'হিমালয়ের মতো পথ আগলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাই দুম করে মারলাম হিমালয়কে লাথি'

দুর্গাপুজোর মধ্যে চলে গেলেন সুনীলদা। সকালবেলা টিভি চ্যানেল থেকে ফোন, সুনীলদা নেই, কিছু বলবেন?

তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলী লুটোয় পাপোশে

কী অসীম সাহসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন এই কবিতার লাইন! মনে আছে, সেদিন আমাদের কলেজে স্ট্রিট কফি হাউসের সেই জমজমাট, তর্কাতর্কি, আড্ডা, উত্তাপ। কলকাতা তখন ছিল অন্যরকম। অন্যরকম ছিল বাঙালির অন্যায়, বাঙালির পাপ, বাঙালির ভাবনা, বাঙালির যৌবন।

সুনীলদার এই লাইন আজও আমাকে হন্ট করে। আমাকে ধাক্কা দেয়। আমাকে তোলপাড় করে। আমাকে উপড়ে ফেলে। আমাকে ঠেলে দেয় এই প্রশ্নে, সুনীলদা কী করে পারলেন লিখতে এই ভয়ংকর লাইন?

"আরে আসল ব্যাপারটা হলো, সেদিন ছিলাম তারাপদ রায়ের বাড়িতে। প্রচুর পান করে ছিলাম। রাত্তিরে শুতে গিয়ে দেখি খাট ভর্তি বই। শোব কোথায়? লাথি মেরে বই সরালাম। তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলী ছিল। এই আর কী।"

আরও পড়ুন: প্লেনে দু’জনে দাঁড়িয়ে গল্প করেছিলাম, অপর্ণার মতো বন্ধু হয় না

এতো সহজে পার পেতে দিইনি সুনীলদাকে। বললাম, এইসব গল্প বলবেন না। ঝেড়ে কাশতে হবে। ঝেড়ে কেশেছিলেন সুনীল দা। বললেন, হিমালয়ের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। এই ফিলিং আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল। সামনে এগোতে হবে তো। তাই দুম করে হিমালয়কে মারলাম লাথি।

এই সুনীল গাঙ্গুলির সঙ্গে এক বাড়িতে কাজ করেছি ষোলো বছর। আনন্দবাজারের বাড়ি। প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক আগে থেকেই সুনীলদাকে চিনি। সে আর এক গল্প।

তখন নিয়মিত লিখতাম 'আনন্দলোক' পত্রিকায়। কখনও উত্তমকুমার, কখনও সুচিত্রা সেন, কখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পাশাপাশি ইংরেজি পড়তাম স্কটিশ চার্চ কলেজে। একদিন ডাকলেন আমাকে সাগরময় ঘোষ। 'দেশ' পত্রিকার রাশভারী সম্পাদক। বললেন, তোমার লেখা আনন্দলোকে পড়ি। তোমার বাংলাটা ঠিক আনন্দলোকে মানায় না। তুমি নিয়মিত দেশে লিখবে।

আমি তো অবাক! নিয়মিত কী লিখব?
ফিল্ম রিভিউ! বললেন সাগরময় ঘোষ।

'দেশ' পত্রিকায় লেখা শুরু হলো আমার। আর আমার আলাপ হলো সুনীলদার সঙ্গে। সুনীলদা একদিন বললেন, বেশ হচ্ছে তোমার লেখা। একেবারে অন্যরকম। তুমি তো টালিগঞ্জের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ। সাংঘাতিক রিঅ্যাকশন হয়েছে।

অজয় কর পরিচালিত 'দত্তা' মুক্তি পেল। আর রিভিউর ভার পড়ল আমার ওপর। আমি নিদারুণ সমালোচনা করলাম। তপন সিংহ আমার সমালোচনা করে দেশে চিঠি লিখলেন। সাগরদা খুব গম্ভীরভাবে জানালেন, তোমাকে আর ফিল্ম নিয়ে লিখতে হবে না।

আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। আমি সুনীলদার ঘরে, যে ঘরে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও বসতেন, চুপ করে বসে আছি।

সুনীলদা বললেন, খুব মন খারাপ লাগছে?

আপনি কী করে জানলেন?

সাগরদা আমাকে বলেছেন। আপাতত কিছু করার নেই। তপন সিংহর ওই চিঠিটা পড়ে এছাড়া কিছু উপায় ছিল না। খুব কুৎসিত চিঠি। কিন্তু কী করা যাবে!

