৩০ মিনিটে এত আঘাত একজনের কাজ নয়, মৃতার পরিবারের হয়ে আদালতে লড়াই বিকাশরঞ্জনের

RG Kar Doctor Rape-Murder Case: বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, খবর শুনে পরিবার দ্রুত হাসপাতালে গেলেও তাঁদের ৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়।

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের মামলাতে পুলিশ এবং হাসপাতালের ভূমিকায় চরম অসন্তুষ্ট হাইকোর্ট। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য পুলিশকে রবিবার অবধি সময় দিয়েছিলেন এই মামলার নিষ্পত্তির। কিন্তু কলকাতা পুলিশের কেস ডায়েরিতে সন্তুষ্ট না হওয়াতে হাইকোর্ট এখনই সিবিআইকে এই মামলার ভার দিয়েছে। মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম মামলার কেস ডায়েরি খতিয়ে দেখে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি জানান, রাজ্যের হাতে থাকা সব তথ্য এবং নথি, সিসিটিভি ফুটেজ সব সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে হবে। উল্লেখ্য, আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল আদালতে। মঙ্গলবার এক সঙ্গে সেই পাঁচটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি হয়।

জনস্বার্থ মামলায় মূলত তিনটি আবেদন করা হয়েছিল হাইকোর্টে। তার মধ্যে প্রধান ছিল নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে এই ঘটনার তদন্ত করানো। আবেদনকারীদের আর্জি ছিল, সিবিআই বা অন্য কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে এই ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হোক। যে সংস্থার উপর রাজ্যের প্রভাব থাকবে না। মঙ্গলবারের শুনানিতেই মৃতার পরিবারের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, প্রথমে পরিবারের কাছে কেউ একজন ফোন করে বলেন, আপনাদের মেয়ে অসুস্থ। তার পরে আবার ফোন করে বলা হয়, আপনাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আদালতে রাজ্য সরকার জানায়, পরিবারের দাবি সঠিক। সত্যিই দু’বার ফোন গিয়েছিল মৃতার পরিবারের কাছে। হাসপাতালের সহকারী সুপার মৃতার পরিবারকে ফোন করেছিলেন। তবে ফোনে কী বলা হয়েছিল, তা নিয়ে আদালতে কিছু বলেনি রাজ্য।

আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডে হাইকোর্টের প্রশ্নে বিদ্ধ রাজ্য, নির্দেশ এখনই সিবিআই তদন্তেরও

প্রথমেই কেন খুনের মামলার বদলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করা হয় তা নিয়ে শুনানিতে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারপতি। এই সম্পর্কে রাজ্যের আইনজীবী বলেন, ‘‘এই ধরনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়। প্রথমে এসে কেউ অভিযোগ করেনি। তাই অস্বাভাবিক মৃত্যু বলা হয়েছিল।’’ রাজ্যের যুক্তি শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘এটা আশা করা যায় না। মৃতদেহ কি রাস্তার ধার থেকে উদ্ধার হয়েছে? কেন অস্বাভাবিক মৃত্যু বলা হল? হাসপাতালের সুপার ও অধ্যক্ষ রয়েছেন। আপনারা প্রিন্সিপালকে পুরস্কৃত করলেন। কেন স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করা হল না? যথেষ্ট হয়েছে। এই যুক্তি দেখাবেন না।’’

এরপরই প্রধান বিচারপতি আরজি কর মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। তিন সপ্তাহ পরে এই মামলার পরবর্তী শুনানি। মঙ্গলবার আদালতে প্রধান বিচারপতি রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবা ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা করে বলেন, "রাজ্যের রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে এটা প্রথমেই দেখা দরকার যাতে চিকিত্সা পরিষেবা ব্যাহত না হয়। চিকিৎসকদের বা তাদের কোনও ফোরামের এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। তাদের বক্তব্যও জানা দরকার। পাশাপাশি যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে মৃত মহিলা চিকিত্সকের প্রতি আমাদের সমবেদনা থাকবে।" এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে রাজ্য জানায়, সমাজমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সরকার সবরকম চেষ্টাই করছে, তাই মূল আভিযুক্তকে গ্রেফতারও করা হযেছে।

