লজেন্স বিক্রি থেকে ফুটবলের ময়দান! রাতারাতি শিরোনামে ব্রাজিলের রিচার্লিসনের লড়াই আর কেচ্ছা

Brazil Richarlison: ২০১৬-২০১৮। রিচার্লিসন খেলেন ফ্লামিনেন্স এবং ওয়াটফোর্ড নামে দু'টি ক্লাবে। প্রায় চারবছর, ২০১৮-২০২২ পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন কাটে এভারটনের সঙ্গে।

শুক্রবারের মধ্যরাত। কাতার বিশ্বকাপের একাধিক অঘটনের দোলাচলে খেলতে নামে ব্রাজিল। মারাত্মক দল আর একাধিক আশা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কঠিন প্রতিপক্ষ সার্বিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নামেন পেলের দেশের নেইমাররা। খেললেন। টানটান ম্যাচে আর অঘটন নয়, জিতে দেখাল ব্রাজিল। কিন্তু গোল? সাম্বার দেশের জয়ের মধ্যেই আলোচনায় এসেছে একটি গোল। একই দিনে পর্তুগালের রোনাল্ডো (Ronaldo) -সুলভ লাফের ছবির মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে আর একটি ছবি। ঝড় তুলেছে বছর ২৫-এর এক খেলোয়াড়ের অনবদ্য কৌশল। সব ছাড়িয়ে নিপুণ আর ঐতিহাসিক শর্টে গোলপোস্টে প্রবেশ করিয়েছেন বিশ্বকাপের বল। তার সঙ্গেই করে ফেলেছেন একাধিক রেকর্ড। ফের ফুটবল বিশ্বে তারকা সমাগমে জ্বলজ্বল করেছে এই তারকার নাম। রিচার্লিসন (Richarlison), ব্রাজিলের (Brazil Football Team) জাতীয় ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য। তাঁর পায়ের কারসাজিই আলোচনায় এসেছে ফের। নেইমারদের ছাপিয়ে তিনিই হয়ে উঠেছেন হলুদ-সবুজ ঘরের নয়া মসিহা।

কিন্তু এই ফুটবলার অর্থাৎ রিচার্লিসনকে ঘিরেই রয়েছে একাধিক কথকতা। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে লড়াইয়ে কথা, উঠেছে বিতর্কের তুফান। কীভাবে তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে প্রেম, যৌনতা আর সম্পর্কের 'গসিপ'। কে তিনি? রিচার্লিসন। পুরো নাম রিচার্লিসন-ডি-অ্যান্ড্রেড। ব্রাজিলের নোভা ভেনেসিয়ায়, ১৯৯৭ সালের ১০ মে জন্ম নেন তিনি। বাবার নাম অ্যান্তিনিও কার্লোস অ্যান্ড্রেড। মা ভেরা লুসিয়া। রয়েছে দুই বোন আর এক ভাই। বড় সন্তান, ২৫ বছরের এই খেলোয়াড়ের ছোট থেকেই ঝোঁক ছিল ফুটবল খেলার। ব্রাজিলের ফুটবলময় পরিবেশে বেড়ে ওঠা তাঁর। পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না কোনও দিনই। নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠতে উঠতে দেখেছেন একাধিক লড়াইও।

'লজেন্স বিক্রেতার সন্তান থেকে তারকা'

লড়াই এতটাই কঠিন ছিল যে তাঁকে এবং তাঁর দুই বোনকে নিয়ে অসহনীয় অবস্থায় থাকতে হয়েছে রিচার্লিসনের মা ভেরা লুসিয়াকে। স্বামীর আকস্মিক অসুস্থতা, সংসারে অভাব আর আর্থিক অনটনের কঠিন দিনে পাঁচ সন্তানের মাকে নামতে হয়েছে রাস্তায়। পেট চালাতে কখনও লজেন্স, কখনও আবার আইসক্রিম বিক্রি করতে হয়েছে রিচার্লিসনের মাকে। সঙ্গে চলেছে তাঁর বাবার সংসার চালানোর লড়াই। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকেই মায়ের কাজে সাহায্য করতেন পরিবারের বড় ছেলে রিচার্লিসন। সঙ্গে তাঁর দুই বোন, ভাই। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গেই লজেন্স বিক্রি করতে যেতেন তাঁরাও।

আরও পড়ুন- দু’জনেরই খাতায় একটি করে গোল, মেসি-রোনাল্ডোর বিশ্বকাপের শুরুটা যেমন

ক্লাব ফুটবলে প্রবেশ

১৬ বছর বয়সেই রিয়াল নরোয়েস্টো নামের একটি ক্লাবে খেলার সুযোগ পান তিনি। শুরু হয় ক্লাব ফুটবলে অংশ নেওয়া। ২০১৩ থেকে ২০১৪, এক বছর এখানে কাটিয়ে অন্যতম নামী এক ফুটবল ক্লাবে যোগ দেন রিচার্লিসন। ২০১৪-২০১৫, এই এক বছর তিনি খেলেন আমেরিকা মিনেইরোর সঙ্গে।

