ঋত্বিক না সত্যজিৎ, দ্বৈরথ পেরিয়ে দুই স্রষ্টাকে খুঁজবে বাঙালি?
Ritwik Ghatak Birth Anniversary: আমি ঋত্বিক দেখতে শিখেছি বলেই সত্যজিৎকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছি।
অযান্ত্রিক, ১৯৫৮। জগদ্দল বিমলের কথা শুনছে না। যন্ত্রটি কোনও এক কারণে তার মানুষবন্ধুর প্রতি উদাসীন হয়ে গেছে। এতক্ষণ বিমলের ছিটেল ব্যবহারকে দেখছিল একটা পটভূমি, সেই পটভুমির মানুষ। ছবিজুড়েই মনে হয়, কারা যেন দেখছে, এবং তাদের দেখাটা আর পাঁচটা মানুষের মতো নয়। ইমেজ, সম্পাদনা, শব্দ- সবকিছুতেই যেন অচেনা কোনও এক দৃষ্টির ছাপ। এইবার সেই দৃষ্টি শব্দপট, চিত্রপট, কাহিনিপট ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। আধুনিক মানুষের যন্ত্রের প্রতি প্রেমকে এবং সেই প্রেমের ভাঙনকে দেখে চলেছিল সেই দৃষ্টি, যাদের পাথর-নদী-গাছকে আপন করে নেওয়ার ইতিহাস সেই আদিকাল থেকে। যেই জগদ্দল আর বিমলের বিযুক্তি স্পষ্ট হলো, সেই মুহূর্তে অন্ধকার ফ্রেমে উঠে এলো ওঁরাওদের শিঙা, শুরু হলো তাদের নাচ। যে দৃষ্টি এতক্ষণ দেখছিল, যে দৃষ্টি ছিল এতক্ষণ নীরব ও নেহাতই প্রেক্ষাপট, আধুনিক মানুষের গল্প ফুরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তারা ইমেজ ও সাউন্ডের কেন্দ্রে চলে এল।
পরের বছর, অপুর সংসার। তাড়িত হয়ে কাটা ঘুড়ির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে অপু, অপর্ণার মৃত্যুর পর। এই কিছুদিন আগেই সে ছিল তৃপ্ত যুবক- দরিদ্র, কিন্তু "জীবনবিমুখ হচ্ছে না।" তার প্রকাশিত গল্পের নাম 'মাটির মানুষ'; অথচ তার কন্ঠ থেকেই উচ্চারিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘বসুন্ধরা’-
আমারে ফিরায়ে লহ অয়ি বসুন্ধরে,
কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে,
বিপুল অঞ্চল-তলে। ওগো মা মৃন্ময়ী,
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই;
দিগ্বিদিকে আপনারে দিই বিস্তারিয়া
বসন্তের আনন্দের মতো; বিদারিয়া
এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণ-বন্ধ
সংকীর্ণ প্রাচীর...
প্রকৃতি থেকে ছিন্ন হওয়া সত্তার আর্তি। এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে অপু সচেতন নয়, যেন সত্যজিৎ তার অবচেতনকেই কন্ঠ দিয়েছেন। অপু পুলুকে তার লেখা আশ্চর্য উপন্যাসের কথা বলে, অথচ সেই উপন্যাসের সারমর্ময় একজনও নারীর উল্লেখ থাকে না। অপুর বইয়ের মধ্যে (এইচজি ওয়েলসের 'দ্য আউটলাইন অফ হিস্ট্রি') গোঁজা থাকত একটা পাতা।
আরও পড়ুন: ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ নয়, আজ ঋত্বিককে ভুলতে পারলেই কেন সুবিধা বাঙালির?
অপর্ণার মৃত্যুসংবাদ আসে। অপু হয়তো বোঝে যে, এতদিন যাবৎ কোনও নারীর মৃত্যুর পরেই সে পরিপূর্ণ শোকযাপন করেনি, নিজেকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল মাটিতে তাদের স্মৃতিকে ফেলে রেখে। এইবার আর তার এগোনোর কোনও জায়গা নেই। তার সামনেও কোনও মেট্রোপলিস নেই, তার গ্রাম্য অতীতকে সে ছেড়ে এসেছে। সে এবার ছেঁড়া পাতার মতো ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ে, সমুদ্রপারে, জঙ্গলে।
অরণ্যে গিয়ে সে গাছের পাতাকে স্পর্শ করে, যেন চিনতে পারছে না, লেন্সের সুচারু ব্যবহারে তার মাথার পিছনে প্রকৃতিকে ঝাপসা করে দেয়। সে তার পথের পাঁচালীর খাতার পাতা ফেলে দেয় সূর্যোদয়ের সময়ে। তাকে সতীর মৃত্যুর পরে শিবের মতো লাগে। আর পুরাণে আছে- অপর্ণা ছিলেন শিবের একনিষ্ঠ সাধিকা- সেই সাধনা যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন দিনে একটিমাত্র পাতা খেয়ে দিননির্বাহ করতেন বলে তার নাম অপর্ণা। অপর্নার মৃত্যুর পর গাছের পাতা, খাতার পাতার স্পর্শ অপুর কাছে অচেনা হয়ে যাবে- তা আর আশ্চর্যের কী? সত্যজিতের অপু তো নারী-প্রকৃতি-বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে আধুনিকতা অর্জনের মোহে।
তাই যখন পুলুর সঙ্গে তার দেখা হয়, পুলু তাকে কাজলের দায়িত্ব নিতে বলে- তার এই বিযুক্তি কন্ঠে চলে আসে- সে স্বীকার করে যে, কাজলের অস্তিত্ত্বের অর্থ তার কাছে অপর্ণার না থাকা ছাড়া কিছুই নয়। সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আর কী আশ্চর্য! শব্দপট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে সাঁওতাল উপজাতিদের গান!
