আরজি কর: ধর্ষকের বিকৃতি যেন মনরোগের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি
Psychopath vs Mental Health: যে কোনও বয়সি নারী দেখলে প্রথমেই তাঁর মুখের বদলে শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে যারা তাকিয়ে দেখে নেন সেটা মানসিক বিকৃতি।
"কলকাতা ফিরবি কবে তুই?" ভর সন্ধেবেলা এক বন্ধু ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন।
"এই তো তিন চার দিনে..."
"এখানকার খবর কিছু শুনেছিস? গতকাল আরজি করের ব্যাপারটা শুনেছিস তো?" বন্ধুর গলা এবার রীতিমত উত্তেজিত শোনাল।
"না তো! কী হয়েছে? এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক আর ইন্টারনেট খুব ঝামেলা করছে। সবটা জানতে বুঝতে পারছি না... খুলে বল তো আমায়..."
তারপর বন্ধুর কাছে কলকাতা থেকে বহুদূরে বসে বাড়ির কাছের আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নারকীয় ঘটনা শুনতে শুনতে ঘৃণায়, রাগে শিউরে উঠছিলাম। এত পৈশাচিক, এত নৃশংস মানুষ হতে পারে! কতটা জিঘাংসা বিষ ভেতরে জমে থাকলে এইভাবে একজন মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা যায় সেটাই ভাবছিলাম। বন্ধুর কথায় সেই ভাবনায় ছেদ পড়ল।
"অভিযুক্ত ধরা পড়েছে বুঝলি... কোনওরকম অনুতাপ, ভয় কিস্যু নেই রে। পুরো মানসিক বিকার... ফুল সাইকো মাল একটা... অবশ্য মানসিক অসুস্থতা না থাকলে এই কাজ কেউ করতে পারে!"
"দাঁড়া দাঁড়া, মানসিক অসুস্থ সেটা কে বলল? কোনও ডাক্তার বলেছেন? পুলিশ বলেছে?"
"না তো... মানসিক অসুস্থ তো হবেই। মানসিক রোগী বলেই তো এইরকম নৃশংস হতে পারে..."
"কক্ষনও নয়। মানসিক রোগী হলেই যে এমন নৃশংস, ভাবলেশহীন অপরাধী হবে এর কোনও মানে নেই। এরা মনোবিকারগ্রস্ত সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই..."
আরও হয়তো কিছু বলতাম কিন্তু ততক্ষণে আবার ফোনের নেটওয়ার্ক জবাব দিয়েছে।
প্রতিবার দেখি যখনই কোনও এমন খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে তখনই অভিযুক্তদের দুম করে মানসিক অসুস্থ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। যেন মানসিক রোগী মাত্রই সহজে অন্য মানুষকে খুন করতে পারেন বা নির্দ্বিধায় ধর্ষণ করতে পারেন, আর তারপরে দিব্যি নির্বিকার জীবনযাপন করতে পারেন। যেন যে কোনও মানসিক অসুস্থতার রোগ লক্ষণই হলো এইরকম অপরাধপ্রবণতা। অথচ এর থেকে বড় ভুল ধারণা আর কিছু হতে পারে না।
মানসিক বিকৃতি, যাকে সাইকোপ্যাথি বলা হয় আর মানসিক অসুস্থতার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। ছোটবেলায় স্কুলে যখন লিখতে বলা হতো অমুকের সঙ্গে তমুকের কী কী পার্থক্য আছে যা জানো লেখো, আমরা খাতাটাকে মাঝবরাবর সমান করে ভাগ করে স্কেল পেন্সিল দিয়ে ফস করে একটা লাইন টেনে দু'দিকে দুই যুযুধানের নাম লিখে, অমুক এটা পারে তো তমুক এটা একদম পারে না বা অমুক এটা করে কিন্তু তমুক কক্ষনও এটা করে না বলে খুব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতাম অমুক আর তমুক কেমন দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। সাইকোপ্যাথি আর মানসিক অসুস্থতার মধ্যের বিভাজনরেখা সবসময় অতটাও স্পষ্ট নয়, বিশেষ করে Antisocial Personality Disorder (ASPD)-এর ক্ষেত্রে, যেখানে সাইকোপ্যাথির লক্ষণ অতি অবশ্যই ASPD-এর উপসর্গ তালিকায় পড়ে। তবুও দুটো বিষয় যে একেবারেই গুলিয়ে ফেলা উচিত না সেটা বলা বাহুল্য। মানসিক বিকৃতি আর মানসিক অসুস্থতা একরকম মনে হলেও আসলে কোথায় দুটো আলাদা?
