আরজি কর হত্যা: যে প্রশ্নগুলি রয়েই গেল

RG Kar Rape Murder Case: যদি মেনেও নিই যে অচৈতন্য দেহ পাওয়া গিয়েছিল। তাহলে কি সেমিনার রুমে সবাই দাঁড়িয়েছিলেন মেয়েটা কখন মরে যাবে তা দেখবার জন্য?

আরজি করে সেই রাত্রে কী ঘটেছে, তা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। ঘটনার পরপরই পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সন্দীপ ঘোষও প্রথম দু'দিন কিছু বলেননি। আমরা বারবার বলেছি, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অবশ্যই স্ক্যানারের নীচে আনা উচিত। তাঁকে বাদ দিয়ে কোনওভাবেই এই ঘটনার তদন্ত সম্ভব নয়। তার উপর সন্দীপ ঘোষ দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষ। আরজি করে একটি পাতা পড়লে সন্দীপ ঘোষ খবর পান। ফলে তাঁকে পদে রেখে আরজি করের এই মামলার তদন্ত প্রায় অসম্ভব। এই প্রসঙ্গ তোলা হলে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ স্বাস্থ্য সংগঠন বা চিকিৎসকেরা রীতিমতো বাধা দিয়েছেন, বাপ-বাপান্ত করেছেন। ঘটনার দু'দিন বাদে সন্দীপ ঘোষ স্বেচ্ছায় পদত্যাগের নাটক করলেন এবং মুখ্যমন্ত্রী বললেন, "সন্দীপকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। ও পদত্যাগ করেছে, ওকে আমরা অন্যত্র নিয়োগ করব।" ওই দিনই তাঁকে ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করা হলো। সন্দীপ ঘোষের পদত্যাগপত্র কিন্তু কেউ দেখেনি। স্বাস্থ্যভবন থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন কিন্তু পদত্যাগপত্র দেখা যায়নি। আদৌ যে তিনি পদত্যাগ করেছেন, তার কোনও লিখিত প্রমাণ কিন্তু কোনও সংবাদমাধ্যম দেখাতে পারেনি। ন্যাশনালেও বিপুল ছাত্রবিক্ষোভ হলো এবং তিনি যোগদান করতে পারলেন না। এরপর কী হইল জানে শ্যামলাল! পদে পদে ভুল সিদ্ধান্ত, অপদার্থতার প্রমাণ দিলেও সরকার তো পাগল নয় যে তাঁকে পদে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।

এরপরের ঘটনাক্রমের দিকে তাকানো গেলেই বোঝা যাবে তাতে রাজনীতির যোগাযোগ স্পষ্ট। একেবারে দায়িত্ব নিয়ে প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে, সেই ভিডিও সামনে আসার আগে থেকেই স্পষ্ট প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা হয়েছে। সেমিনার রুম সংলগ্ন ঘর ভাঙার কথা তো ছেড়েই দিন। ওই সেমিনার রুমে ঢালাও লোক যাতায়াত করেছে, পুলিশ কোনওরকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। এমন নয় যে পুলিশের অনুপস্থিতিতে মানুষ ক্রাইম সিনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ ওখানে দাঁড়িয়ে মোবাইল দেখছে। ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দেয় যে, দেহটার পাশে, কন্যাসমা এক ছাত্রীর মৃতদেহের পাশে কিছুজন মিলে মিটিং করছেন। মিটিং করছেন, কীভাবে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়া যায়! কারা করছেন? যাদের দায়িত্ব চিকিৎসা নীতির দেখাশোনা করা, যারা কলেজে পড়ান!

পুলিশ জানিয়েছিল, মৃতদেহের নিম্নাঙ্গে কোনও কাপড় ছিল না। তা পাশে রাখা ছিল। বাকি কাপড় ছেঁড়া ছিল। এই সব দেখেও আত্মহত্যার করেছে বলে ভাবা যায়? পুলিশ বলেছে, শারীরিক নিগ্রহের কোনও প্রমাণ নেই। এই দেহ দেখে কী করে মনে হয় শারীরিক নিগ্রহের প্রমাণ নেই? যদি প্রাথমিক কথা মেনেও নিই যে অচৈতন্য দেহ পাওয়া গিয়েছিল। তাহলে কি সেমিনার রুমে সবাই দাঁড়িয়েছিলেন মেয়েটা কখন মরে যাবে তা দেখবার জন্য? মেয়েটির মা যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন তুলেছেন, দেহে এত ক্ষতচিহ্ন পাওয়ার পরও কীভাবে চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো থাকে?

আরও পড়ুন- হাসপাতালে হাসপাতালে সিন্ডিকেট রাজ, কাকে কেন আড়াল করছে প্রশাসন?

