এসেছিল এলিজাবেথের অতিথি হওয়ার সুযোগ! চার্লস-ডায়নার মতো রাজকীয় বিয়ে আর কখনও দেখিনি
Amar Sangbadik Jibon: এমন বিয়ে জীবনে সেই প্রথম ও শেষ দেখেছি।
গৌরদা, মানে গৌরকিশোর ঘোষ, কী করে পরাবাস্তবটি আমার জীবনে ঘটিয়েছিলেন, আজও হদিশ পাইনি। আমি ‘আজকাল’ সংবাদপত্রের সহ-সম্পাদক। গৌরদা সম্পাদক। আমি স্কটিশ চার্চ কলেজে ষোলো বছর ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোর পর সেই চাকরি রাতারাতি ছেড়ে সাংবাদিকতায় চলে এসেছি গৌরদার ডাকে। গৌরদা সেদিন অফিসে ঢুকেই আমাকে ডাকলেন তাঁর ঘরে। একটি খাম হাতে দিলেন। আমার নামে। খুলে দেখি, নিমন্ত্রণপত্র। হার ম্যাজেস্টি কুইন এলিজাবেথের নিমন্ত্রণপত্র। তিনি আমাকে তাঁর ছেলে চার্লসের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে বলেছেন! আমি অবাক হয়ে গৌরদার দিকে তাকাই।
শোন, এই চিঠিটা পাওয়া গেল, এবার আর ব্রিটিশ ভিসা পেতে তোর অসুবিধে হবে না।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু এই চিঠিটা পেলেন কী করে?
গৌরদা তাঁর সেই উত্থল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন চশমার ভেতর থেকে। এই দৃষ্টিপাতে অবশ হবে না এমন প্রাণী পৃথিবীতে নেই।
অযথা কৌতূহল ভালো না। ব্রিটিশ ভিসাটা যত তাড়াতাড়ি হয় সেই ব্যবস্থা কর। তুই যাচ্ছিস। বিয়েটা কভার করবি আমাদের জন্য। তুই তো বেশ কিছুদিন লন্ডনে সম্প্রতি ছিলি। তাই তোকেই পাঠাচ্ছি।
আমি আর কথা বাড়াইনি। সত্যিই ভিসা পেতে কোনও অসুবিধে হল না। স্বয়ং রানি এলিজাবেথের নেমন্তন্ন। আমাকে বাধা দেবে কে?
লন্ডনে পৌঁছলাম বিকেলবেলা। ধূসর আকাশ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। স্যাঁতস্যাঁতে বিকেল না বিষণ্ণ সন্ধে, বোঝা দায়!
গৌরদা বলে দিয়েছেন, স্ট্র্যান্ডের ওপর ইন্ডিয়া হাউজে উঠবি। ওখানে বেশ সস্তায় থাকা যায়।
কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করেছি, বাকিংহাম প্যালেস থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে থাকব। যাতে বিয়েটা কভার করতে সুবিধে হবে। বিয়ে তো কাল। অনেক সময় আছে। বিয়ে কভার করেই ফিরে যাব, এমনও নয়। অন্তত তার পরেও সাত-আটদিন থাকব, গৌরদাকে বলে এসেছি।
রোজ কিন্তু নতুন লেখা পাঠাতে হবে, বলেছেন গৌরদা।
অবশ্যই, বলেছি আমি।
ভাগ্য ভালো, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই পেয়ে গেলাম মিনি ক্যাব। লন্ডনে বিখ্যাত কালো ট্যাক্সি, দরজা সামনের দিকে খোলে, সেই ট্যাক্সি শুধুমাত্র বেজায় ধনীদের জন্য। একবার সঙ্গে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে চড়ে যে কী বিপদে পড়েছিলাম! ককনি ড্রাইভার আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ইউ হ্যাভ এ লেডি উইথ ইউ স্যর, সো ইউ গো এ লিটল মোর!
আমি তো হাঁ!
আমি যে মিনি ক্যাবটি পেয়েছি, তার ড্রাইভার হ্যান্ডসাম পাকিস্তানি।
আমি বাকিংহাম প্যালেসের কাছে কোনও সস্তার হোটেলে থাকতে চাই, পাওয়া যাবে? বললাম আমি।
সস্তার হোটেল তো প্যালেসের পিছনেই অনেকগুলো আছে। তবে স্যর, রয়্যাল ওয়েডিং। ট্যুরিস্টের খুব ভিড় হয়েছে। চেষ্টা করি চলুন। পেয়ে যেতেও পারেন।
বেশি চেষ্টা করতে হয়নি। পেয়ে গেলাম ইন্ডিয়ান হোটেল। এক পাঞ্জাবি বুড়ি চালায়।
থাকার একটি ঘর। ছোট্ট একটা বাথরুম। আর সামনে ব্রেকফাস্ট। ব্যবস্থা ভালোই। আমি ঘরে ঢুকেই দিলাম খুলে টিভি।
এ কী! আঁতকে উঠেছি আমি। চার্লস-ডায়নার বিয়ে হচ্ছে!