আরও পড়ুন- যৌনাঙ্গে রড, দেহ ৩৫ টুকরো! অপরাধীকে নৃশংসতা শেখায় আসলে কারা?
১৮৯১ সালে জার্মান মনোচিকিৎসক জুলিয়াস কখ প্রথম 'সাইকোপ্যাথি' শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর কাছে আসা কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখেন যে, তাঁদের কোনওরকম মানসিক অসুস্থতা সেই অর্থে নেই, কোনওরকম বুদ্ধিজনিত সমস্যা নেই অথচ তাঁদের আচরণে এবং নৈতিকতায় প্রচুর সমস্যা আছে। তখন তিনি সেই অবস্থাটিকে বলেন 'Psychopathischen Minderwertigkeiten' বা 'Psychopathic Inferiority'। তাঁর এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পরে পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার তত্ত্বের জন্ম হয়। যদিও সারা পৃথিবীব্যাপী কোনও সাইকিয়াট্রিক বা সাইকোলজিক্যাল সংস্থা সাইকোপ্যাথি বলে কোনও অসুখকে মান্যতা দেয় না, তবে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে এর ব্যবহার আছে। সাধারণ মানুষ, প্রেস, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এই সাইকোপ্যাথি শব্দটির বহুল প্রচলন আছে। এই শব্দ থেকেই উদ্ভূত একটা ছোট শব্দ 'সাইকো', ১৯৩৬ সাল থেকে এটির ব্যবহার শুরু হয়, তবে শুরু থেকেই এটি প্রায় গালাগালির স্তরেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সাইকোপ্যাথি জিনিসটা আসলে ঠিক কী? সাইকোপ্যাথই বা কাদের বলা যায়? সাইকোপ্যাথি হলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর সেই বৈশিষ্ট্য যাদের মধ্যে দেখা যায় তারাই সাইকোপ্যাথ। কানাডিয়ান মনোবিদ রবার্ট ডি হেয়ার সাইকোপ্যাথের এক চমৎকার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেন,
"Psychopaths are social predators who charm, manipulate and ruthlessly plow their way through life, leaving a broad trail of broken hearts, shattered expectations and empty wallets. Completely lacking in conscience and in feelings for others, they selfishly take what they want and do as they please, violating social norms and expectations without the slightest sense of guilt or regret."
এই বৈশিষ্ট্যগুলো কি সবই থাকতে হবে একজন সাইকোপ্যাথের মধ্যে? কতটা পরিমাণ থাকলে তাকে সাইকোপ্যাথ বলে চিহ্নিত করা যাবে? হেয়ার সাহেব এই প্রশ্নগুলোর একটা সহজ সমাধান বার করলেন ১৯৭০ সালে। তিনি ভ্যানকুভারে পুরুষ অপরাধী এবং জেলবন্দি পুরুষদের উপর একটা গবেষণা করে তার প্রাপ্ত ফল থেকে একটা কুড়িটা আইটেম বিশিষ্ট সাইকোপ্যাথি চেকলিস্ট (PCL) তৈরি করেন। বর্তমানে এই চেকলিস্টের একটি পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ ব্যবহার করা হয়, যার নাম সাইকোপ্যাথি চেকলিস্ট রিভাইজড (PCL-R)। এই PCL-R ব্যবহার করে একজন মানুষের মধ্যে আদৌ সাইকোপ্যাথি আছে কিনা বা থাকলে কতটা পরিমাণে আছে সেটা জানা যায়। সাধারণত ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের ক্ষেত্রেই এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আরেকটা ব্যবহার হলো, একজন মানুষের Antisocial Personality Disorder (ASPD) নামক মানসিক রোগ আছে নাকি সাইকোপ্যাথি আছে সেটা সুচারুভাবে নিরূপণ করা।