দেবাশিস সোম ওখানে পদের দিক থেকে জুনিয়র, তিনি ফরেন্সিক মেডিক্যালের এমডি নন। অনেকদিন ধরেই ওখানে আছেন, ফলত যোগ্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু তিনি বিভাগীয় প্রধান নন, ফ্যাকাল্টিও নন। আমি যত দূর জানি, ময়নাতদন্ত যারা করেছেন সকলেই আরজি কর হাসপাতালের নন, বাইরেরও কিছুজন ছিলেন। একটি ন্যাশনাল মিডিয়াতে একজন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ময়নাতদন্ত নিয়ে বাপ-বাপান্ত করলেন। তিনি বলেছেন, এটি অভিজ্ঞ কারও লেখা নয়। ময়নাতদন্তের যে কোনও ভদ্রস্থ উকিল এই রিপোর্ট নাকচ করে দেবেন।

২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতাশালী হলো। বাজারে তখন দুটোই নাম। শান্তনু সেন এবং নির্মল মাঝি। আগেও কিছু গোলমাল থাকত কিন্তু এই সময় থেকেই একটু একটু করে শোনা যেতে থাকে দুর্নীতি ও বদলি ঘিরে বিভিন্ন গোলমালের কথা। পরিস্থিতির চরম বদল হলো শেষ মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্বাচন ও তার পর থেকেই। এটি ডাক্তারদের মেডিক্যাল কাউন্সিল। এদের হাতে দারুণ ক্ষমতা রয়েছে এমনও কিন্তু নয়। অন্তত থাকার কথা নয়। মেডিক্যাল কাউন্সিল একটা রেগুলেটরি বডি। যেখানে রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা ইত্যাদি বিষয় দেখার কথা ছিল। সেই নির্বাচনে তৃণমূলের স্বাস্থ্য বিভাগের নেতা শান্তনু সেন এবং নির্মল মাঝি কেউই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপস্থিত ছিলেন না। তৃণমূলের অন্য একটা গোষ্ঠী এই নির্বাচনে লড়তে এলো, যার প্রধান মাথারা ছিল সুদীপ্ত রায় এবং সুশান্ত রায়। সে সময় তাঁদের মধ্যে একটা মরিয়া ব্যাপার তৈরি হলো যে, এই নির্বাচনে যদি আমরা না জয়ী হই তৃণমূলের অন্তর্গত গোষ্ঠী-রাজনীতিতে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। তাই যেকোনও ভাবেই তাঁরা এই নির্বাচন জিততে চাইলেন। সেখানেও বিভিন্ন দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু মুশকিলটা হলো, তৃণমূলের সুদীপ্ত রায় এবং সুশান্ত রায়ের নেতৃত্বে যে গোষ্ঠী ক্ষমতায় এল, তাঁরা শুধুমাত্র মেডিক্যাল কাউন্সিলের ক্ষমতাতেই সীমাবদ্ধ রইলেন না। তাঁরা পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যদফতর গিলে ফেলল

একটু খেয়াল করলেই, বোঝা যাবে এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে শ্যামাপদ দাসের মতো ব্যক্তিরা। শ্যামাপদ দাসের মতো এত প্রচারবিমুখ মানুষ পাওয়া মুশকিল। এত বছর চাকরি করেও আমি জানতাম না মানুষটা দেখতে কেমন। পোস্টারে মুখ দেখে ধারণা পেয়েছি তিনি কেমন দেখতে। আগে জানতাম তিনি উত্তরবঙ্গে প্র্যাকটিস করেন, তারপর জানতে পারলাম কলকাতাতেই থাকেন। আসলে শ্যামাপদ রায় কোনও জায়গাতেই নেই, আবার সব জায়গাতেই আছেন। শান্তনু সেন এবং নির্মল মাঝির গোষ্ঠীতে যারা রয়েছেন সেই চিকিৎসকদের অনেকে আগাগোড়া বাম-বিরোধী ছিলেন, কেউ কেউ সিপিএম থেকে এসেছেন, আবার কিছুজন ২০২১ সালে বিজেপিতে ঘেঁষতে চেয়েছেন। মোদ্দা কথা, এঁরা ভালো-মন্দ যেমনই হন, রাজনীতির মধ্যেই ছিলেন।

যে গোষ্ঠী এখন ক্ষমতায় আছে তাঁদের মাথায় রয়েছে জুনিয়র ডাক্তাররা। এরা খুব বিপদজনক। এদের কোনও অভিজ্ঞতা নেই এবং এদের অপরিণত মস্তিষ্ক। পরিবেশটা বিষিয়ে গিয়েছে। গত ৩-৪ বছরে এদের দলের প্রতিজন পড়ুয়া ৭৫% নম্বর নিয়ে পাশ করেছে। বিপদটা তখন হবে, যখন এই দুর্দান্ত আকাডেমিক রেজাল্ট নিয়ে এরা অধ্যাপনায় ঢুকবে। দুর্নীতি ছাড়াই এরা অধ্যাপনায় অগ্রাধিকার পাবে। এতে একদিকে যেমন অযোগ্যের হাতে চিকিৎসা করিয়ে মানুষজনের ব্যাক্তিগত ক্ষতি হবে, অন্যদিকে এরাই অধ্যাপনায় যুক্ত হয়ে বছরের পর বছর কয়েকটা প্রজন্মকে নষ্ট করে দেবে। তা আরও বিপদজনক।