কিন্তু বিয়ে তো হওয়ার কথা সকালে। এবং কাল সকালে। আজ রাত্তিরে বিয়ে হচ্ছে কেন?
আমি কি সময়, তারিখ সবই ভুল দেখেছি?
নেমন্তন্নর চিঠিটা আবার খুলি। না, ঠিকই তো পড়েছি এবং মনে রেখেছি আমি।
বিয়ে কাল!
তাহলে?
রুদ্ধশ্বাসে দেখতে থাকি চার্লস-ডায়নার বিয়ে। আর খালি মনে হতে থাকে, কী যেন একটা মিসিং!
চার্লস বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণ করতে তোতলাচ্ছেন কেন? দু'-বার ভুল করলেন।
বিয়ের আংটি পরাতেও তাঁর হাত কাঁপল।
ডায়নার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারছি না। এমন সুন্দরী আমি অন্তত জীবনে দেখিনি!
কিন্তু রাজবাড়ির আর কাউকে দেখছি না কেন? এ কেমন বিয়ে?
কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম ঘোষণা: এতক্ষণ আমরা দেখলাম বিয়ের রিহার্সাল। কাল সকালে পরিবেশিত হবে বিয়ের ধারাভাষ্য। লাইভ দেখবেন চার্লস-ডায়নার রূপকথার বিয়ে।
পৃথিবীতে এমন বিয়ের অনুষ্ঠান আগে কখনও হয়নি। পরেও হবে না।
সত্যিই এমন বিয়ে জীবনে সেই প্রথম ও শেষ দেখেছি। আমি ‘সানন্দা’-র জন্য রানি এলিজাবেথের মেজ ছেলে অ্যান্ড্রুর সঙ্গে সারার বিয়েও কভার করেছি। চার্লস-ডায়নার বিয়ের ধারে-কাছেও যেতে পারেনি সেই বিয়ে। তার প্রধান কারণ, ইথার-দুহিতা ডায়না। সত্যিই যেন ইথারের তৈরি শরীর তাঁর। তক্ষুনি মনে হয়েছিল, এ বিয়ে চার্লস কেন, কোনও পুরুষের পক্ষেই সহনীয় হবে না। এত সুন্দরী বউ বাস্তব নয়।
পরের দিন সকালে মাঝে মাঝে ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টি। বাকি সময় ভারি মোলায়েম, নরম রোদ্দুর। রাস্তায় এমন একটা জায়গায় দাঁড়ালাম, যেখান থেকে ডায়নাকে খুব কাছ থেকে দেখা যাবে। তারপর সাংবাদিকদের জন্য তৈরি শিবিরে চলে যাব। সেখানে আরামে বসে বিয়ের ক্লোজ আপ দেখতে পাব টিভিতে। চা, স্ন্যাক্স, বিয়ার, সবকিছুর ব্যবস্থা আছে।
ডায়নাকে আমার আজও মনে পড়ে। বৃদ্ধ অসুস্থ বাবাকে পাশে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে রাজকুমারী চলেছেন রাজকুমারকে বিয়ে করতে।
হাত নাড়ছেন ডায়না কাচের জানলার পাশে বসে। ওই হাসি, ওই নীল চোখ, ওই ভঙ্গি আর বিয়ের ওই পোশাক– সব মিলিয়ে কেমন যেন শৌভিক বাস্তব। যার সবটা সত্য নয়। এমন সুন্দরী নারীকে কি সত্যিই বউ করে ঘরে রাখা যায়? রাখা যায় শুধুমাত্র নিজের করে? শুধুমাত্র নিজের জন্য?
চার্লস-কেও দেখলাম অন্য একটি ঘোড়ার গাড়িতে। এর চেয়ে বেমানান বিয়ে হতে পারে? চার্লস কেন রাজি হলেন? ডায়না অপরূপাকে বিয়ে করতে যাওয়ার মুহূর্তে তাঁর মনে ক্যামিলিয়ার কথা মনে আসেনি? ক্যামিলিয়ার সঙ্গে তো তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক? তাহলে ডায়নাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন? শুধুমাত্র সেই মেয়ের রূপসাগরে কিছুদিন ডুব দেওয়ার জন্য? তারপর আবার ফিরে গেলেন ক্যামিলিয়ার কাছে! আর ডায়না অসাধারণ আর্দ্র কণ্ঠে টেলিভিশনে বলতে বাধ্য হলেন, মাই ম্যারেজ ইজ এ বিট ক্রাউডেড!
এই নিষ্ঠুর খেলাটা কেন খেললেন চার্লস?