PCL-R-এ যে কুড়িটা আইটেম আছে, সেগুলো যথাক্রমে:
১. Superficial charm - সোজা কথায় 'ওপর চকচকে' বলে বাংলা ভাষায় যে শব্দটি আছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২. Grandiose sense of self worth - নিজেই নিজেকে বিশাল কিছু ভাবা।
৩. Need for stimulation/ Proneness to boredom - প্রতিটা মুহূর্তে বাইরে থেকে একটা উত্তেজনার জোগান প্রয়োজন হয় এদের। সেটা না থাকলে খুব সহজেই এরা বিরক্ত হয়ে পড়ে। একই জিনিস খুব বেশিক্ষণ এদের উত্তেজনা দিতে পারে না। নতুন নতুন জিনিস প্রয়োজন হয়। এই 'নতুন ' শব্দটি শরীরী সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
৪. Pathological lying - অকারণ অনাবশ্যক মিথ্যে কথা বলা।
৫. Conning/ Manipulative - লোককে ঠকানো বা নিজের খেয়ালখুশি মতো চালিত করতে পারে।
৬. Lack of remorse or guilt - কখনও কোনও কারণেই এদের মনে অনুতাপ জন্মায় না, শত অপরাধ করলেও। এমনকী খুন করার পরেও এদের মনে অনুতাপ আসে না, মনে হয় 'ইচ্ছে হয়েছিল, করেছি, বেশ করেছি'।
৭. Shallow Affect - খুব কম অনুভূতি বা প্রায় অনুভূতিহীনতা।
৮. Callous/ Lack of empathy - অন্য কোনও মানুষ বা প্রাণীর দুরবস্থা, কষ্ট এদের কোনওভাবে বিচলিত করে না।
৯. Parasitic lifestyle - অন্যের উপর নির্ভরশীল এরা, মূলত অর্থকরী ভাবে।
১০. Poor behavioral controls - আচরণগত সমস্যা।
১১. Promiscuous sexual behavior - অশ্লীল যৌনাচার। স্বাভাবিক যৌনতা ছাড়াও সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ যৌনতায় এরা বেশি আগ্রহী । এমনকী মৃতদেহ বা পোষ্য প্রাণীর সঙ্গেও যৌনাচার এদের কারও কারও কাছে উত্তেজক।
১২. Early behavior problems - মোটামুটি চোদ্দ-পনেরো বছর বয়স থেকেই এদের আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। যা ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে।
১৩. Lack of realistic long term goals - ভবিষ্যতের কোনও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না।
১৪. Impulsivity
১৫. Irresponsibility
১৬. Failure to accept responsibility for own actions - নিজের খারাপ কাজের দায়ভার কখনও নিজে নেয় না। সবসময়ই অন্যের ওপর দোষ চাপাতে সদাব্যস্ত।
১৭. Many short term marital relationships - একাধিক বৈবাহিক সম্পর্ক এবং বিবাহবহির্ভূত একাধিক শরীরী সম্পর্ক।
১৮. Juvenile delinquency - ছোটবেলা থেকেই অপরাধপ্রবণতা।
১৯. Revocation of Conditional Release - কোনও অপরাধ করার পর জেলবন্দি থাকাকালীন এদের আচরণগত সমস্যা এবং অনমনীয় অনুতাপবিহীন মনোভাবের জন্য কখনও শর্তসাপেক্ষে মুক্তি মঞ্জুর হয় না।
২০. Criminal versatility - বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে থাকে এরা।
আরও পড়ুন- হু হু করে বাড়ছে মানসিক অসুখে আক্রান্ত! কোন চরম পরিণতির দিকে এগোচ্ছে ভারত
PCL-R-এর প্রতিটি আইটেম একটি ৩ পয়েন্ট স্কেলে মাপা হয়: যার শূন্য মান অর্থাৎ এই পয়েন্টটি প্রযোজ্য নয়, ১ অর্থাৎ খানিকটা প্রযোজ্য এবং ২ অর্থাৎ ভীষণরকমভাবে প্রযোজ্য। এই পদ্ধতি অনুসারে সর্বোচ্চ প্রাপ্য নম্বর চল্লিশ। সাইকোপ্যাথি লেবেলের জন্য আমেরিকায় এই PCL-R-এ ন্যূনতম ত্রিশ নম্বর পেতে হয়, আবার PCL-R-এ ন্যূনতম পঁচিশ পেলেই ব্রিটেনে সাইকোপ্যাথির লেবেল পাওয়া যায়।