জুনিয়র ডাক্তাররা তো ছাত্র। আমারা বারবার বলে থাকি ছাত্ররা সমাজের সংবেদনশীল অংশ, ছাত্ররাই সবার আগে রাস্তায় নামে। কিন্তু আরজি করে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল ক'জন ছাত্র এই নিয়ে মুখ খুলছেন? তাঁরা প্রত্যেকে নামগুলো জানে যে কারা কারা জড়িত? কারা ধামাচাপা দিচ্ছে? কারও সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়েছিল কি ওই ডাক্তারের? জানেন না এমন হতে পারে না। হোস্টেলের কোনও পড়ুয়া কারও হাত ধরে চা খেলেও তা পুরো ক্যাম্পাস জেনে যায়। তাই তো হোস্টেলের কালচার। এখানে এত বড় ঘটনা হয়ে গেল কেউ জানেন না?

মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে প্রথমে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় যে টাস্কফোর্স তৈরি করেছিলেন, তাদের মাথায় বেসরকারি চাকুরেদেরই রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকেই নামকরা ডাক্তার। সরকারি এবং বেসরকারি দুটো ব্যবস্থাকে একসঙ্গে মেলানো যায় না। এদের মধ্যে পার্থক্য আপেল এবং কমলালেবুর মতো। কিন্তু প্রথম থেকে এই পদ্ধতিই শুরু হয়েছে। এখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও কেউ খুব বিচলিত হবেন না। মধ্যবিত্ত অনেক আগেই সরকারি হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করেছে।

আরও পড়ুন- আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডে কি পিতৃতন্ত্রকেই বাঁচাতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট?

আমি বেশ কিছুদিন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ছিলাম। সরকার আমাকে এমন জায়গাতেই রাখে যেখানে বিশেষ কিছু কাজের সুযোগ থাকে না। তো ওখানেও রেডিওথেরাপি মেশিন ছিল না (এখনও নেই)। যাঁদের রেডিওথেরাপির প্রয়োজন, তাঁদের অন্যত্র রেফার করতে হয়। তেমনই এক রোগীকে অন্য সরকারি হাসপাতালেই রেফার করি যেখানে এই ব্যবস্থা আছে। সেই রোগীর সঙ্গে পরে দেখা হয়েছে। রোগীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন হলো চিকিৎসা? রোগী জানালেন, আমার রেফার করা জায়গাতে তাঁর চিকিৎসা হয়নি। তাঁর স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ছিল, অন্য বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে, এক টাকাও লাগেনি। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে শুনেই তাঁকে নাকি বলা হয়েছিল, অ্যাপোলোতে চিকিৎসা করালে ভালো চিকিৎসাও হবে টাকাও লাগবে না। সরকারও তো এসব জানে নিশ্চয়ই। আধার নম্বর দিয়ে রোগীর চিকিৎসার তথ্য রাখা থাকে। সরকার কোটি কোটি টাকা দিয়ে চিকিৎসার যন্ত্র আনে কিন্তু রোগীকে মেডিকা, অ্যাপোলোতে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দা যে অপ্রতুল অর্থ, তারও অনেকখানি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে

আগে ডাক্তার কোনও কথা বললে তা সহজেই মেনে নেওয়া হতো। ধীরে ধীরে দেখা গেল, ডাক্তারের কথাকেই মানুষ আর শেষ কথা বলে মেনেই নিচ্ছেন না। স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির কারণে বিশ্বাস-ভরসার বিষয়গুলি আবারও ধাক্কা খাবে। সরকারি সিস্টেম একটা নির্দিষ্ট গতিতে চলতে থাকে। উত্তরবঙ্গ লবির জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙেছে, তা বলব না। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ১০ বছর আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। সমস্ত ক্ষেত্রের মতো, এখানেও পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে একটা ট্যাবলেট কেনা হয়েছে ৮ টাকা মূল্যে। একই ট্যাবলেট আরজি করে কেনা হয়েছে ১০৮ টাকা মূল্যে। এই আমলে অন্যান্য সেক্টরের মতো স্বাস্থ্য-দফতরেও ঢালাও দুর্নীতি হয়েছে, কিন্তু তার মানে এই নয়, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। একটি বড় গাড়ির তেল বের করে দিলেও যেমন সেই গাড়ি কিছু দূর গতিজাড্যের কারণে এমনিই চলে যেতে পারে, স্বাস্থ্যব্যবস্থাও চলছে।

 

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More Articles