পরের সপ্তাহে দেশে ছাপা হলো আমাকে দারুণ সাপোর্ট করে পূর্ণেন্দু পত্রীর চিঠি। সকালেই ফোন করলেন সাগরদা। চলে এসো অফিসে। তুমি আবার লিখবে।

সাগরদার ঘরে যেতেই উনি বললেন, কালকেই একটা রিভিউ জমা দাও। আর সুনীলের সঙ্গে দেখা করে এসো। পাশের ঘরেই সুনীলদা। আমাকে দেখে কী যে মধুর হাসলেন। বললেন, আর মনখারাপ নেই তো?

আমি বললাম, পূর্ণেন্দু পত্রী কী দারুণ লিখেছেন।

পূর্ণেন্দু একটু আগে এই ঘরে এসে তোমার খোঁজ করছিল। যাও, দেখা করে এসো।

মনে আছে, সেইদিন সন্ধ্যায় পূর্ণেন্দু পত্রী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর আমি এলফিন বারে বসে অনেক মদ খেয়েছিলাম। সেই কলকাতা কী আর ফিরবে?

এখানে একটা কথা বলি, একদিন ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেক করে বললেন, রঞ্জনদা, দেশ পত্রিকায় লেখা তোমার রিভিউগুলো বই হয়ে বেরনো উচিত। সেই লেখাগুলো সেইসব লেখা নামে বেরিয়েছে দীপ প্রকাশন থেকে। তাতে তপন সিংহর সেই চিঠি আছে। আর আছে পূর্ণেন্দু পত্রীর মোক্ষম উত্তর। সুনীলদাকে দিয়েছিলাম সেই বই। মনে আছে তাঁর আহ্লাদ। তখন অবশ্য পূর্ণেন্দুদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।খুব মন কেমন করে সেই কলকাতার জন্য।


রানু ও রবির প্রেম নিয়ে প্রকাশিত হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা। আমি দেখলাম, সুনীলদা ভীষন বাঁচিয়ে লিখেছেন। এড়িয়ে গেছেন অনেক কিছু। আমি সুনীলদাকে বললাম, আপনি কি রানুর সেই চিঠিটা পড়েননি, যে চিঠিতে রানু রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, তোমার সঙ্গে তো আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তোমার বুকের কাছেই মরতে চাই।

সুনীলদা খুব গম্ভীরভাবে বললেন, পড়েছি।

আমি বললাম, আপনার লেখা পড়ে কিন্তু মনে হলো, এই চিঠিটা আপনি পড়েননি। বা ইচ্ছে করে ভুলে গেছেন।

সুনীলদা বললেন, আরে রবীন্দ্রনাথকে বাঁচাতে হবে তো! বললেন সুনীলদা।

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথকে বাঁচানোর দায়িত্ব আপনি নিলেন কেন? উনি যুগ যুগ ঠিক বেঁচে থাকবেন।

আমি একটা টিভি চ্যানেলে শুরু করলাম 'আমার রবীন্দ্রনাথ' নামে এক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান। সুনীলদার কথা দিয়ে শুরু হলো সেই ধারা বহিক।
প্রায় ঘণ্টা দুই সুনীলদা একটানা বললেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা কথা। এবং বললেন, সাহসী রবীন্দ্র-বিরোধী অনেক কথা। তারপর হঠাৎ , অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে বললেন, রবীন্দ্রনাথের জীবনে কত ব্যথা, কত অপমান আর বিচ্ছেদ-বেদনা। নীরবে সয়েছেন! আহা, কী জীবন, কী জীবন।

সুনীলদার সঙ্গে আমার অনেক ইন্টারভিউ ইউটিউবে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে দেখি। এইভাবে ফিরে দেখি ওই সুনীলদাকে। পালাতে পারি আজকের কলকাতা থেকে।

মনে আছে, যেদিন আনন্দবাজার অফিসে চাকরি পেয়ে সুনীলদার ঘিরে ঢুকলাম, উনি আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, এসো এসো, নরক আরও গুলজার হলো।

দুর্গাপুজোর মধ্যে চলে গেলেন সুনীলদা। সকালবেলা টিভি চ্যানেল থেকে ফোন, সুনীলদা নেই, কিছু বলবেন?

সেই ধাক্কা আমি আজও সামলাতে পারিনি। আজও চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।

কী বলব আমি?

More Articles