এক ওভারে পাঁচটা ছয়, রিঙ্কু সিংয়েই মজে কেকেআর! কেন তাঁকে তিনমাস ব্যান করেছিল BCCI?
Rinku Singh KKR IPL : কমেন্টেটররা দিনের শেষে নিজের বক্তব্য বদলে নিয়েছেন। মাঠজুড়ে তখন একটাই নাম – রিঙ্কু সিং।
শেষ ওভারের প্রথম বলটি হয়ে গিয়েছে। ক্রিজের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে উমেশ যাদব। আর স্ট্রাইকার এন্ডে দাঁড়িয়ে একবার চারদিকটা দেখে নিলেন তিনি। বাঁ হাতি, খাটো এই ব্যাটার কি করতে পারবেন ম্যাজিক? ততক্ষণে কমেন্ট্রি বক্সেও আলোচনা শুরু হয়েগিয়েছে। গুজরাত টাইটানস তাহলে টানা তিনতে ম্যাচ জিততে চলেছে। শেষ পাঁচ বলে দরকার ২৮ রান, অসম্ভব না হলেও করাটা বেশ মুশকিল। তাও এমন চাপের পরিস্থিতিতে সেরকম অভিজ্ঞ ব্যাটার নেই। আন্দ্রে রাসেল, নীতিশ রানারা অনেক আগেই ডাগ আউটে। তাহলে?
রবিবার, ৯ এপ্রিলের রাতের ঠিক সেই মুহূর্তের পর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। কমেন্টেটররা দিনের শেষে নিজের বক্তব্য বদলে নিয়েছেন। মাঠজুড়ে তখন একটাই নাম – রিঙ্কু সিং। সেই শেষ ওভারের পরের পাঁচ বলে পাঁচটি ছয়, স্নায়ুর যুদ্ধ জিতে সোজা দৌড় লাগালেন কেকেআর ডাউ আউটের দিকে। ক্যাপ্টেন নীতিশ রানা ততক্ষণে ছুটে এসেছেন। পুরো টিম জড়িয়ে ধরল তাঁকে। আর রিঙ্কু সিং? আকাশের দিকে তাকিয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেই চললেন। এরকম রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ, এমন রান তাড়া করা আর পাঁচটি ছয়ের বিস্ফোরণ – আইপিএল শেষ কবে দেখেছে জানা নেই। রিঙ্কু সিংও এমন খেলা আর খেলেছেন কিনা, জানেন না। কেবল জানেন, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন আর সুন্দর শব্দ হল আত্মবিশ্বাস, আর ধৈর্য। বাইশ গজের এই মহাপৃথিবী তাহলে সবকিছু সাজিয়ে দেবে তোমার সামনে।
আরও পড়ুন : সংসার চালাতে করেছেন ঝাড়ুদারের কাজও, কীভাবে রাতারাতি ম্যাজিক ম্যান হয়ে উঠলেন রিঙ্কু
সোশ্যাল মিডিয়া, খবরের কাগজের খেলার পাতা, সব জায়গা রিঙ্কুময়। কলকাতা নাইট রাইডার্সের ড্রেসিং রুমও উচ্ছ্বসিত। গোটা দলের মধ্যেই এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে। হ্যাঁ, টিম আগের সিজনগুলোর মতো মারকাটারি নয়। কিন্তু তবুও আমরা পারি। পারি চ্যাম্পিয়নদেরও গুঁড়িয়ে দিতে। মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। রিঙ্কু সিংকে কে-ই বা চিনত! বিরাট বা শুভমান গিলের মতো জাতীয় ক্রাশ হওয়ার মতো চেহারা নয় তাঁর। বরং ছাপোষা মধ্যবিত্ত একটা আমেজ লেগে রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য পাঁচজন সাধারণ যুবকের মতোই ছিল তাঁর যাত্রা। সাধারণ? খানিক ভুল হল। অমানুষিক সেই যাত্রার প্রতিটা পর্যায়ে ছিল বাধা, ছিল দারিদ্র্য।