মনোবিজ্ঞানের জগতে সমস্ত মানসিক অসুস্থতাকে প্রধানত দুটো পদ্ধতির নিরিখে ভাগ করা হয়:
১. The International Classification of Diseases (ICD), যেটা World Health Organization (WHO) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
২. Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders (DSM), যেটা আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
যে হেয়ার সাহেব এই সাইকোপ্যাথি চেকলিস্ট (PCL) বানিয়েছিলেন, তিনি এবার চাইলেন সাইকোপ্যাথিকে একদম একটা সম্পূর্ণ নতুনরকম রোগ হিসেবে DSM-এর চতুর্থ পরিমার্জিত সংস্করণে (DSM-IV-TR) জায়গা দেওয়া হোক। DSM-IV-TR-এ অন্তর্ভুক্ত থাকা Antisocial Personality Disorder (ASPD) এর সঙ্গে যাতে এটা কখনই গুলিয়ে না যায়, কারণ এই দুটোর উপসর্গের মধ্যে অনেক মিল আছে।
এই উদ্দেশ্যে তিনি একটা নতুন গবেষণা করলেন, "Relation between ASPD and Suicide in comparison with Psychopathy and Suicide" গবেষণায় দেখা গেল, তুলনামূলকভাবে ASPD আক্রান্তদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি কিন্তু অপরপক্ষে PCL-R-এ বেশি নম্বর পাওয়া মানুষেরা মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার হুমকি দিলেও আত্মহত্যা প্রায় তারা কখনও করেই না। হেয়ার সাহেবের মতে, গবেষণালব্ধ এই ফল প্রমাণ করে দিল যে, ASPD আর সাইকোপ্যাথির মধ্যে কিছু মিল থাকলেও চরিত্রগত পার্থক্য অনেক বেশি। কিন্তু DSM-এর সম্পাদকমণ্ডলী সাইকোপ্যাথির এই অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষে সায় দিলেন না, কারণ তাঁদের মনে হলো এই সাইকোপ্যাথি চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিনিরপেক্ষতার অভাব, বিশেষত অনুতাপ কতখানি কম বা বেশি এই জাতীয় প্রশ্নে। তাঁরা আরও বললেন সাইকোপ্যাথির মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বা বুদ্ধিজনিত সমস্যা সেই অর্থে নেই, বরং অনেকটাই এটা সামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল এবং নৈতিকতার অভাবটাই বড় বেশি প্রকট। এই যুক্তি দেখিয়েই বর্তমানে DSM-এর পঞ্চম সংস্করণেও সাইকোপ্যাথির কোনও জায়গা হয়নি। এবার এই ডাক্তারি পরিভাষা ত্যাগ করে যদি সহজ ভাষায় বিষয়দুটো ব্যাখ্যা করতে চাই তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায়:
মানসিক বিকৃতি বা সাইকোপ্যাথি বলতে আমরা এমন কিছু চিন্তা-ভাবনা-আচরণ-অনুভূতিকে বোঝাই যেটা সামাজিক রীতিনীতি বা চাহিদা থেকে বিচ্যুত, ন্যূনতম নৈতিকতার ধার ধারে না। যেমন ধরা যাক, একজন মানুষ মনে করছেন একটা শিশুকে বলি দিলে তার আর্থিক অবস্থার বিপুল উন্নতি হবে। এই কারণে সেই মানুষটি একটি শিশুকে ধরে এনে বলি দিয়েও দিলেন এবং এই নারকীয় ভয়াবহ কাজটির জন্য তার মনে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-অনুতাপ-ভয় কিছুই হলো না, কোনও রেখাপাতই করল না। এই ধরনের চিন্তা ভাবনা-আচরণ মানুষটির দৈনন্দিন জীবনে কোনও স্ট্রেস তৈরি করে না। কারণ এরা মনে করেন, 'আমি যা করছি, যা ভাবছি, যা বলছি সব ঠিক। আমার কোনও ভুল হতেই পারে না।' তাই সাধারণত এদের কখনও মানসিক চিকিৎসার দরকার পড়ে না। এই ভাবনা-চিন্তার ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো এদের জীবনশৈলীর অঙ্গ হিসেবেই গণ্য হয়।
