিক্ষোভ। যার বীজ কিন্তু প্রায় দেড় দশক ধরে বপন করা হয়েছে রাজ্যের কোনায় কোনায়। আর জি করের বাইরে গিয়ে, 'রাতের সাথী' অ্যাপের বাইরে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই ভাববেন কেন একসঙ্গে এত মানুষ কোনও দলীয় পতাকার বাইরে গিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হলেন

More Articles