২০১৬-২০১৮। রিচার্লিসন খেলেন ফ্লামিনেন্স এবং ওয়াটফোর্ড নামে দু'টি ক্লাবে। প্রায় চারবছর, ২০১৮-২০২২ পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন কাটে এভারটনের সঙ্গে। ১৩৫টি ম্যাচে প্রায় ৪৩টি গোল করেন তিনি। এই সময় জুড়ে ক্রমশ জনপ্রিয়তা পান এই ফুটবলার। হয়ে ওঠেন অন্যতম। টোটেনহ্যামের সঙ্গে যোগ হয় তাঁর নাম।

জাতীয় দলে সুযোগ

ওয়াটফোর্ড ক্লাবের হয়ে খেলার সময়েই ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল দলের নির্বাচকদের নজরে পড়েন তিনি। রিচার্লিসনকে অনূর্ধ্ব ১৭ দলে সুযোগ দেওয়া হয়। ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ৪ বছর ধরে এই দলের হয়ে খেলেন তিনি। ৮টি ম্যাচে ২টি গোল করেন এই ফুটবলার।

এরপর ব্রাজিলের জাতীয় ফুটবল দলের অনূর্ধ্ব ২৩ দলে ডাক পড়ে তাঁর। এখানে মাত্র ৬টি ম্যাচ খেলেও তাঁর পায়ে গোল হয় ৫টি! আর কেরিয়ারের পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়নি প্রত্যন্ত এলাকার এই সন্তানকে। নানান প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়েও ২০১৮ থেকেই খেলতে থাকেন ব্রাজিলের মূল দলের সঙ্গেও। যাঁর ঝুলিতে ভরেছে ১৯টি গোলের রেকর্ড। ২৪ নভেম্বরের বিশ্বকাপ ম্যাচের ঐতিহাসিক গোল ধরে রিচার্লিসনের রেকর্ডে যোগ দিয়েছে জাতীয় দলের হয়ে ৩৯টি ম্যাচ। ২০১৮ সালে ব্রাজিলের জাতীয় দলের কোচ টাইটের ডাকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যে ম্যাচ দিয়ে তাঁর প্রধান দলে প্রবেশ ঘটেছিল, তা আজও বিদ্যমান। সেদিনও প্রথম দিনেই চমক দেখিয়েছিলেন এই যুবক। মাত্র ২১ বছর বয়সেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর তকত!

২০১৯ এর 'কোপা আমেরিকা' টুর্নামেন্টে জয়ী হন তিনিও। ব্রাজিলের সেই দলের সদস্য ছিলেন রিচার্লিসন। এমনকী ২০২১ এও একই টুর্নামেন্টে খেলেন। আর ২০২০ এর গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসরে তাঁর দলের জয় হয় ফের। সোনার মেডেল গলায় ঝোলে তাঁরও। আর ২৪ নভেম্বরের রাত। তাঁর জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচের সেই রেকর্ড ফের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে এই ফুটবলারকে। আবারও তিনিই হয়ে উঠেছেন অনেককে ছাড়িয়ে সেরা।

প্রেমিকা-বিতর্কে রিচার্লিসন

ফুটবল আর প্রেম-বিতর্ক বরাবরের। মারাদোনা থেকে কাকা, পিকে-রোনাল্ডো। সম্পর্ক আর যৌনতা নিয়ে আলোচনায় আসেননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! সমকামী পেলে-বিতর্ক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বক্সার পুরুষ বন্ধু বদরের সঙ্গে রোনাল্ডোর উষ্ণ ছবি; গরম-গরম আলোচনার সৃষ্টি করেছে বারবার। কিন্তু এই ২৫ বছরের ছেলেকে নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। একাধিক প্রেমিকা আর যৌন সম্পর্কের দাবানলে পুড়েছেন ব্রাজিলীয় এই ফুটবল তারকা। একাধিক বান্ধবী আর বিয়ের গুজবে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়েছে তাঁকে। সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় উঠে এসেছে রিচার্লিসনের যৌন-জীবন।

ফ্লাভিয়া ক্রিস্টাইন। ব্রাজিলীয়। পেশায় চিকিৎসক। এক নামী বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত এই সুন্দরীর সঙ্গে জড়িয়েছে তাঁর নাম। যিনি আবার আর এক ব্রাজিলীয় ফুটবলারের ২ সন্তানের মা! ওয়েলিংটন সিলভার স্ত্রী, দুই সন্তানের মা ফ্লাভিয়ার সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে তাঁর নাম। যদিও সিলভার স্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই নাকি এই প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন দু'জন। শোনা যায়, ২০১৮ সালের আগে থেকেই ডাক্তারের ভালোবাসার সেবায় রয়েছেন তিনি। তাঁর দাঁতের ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছেন ফ্লাভিয়া। ৬ ফুট উচ্চতার বিরাটাকায় শরীরের ফুটবলারের সঙ্গে বারবার উষ্ণ ছবিও ছড়িয়েছে ফ্লাভিয়ার।