সেই উদযাপন এই বিরহ-বিচ্ছিন্নতার প্রতি উদাসীন (গোদারীয় ঢং-এ সেই গান আচমকা থেমেও যায়, এবং মন দিয়ে শুনলে বুঝবেন যে ভেসে আসে নিশ্চিন্দিপুরের ঝিঁঝিঁ আর শেয়ালের ডাক)। সত্যজিৎ কি ঋত্বিককে 'উদ্ধৃত' করলেন? 'পথের পাঁচালী' না হলে 'অযান্ত্রিক' হয় না কেন- সেই নিয়ে ব্যাখ্যা করার পরিসর এই লেখায় নেই; এতটাই বলার- ছবির পর ছবিতে ল্যান্ডস্কেপ, প্রকৃতি-সংলগ্ন মানুষ, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন আধুনিকতায় কিছু সংলাপ চলছে সিনেমার ভাষায়।
১৯৬০। পাশাপাশি দু'টি ছবি নির্মিত হচ্ছে, যেন যমজ বোন, দু'টি ছবিই পিতৃতন্ত্র কীভাবে নারীর ওপর দেবীত্ব আরোপ করে অতঃপর ভাসান দেয় তা নিয়ে- 'দেবী' আর 'মেঘে ঢাকা তারা'। গত এক দশক ধরে ক্লাসরুমে দেখাই, কীভাবে দুর্গার মৃত্যুর দৃশ্য আসলে গৌরীদানের গানের মতো ('আয় লো উমা কোলে লই')। যদি আরোপিত লাগে- তাহলে বিনীতভাবে জানাই যে, গৌরীদানের গানের উৎস সেই বল্লাল সেনের আমলে, যখন আজকে আমরা যাকে হিন্দুত্ব বলি, তা আরোপিত হয়েছিল বাংলায়, কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের ফলে বহু গৌরী হতো পিতৃভিটে থেকে উচ্ছেদ, তেমনই নির্মিত হতো বহু অকালবিধবা- যাদের নামে বিভূতিভূষণের উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়- 'বল্লালী বালাই'।
যাই হোক, 'মেঘে ঢাকা তারা'-র দ্বিতীয় শট- নীতার বিশাল মুখ যেন জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা, আর তাকে আবাহন করছে শঙ্করের গান। নীতা এবং শঙ্কর, ভাই আর বোন (পরের ছবিতে- "তুমি আমার মায়ের ছেলে") -আর প্রেক্ষাপটে হরাইজন্টালি চলে যায় ট্রেন। 'পথের পাঁচালী' মনে পড়বে না?
১৯৬২, 'সুবর্ণরেখা'। সীতা আর অভিরাম বেড়ে উঠেছিল ভাই আর বোনের মতোই। ছোটবেলায় সীতা যেন অভিরামের চাইতে একটু লম্বা। পোস্টারে সিল্যুয়েটে অপু আর দুর্গার মতোই লাগে। ১৯৫৫-তে ভাই আর বোন আধুনিকতার যন্ত্রদানব হিসেবে ট্রেন দেখে ফেলে, আর এইখানে রানওয়েজুড়ে পড়ে আছে শুধু ছেঁড়া ইতিহাস, যুদ্ধপ্লেনের ধ্বংশাবশেষ। অভিরামও অপুর মতোই আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখছিল। কিন্তু ভাবছি অন্য দৃশ্য নিয়ে।
'বল্লালী বালাই'-এর শেষে ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু হয়, আর অপু ট্রেন দ্যাখে 'অক্রুর সংবাদ'-এ। কেন সত্যজিৎ এই দু'টি দূরতর দৃশ্যকে এক জায়গায় আনলেন? আমার ব্যাখ্যা- এখানে সত্যজিৎ একটিমাত্র লাইনকে 'অ্যাডাপ্ট' করেছিলেন- ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর সঙ্গে নিশ্চিন্দুপুরে 'সেকালের অবসান' ঘটার লাইনটা। এইটা আমরা ভুলে যাই যে, যখন অপু ট্রেন দেখছে, আসলে তখনই বাঁশবনে ইন্দিরের শেষ নিঃশ্বাসগুলি উঠছে; তাই ইন্দিরের মৃত্যুকে 'চিহ্নিত' করে ট্রেনের 'একালের আগমন'।
কেন এটা মনে হয় আমার? কারণ আমি 'সুবর্ণরেখা' দেখেছি। দেখেছি, ঋত্বিক প্রফেটিক হচ্ছেন। ঋত্বিক দেখছেন সাতের দশককে, কীভাবে দণ্ডকারণ্য থেকে ট্রেন ফিরে এলে রেখে দেয় উচ্চবর্ণ রিফিউজিদের দ্বারা ত্যাজ্য নিম্নবর্ণ উদ্বাস্তুর লাশ- বাগদি বউ মারা যায়। 'সুবর্ণরেখা'-র পারে ভারতবর্ষের সেকালের অবসান হয়। খুব কি অচেনা লাগে, যখন সেই মৃত্যুর পর দেখি ট্রেন এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় ফ্রেমকে? এই ট্রেন বিভূতিভূষণের ট্রেন নয়, এই ট্রেন সত্যজিতের ট্রেন।
খুব কি অচেনা লাগে, যখন সেই মৃত্যুর পর দেখি ট্রেন এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় ফ্রেমকে?