এই তো কয়েক বছর আগের কথা। কেন রিঙ্কু সিং-কে দলে নিয়ে রেখেছে কেকেআর? সেভাবে খেলতেও পারছে না; তবুও তাঁকে বসিয়ে রেখেছে। দলে বারবার তাঁকে জায়গা দেওয়া হচ্ছে। কেন? কেন? সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ট্রোলের বন্যা, রিঙ্কুকে নিয়ে বেরোচ্ছে নিত্যনতুন মিম। আজ যারা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁদেরও অনেকেই সেই ট্রোল শেয়ারও করেছিলেন। একটাই প্রশ্ন, কেন রিঙ্কু সিং? কেকেআর কর্তৃপক্ষের নিশ্চুপ মন্তব্য ছিল, ভরসা রাখো। যে কোনও খেলোয়াড় বা মানুষ, তাঁর মধ্যে যদি সামান্য কোনও প্রতিভাও থাকে, তাহলে তাঁকে যত্ন করতে হয়। সময় দিতে হয়। যেভাবে মাটিতে বীজ পোঁতার পর ধৈর্য ধরতে হয় গাছের জন্য। চাষিদের চোখের মতো সেই ধৈর্যই রিঙ্কুর ওপর দেখিয়েছিল কেকেআর। পাঞ্জাবের হয়ে একটা ম্যাচও না খেলা এই তরুণকে ৮০ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছিল তারা।
প্রথমে আশানুরূপ ফল আসেনি ঠিকই। কিন্তু ২০২২ আইপিএলের মাঝামাঝি সময় থেকে একটু একটু করে পরিস্থিতি বদলাল। সমস্ত ট্রোল, ব্যঙ্গচিত্র গেল বদলে। রিঙ্কু সিং উপহার দিতে লাগলেন একের পর এক ঝোড়ো ইনিংস। আর তারপর? ২০২৩-এর আইপিএলে কেকেআরের শুরু থেকেই অন্যতম ভরসার মুখ তিনি।
আরও পড়ুন : আইপিএল মানেই গ্যালারি জুড়ে সেই ভেঁপুর মিউজিক! বিখ্যাত সুরটির পেছনে রয়েছে কোন ইতিহাস?
আকাশের দিকে মুখ করে রিঙ্কুর কান্না মনে করিয়ে দিচ্ছিল সমস্ত মধ্যবিত্তের হেরে যাওয়ার দৃশ্য। খড়গপুর স্টেশনে টিকিট চেকারের কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠা অজানা, অচেনা মহেন্দ্র সিং ধোনির কথা। আমরা, মানে এই মধ্যবিত্তদের লড়াই যে অনেক। একটা সময় ক্রিকেট খেলতে নামলেই বাবার মার ছিল সঙ্গী। পরে সেই বাবাকেই জাপটে রাখেন রিঙ্কু। হ্যাঁ, আমি পেরেছি। পেরেছি জিতিয়ে দিতে। দাদার হাত ধরে ঝাড়ুদারের কাজে নামা সেই দিনগুলোকে হারিয়ে দিতে পেরেছি।
রিঙ্কু সিংয়ের উত্থান বেশ চমকপ্রদ। গলি থেকে খেলতে খেলতে উত্তরপ্রদেশের রাজ্য টিমে উঠে আসা। সেখানেই পাকাপাকিভাবে নিজের জায়গা করে নেওয়া, লড়ে যাওয়া। কিন্তু ভারতের মতো দেশে ক্রিকেট তো ধর্ম। আর তার সাধকের সংখ্যাও অনেক। তাই লড়াই জারি থাকে। লড়াই চলছে আজও। মনে পড়ে ২০১৯ সালের কথা। বিসিসিআইকে না জানিয়েই আবু ধাবিতে রমজান টি-২০ লিগ খেলতে চলে যান। ব্যস, রোষানলে পড়েন রিঙ্কু। তিন মাসের জন্য তাঁকে ব্যান করে দিয়েছিল বিসিসিআই।
আর তারপর? পাঁচটা ছয়ের সেই দৃশ্য এখন সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিঙ্কু সিং আসলে আমাদের প্রতিনিধি। আমরা, যারা বারবার হেরে যাই। একের পর এক আঘাত সহ্য করে, রক্ত, কান্না ঝরিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করি। এই পাঁচটা ছয় আসলে সপাটে চড় তথাকথিত সমাজের গালে। ছুরির আগাহত এরপরেও আসবে। ঝড় এসে তছনছ করে দেবে বাড়ি। তবুও, ‘করব লড়ব জিতব রে’। হ্যাঁ, রিঙ্কু সিংদের মন্ত্র এটাই।