আদালতে রাজ্যের কাছে এদিন প্রধান বিচারপতি জানতে চান সিসি টিভির ব্যবস্থা পর্যাপ্ত কেন নেই হাসপাতালে? সরকারি আইনজীবী জানান, সারা গত ক্যাম্পাস জুড়ে সিসি ক্যামেরা বসানো সম্ভব নয়। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করতেই হবে রাজ্যকে, যাই হয়ে যাক সিসি ক্যামেরা তো বসবেই।

অন্যদিকে আদালতে নির্যাতিতা ও মৃতার পরিবারের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, শুক্রবার সকাল ১০:৩৫ নাগাদ প্রথম ফোন আসে হাসপাতাল থেকে। তাতে জিজ্ঞেস বলা হয়, আপনাদের মেয়ে অসুস্থ। ১৫ মিনিট পর আবার ফোন যায়, তাতে জানানো হয় তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবর শুনে পরিবার দ্রুত হাসপাতালে গেলেও তাঁদের ৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। মেয়ের দেহ দেখতে দেওয়া হয়নি। এরপর দেহ দেখানো হলেও বলা হয়, অন্য কারও সঙ্গে তা আলোচনা না করতে। বিকাশরঞ্জন আরও বলেন, একজন প্রাক্তন সরকারি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। তিনি জানিয়েছেন, এই অপরাধ একজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডে ধৃত সঞ্জয় কীভাবে সিভিক ভলান্টিয়ার হলো? কীভাবে নিয়োগ হয় এদের?

প্রধান বিচারপতি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রশ্নের ভিত্তিরে রাজ্যকে জিজ্ঞাসা করেন, পুলিশ প্রথম আত্মহত্যা করার কথা যে বলেছিল, তা কি সত্য? রাজ্য সরকার আদালতে তা অস্বীকার করে। প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম বলেন, এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে প্রশাসন পরিবারের সঙ্গে ছিল না। রাজ্য বলে, ঘটনার দিন সকাল ৯:৩০টায় ফোন করা হয়। অ্যাসিস্টান্ট সুপার ফোন দু-বার ফোন করেন। টালা হাসপাতাল ফাঁড়িতে সকাল ১০:১০ নাগাদ খবর আসে। টালা থানা জানতে পারে ১০:৩০ টায়। ১১ টার সময় হোমিসাইড টিম পৌঁছয় হাসপাতালে। সোদপুর থেকে মৃতার অভিভাবকরা আসেন দুপুর ১টায়। তখন ফরেনসিক টিম সেমিনার রুমে কাজ করছে। ১০ মিনিটের মধ্যে ভিড় সামলে অভিভাবকদের নিয়ে যাওয়া হয় সেমিনার হলে। সেখানে চেয়ার দেওয়া হয় বসতে। ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করার অভিযোগ মিথ্যা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন আইনজীবীরা। ওই মিছিল থেকেই 'মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোকে আগে এনকাউন্টার করা উচিত' বলেও মন্তব্য করেন বিকাশ ভট্টাচার্য৷ মুখ্যমন্ত্রী যখন রবিবার অবধি পুলিশকে সময় দেন, বিকাশরঞ্জন তখনই বলেছিলেন, এই তদন্তের ভার "সিবিআইকে দিলে এখনই দেওয়া উচিত। সাতদিন পরে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করে তারপরে দেবেন? আসল সত্যকে আড়াল করতে চাইছেন। মুখ্যমন্ত্রী প্রলোভন দেখিয়ে সাক্ষ প্রমাণ লোপাট করতে চাইছেন। পরিবারকে দুর্বল করে দিয়ে চাকরির প্রলোভন দিচ্ছেন।" বিকাশ বলেছিলেন, "একজন নামকরা চিকিৎসক আমাকে বলেছেন, যেভাবে মেয়েটির কলার বোন ভাঙা হয়েছে তা একজনের কাজ নয়। কলার বোন ভাঙা হয়েছে, পেলভিস বোন যেভাবে ভেঙে তারপর ধর্ষণ করা হয়েছে৷ এটা একজনের কাজ নয়।" আদালতেও এই নিয়ে লড়ে গিয়েছেন তিনি।

More Articles