আপাতত থাক। 'অপুর সংসার'-এর শেষ দৃশ্য আর 'সুবর্ণরেখা'-র শেষ দৃশ্য নিয়ে অনেক কথা বলা যায়।
কৈশোর পেরনোর পর সেই নয়ের দশক থেকে দেখে আসছি যে, বিদগ্ধ বাঙালির অন্যতম ভিত হলো ঋত্বিক-সত্যজিৎ দ্বৈরথ। এখন সেসব শুনে ক্লান্ত লাগে, আর খানিক রাগ হয়, কারণ আমারও এই দ্বৈরথের মধ্যে বালখিল্য অংশগ্রহণ করে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, আমার দেখা নষ্ট হয়েছে। যাঁরা স্বেচ্ছায় 'ঋত্বিক দেখি বলে সত্যজিতের ভুল দেখব' শ্লাঘায় জীবন অতবাহিত করলেন, তাঁরা করুন, আমার ক্ষতি হয়েছে। আমি ঋত্বিক দেখতে শিখেছি বলেই সত্যজিৎকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করেছি।
আবার এও আশ্চর্য লাগে যে, এই দু'জন শিল্পীর কাছেই ঔপনিবেশিক আধুনিকতা পর্যালোচনা করার জন্য প্রধান হয়ে উঠেছে নারীর অভিজ্ঞতা (হয়তো দুজনেই, নিজেদের মতো, নিবিষ্ট রাবীন্দ্রিক বলে)- অথচ 'ঋত্বিক ফ্যান ক্লাব' বলে যাদের দেখেছি, তা মূলত 'বয়েজ ক্লাব', (দ্বিধা নেই বলতে যে টক্সিক বয়েজ ক্লাব) যাঁরা একজন নারীকেও জিজ্ঞেস করেন না যে, তাঁরা ঋত্বিক কীভাবে দেখেছেন।
একজনের জন্মশতবর্ষ গেল, তিনি তো বাঙালি কালচার ও ইন্ডাস্ট্রির এটিএম-এ পর্যবসিত হয়েছেন। আরেকজনের জন্মশতবর্ষ আসছে; সেই সময়ে হয়তো বলা হবে, কীভাবে তিনি 'হিন্দু' উদ্বাস্তুদের কথা বলেছেন। 'বয়েজ ক্লাব' চিৎকার করবে যে, তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন! অথচ জীবনী দিয়ে নয়, ছবি দিয়েই প্রমাণ করা যায় (হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা কিন্তু ছবি দিয়েই প্রমাণ করবে)। 'মেঘে ঢাকা তারা'-তেই ঋত্বিক দেখিয়েছেন যে, যেভাবে ১৯৪৭-এ দেশচ্যুত হয়েছেন বহু মানুষ, সেভাবেই পাঁচশো বছর ধরে প্রতিটি হিন্দু ঘরের নাবালিকা মেয়েকে কীভাবে উদ্বাস্তু করা হয়েছে গৌরীদানের নামে। সে যাই হোক- বাঙালি টেক্সট না পড়ে জীবনী দিয়ে, তথ্য দিয়ে ব্যাখ্যা দিতে পছন্দ করে। এই যে আমার এই ক্ষুদ্র লেখা, এর প্রধান সমালোচনা হবে- সত্যজিৎ বা ঋত্বিক কি এভাবে ভেবেছিলেন?
সে প্রমাণ আমি দিতে পারব না। সে প্রমাণ আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়। আমার কাছে বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠ সময়ের কিছু অবলম্বন আছে; এবং প্রতি বছর ক্লাসরুমে ছবিগুলির নতুন নতুন মাত্রা উন্মোচিত হয়। এবং আমি দেখি যে, এই ছবিগুলির মধ্যে সিনেমার ভাষায় ইতিহাস নিয়ে কিছু নিরুচ্চার সংলাপ চলছে। কীভাবে তাঁরা বিরোধী, এইটা নিয়ে নারদ-নারদ করার চেয়ে, কীভাবে তাঁদের ছবি বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম অস্থির এবং উত্তেজক একটি দশক, চারের দশকের উত্তরাধিকারী, তা দেখলে হয়তো অকাজ হতো না।