আবার তাঁদের নিয়েই শুরু হয়েছে আর এক বিতর্কও। নিজেরা না বললেও অনেকেই বলেছেন, প্রেম নয় এই জুটির বিয়ে হয়ে গিয়েছে! তাঁদের নাকি রয়েছে ৪ সন্তান! যদিও এই জল্পনায় জল ঢেলেছেন ফুটবল তারকা। তাঁরা যে এখনও বিয়ে করেননি বা তাঁদের কোনও সন্তানও নেই, একথা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। এমনকী নিজেদের সহবাসের অবস্থান নিয়েও ধোঁয়াশা বজায় রেখেছেন তিনি।

আবার খেলার মাঠের বাইরে প্রেমের মঞ্চে বেশ দাপিয়েছেন এই তারকা ফুটবলার। অনেকেই বলেন, মাত্র ২৫ বছরের রিচার্লিসনের প্রেম আর চুম্বন সম্পর্কের গণনা করলে তাঁর বয়সের সংখ্যাও নাকি পার করতে পারে!

আরও পড়ুন- কোন চালে মাত জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনা? আশার আলো দেখাচ্ছে এশীয় ফুটবল

নেইমার-সঙ্গ

বন্ধু হিসেবে ব্রাজিলের জাতীয় দলে সবসময় কাছে পেয়েছেন নেইমারকে। একাধিক বিতর্ক থেকে শুরু করে বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ, রিচার্লিসন পাশে পেয়েছেন নেইমারকে।

বর্ণবৈষম্যে কলা-বিতর্ক

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ব্রাজিল বনাম তিউনিশিয়া ম্যাচে চূড়ান্ত অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয় রিচার্লিসনকে। বর্ণবৈষম্যের শিকার হন এই ফুটবলার। খেলার মাঠেই তাঁকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় কলা। টোটেনহ্যামের সঙ্গে খেলা এই ফুটবলারের সঙ্গে জাতীয় দলের ম্যাচে ঘটে এই ঘটনা। বিতর্কের ঝড় ওঠে। উত্তাল হয় ব্রাজিল। কালো-ফর্সার (Racism) দ্বন্দ্বে ফের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। কেন এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে, প্রশ্ন ওঠে ফের। সমালোচনার মুখে পড়ে প্যারিস-প্রশাসন। ছাড় পায়নি তিউনিশিয়াও।

এই ঘটনাটি ঘটান ফ্রেড (Fred) নামের এক ফুটবলার। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের (Manchester United) সঙ্গে জড়িত ওই তিউনিশিয়ার ফুটবলার ম্যাচ চলাকালীন কলা ছুঁড়ে মারেন রিচার্লিসনের দিকে। যা সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হয়। সেই ম্যাচে ৫-১ গোলে জয় পায় ব্রাজিল। এই ঘটনার পরেই ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন একটি বিবৃতি জারি করে। তাদের তরফে জানানো হয়, ''কালোবর্ণের ফুটবলার ছাড়া আমাদের জাতীয় দল অসম্পূর্ণ। তাই তাঁদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাঁদের জন্য আমরা গর্বিত।'' এই বিবৃতির সঙ্গেই বর্ণবৈষম্য বিরোধী একটি পোস্টার প্রকাশ করা হয়। এই ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয় ফ্রেডের বিরুদ্ধে। যদিও রিচার্লিসনের সঙ্গে হওয়া এই 'অমানবিকতা'র বিরুদ্ধে সরব হয় সেদেশের জনতা।

লড়াই করেই বাঁচতে হয় নিরন্তর। কিন্তু সেই লড়াইয়ের পরেই যখন অবতীর্ণ হওয়া যায় অভীষ্ট লক্ষ্যের পাহাড়ে! কতটা পথ অতিক্রম করলে সত্যিই হয়ে ওঠা যায় অভিনব! রিচার্লিসনকে ঘিরে এমনই সব বাক্যের সার্থক প্রকাশ ঘটে বারবার। ওজিল (Ozil) ছাড়িয়ে এক লজেন্স বিক্রেতা মায়ের সন্তান হিসেবে তাঁর লড়াই ঠিক যতটা বিবর্তিত হয়, ততটাই ছড়িয়ে যায় বিতর্কও। তবুও তিনি হয়ে ওঠেন অভিনব। অনবদ্য আর অনন্যও।

More Articles