অপরদিকে, মানসিক অসুস্থতা মানুষের মনে এমন একটা স্ট্রেস তৈরি করে যে তাঁর দৈনন্দিন জীবন ক্রমশ ব্যাহত হতে থাকে। অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, স্কিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি আরও নানা মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে মানুষটির মানসিক রোগের চিকিৎসা অবশ্যই প্রয়োজন। মানসিক বিকৃতির ক্ষেত্রে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সামাজিক রীতিনীতি থেকে লক্ষ্যণীয় রকমের বিচ্যুতি। আর মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো এর থেকে তৈরি হওয়া মানসিক চাপ-দুশ্চিন্তা এবং যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে আরও নানারকমের মানসিক অসুস্থতার সংযোজন।
ধরা যাক, একজন মানুষ সর্বক্ষণ তাঁর শরীরের যে কোনও জায়গার, বিশেষ করে মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন। এটা একটা মানসিক অসুস্থতা যার নাম ট্রিকোটিলোম্যানিয়া। চিকিৎসা ছাড়া এর উপায় নেই, চিকিৎসা না করলে অসুস্থ মানুষটির দৈনন্দিন জীবন এবং স্বাস্থ্য প্রভাবিত হতে বাধ্য।
আবার, অন্য আরেকজন মানুষ বিশেষ ধরনের চুলের স্টাইল দেখলে ভীষণভাবে যৌন উত্তেজনা অনুভব করেন। তিনি প্রথমে সেইরকম চুলের স্টাইলের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, প্রেমের অভিনয় করেন, তারপর প্রেম ঘন হলে সুবিধামতো শরীরী সম্পর্কের পর সেই বিশেষ চুলের স্টাইলের মানুষটির মাথাটি কেটে নেন এবং নিজের গোপন একটা ঘরে ভালো করে সাজিয়ে রাখেন। এই বিভীষিকাময় আচরণে তিনি অনুতপ্ত হন না, বরং খুশি হন। তিনি জানেন এটা সামাজিক রীতিনীতির পরিপন্থী, তাতেও তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। এটা মানসিক বিকৃতি।
আরও দৈনন্দিন জীবনের থেকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। যখন ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে তখন কিছু মানুষ বলেন, "অত রাতে মেয়েটা একা কী করছিল?" বা "মেয়েটা কেমন পোশাক পরেছিল?", "মেয়েটার চরিত্র ঠিক ছিল তো?" এই প্রশ্নগুলো প্রত্যেকটাই মানসিক বিকৃতি। যখন ভিড় ট্রেনে বাসে নির্বিকার মুখে সহযাত্রীর সঙ্গে আটপৌরে কথা বলতে বলতে বা ফোন দেখতে দেখতে কেউ কেউ সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির শরীরের সর্বত্র হাত বোলাতে থাকেন সেটা মানসিক বিকৃতি। যে কোনও বয়সি নারী দেখলে প্রথমেই তাঁর মুখের বদলে শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে যারা তাকিয়ে দেখে নেন সেটা মানসিক বিকৃতি। কারও গায়ের রঙ, পোশাকের ধরন, চেহারার গড়ন নিয়ে সদলবলে বা একা সেই মানুষটিকে হাসির খোরাক করেন যারা, সেইটা মানসিক বিকৃতি। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে মেয়েরা রাতের দখল নেবে শুনে সেই নিয়ে যারা মিম বানান, বক্রোক্তি করেন,কটু কথা বলেন সেগুলো প্রতিটাই মানসিক বিকৃতি। আর হ্যাঁ, এগুলো কোনওটাই মানসিক অসুস্থতা নয়।