শত সংঘাতের পরেও সুন্দরবন জানে, বাঘ না বাঁচলে বাঁচবে না সাধের জঙ্গল
একটি 'আমব্রেলা স্পিসিস' ( যে প্রাণীটি জঙ্গলকে ছাতার মতো আগলে রাখে, সুরক্ষা দেয়, স্থায়িত্ব দেয়) কেবলমাত্র জঙ্গল নয়, জনজীবন ও তাদের লৌকিক কথকতাকেও কীভাবে প্রভাবিত করে চলেছে যুগে যুগে কালে কালে।
প্রথমে বন্দনা করি, ধৰ্ম নিরঞ্জন।
তার পরে বন্দনা করি, সরস্বতীর চরণ।।
তার পরে বন্দনা করি, বনবিবির চরণ।
পূবেতে বন্দনা করি, উদয় দিনমনি।।
পশ্চিমে বন্দনা করি, উদয় অস্তমনি।
উত্তরে বন্দনা করি , হিমালয় পর্বত।।
দক্ষিণে বন্দনা করি, দক্ষিণ রায়ের চরণ।
এই পর্যন্ত বন্দনা আমরা অল্পে সাঙ্গ করি গো
মুসলমান বলুন গো আল্লা, হিন্দু বলুন হরি।।
শিতালী সন্ধ্যাবেলায় সোনারপুর পেরিয়ে ক্যানিং লোকাল যখন ঘুটিয়ারী স্টেশন কিংবা তালদীর কোল ঘেঁষে দৌড় মারে, দূর থেকে আবছা কুয়াশার মতো হয়তো ভেসে আসে এই বন্দনাগানের কিছু কলি। চারদিকে চারটে খুঁটি- কালো ত্রিপলের আচ্ছাদন, দু'পাশে বাঁধা দু'খানি হ্যাজাক লাইট। খেজুরপাতার চাটাইয়ে বসা বাজনদারের দল, তাঁদের একজনের হাতে লম্বা কালো একটা যন্ত্র- ফুলেট। পালায় তখন প্রাণভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে বালক দুখে। পিছনে রঙচঙে মুখোশপরা দক্ষিণরায়- যখন দুখে প্রায় দক্ষিণরায়ের হাতের নাগালে, তখনই রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ শাহ জঙ্গালীর, সে কী ভয়ানক যুদ্ধ তারপর!
সাগরদ্বীপ থেকে পাথরপ্রতিমা, গোসাবা থেকে কাকদ্বীপ- এই দৃশ্য অত্যন্ত পরিচিত। 'বনবিবির পালা'- সুন্দরবন অঞ্চলের লৌকিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য এক অঙ্গ। কেবলমাত্র বনবিবির পালা-ই নয়, রায়মঙ্গল কাব্য, মনসামঙ্গল কাব্য, দক্ষিণরায়ের পালা, হরেক কিসিমের পীর ও গাজীপালা- ইত্যাদি বিবিধ লোকায়ত পালাগানের মাধ্যমে বাদাবনের চরিত্র, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সর্বোপরি বাঘ ও তার পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্রের কালানুক্রমিক বিবর্তনের একটি সুস্পষ্ট ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আরও পড়ুন: মানুষখেকো বাঘ বলে কিছু হয় না…
যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া বন্ধ করে আসল বিষয়ে আসি। সুপ্রিয় পাঠক, ইতোমধ্যে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে- বাঘ নিয়ে লিখতে বসা লেখায় এত পালাগান, ইতিহাস, লোকগীতির কচকচানির প্রাসঙ্গিকতা কী? প্রাসঙ্গিকতা আছে, প্রবলভাবেই আছে। বাদাবনের ইতিহাস, জল-জঙ্গলের কাহিনি যদি ইতিহাসের হলুদ হয়ে আসা পাতাগুলো উল্টে খুঁজতে বসি, তাহলে দেখব বাঘ এবং জঙ্গল, তার হাতে হাত ধরে কালে কালে আবর্তিত হয়ে আসছে সুন্দরবনের মানুষের সমাজ, জীবন ও জীবিকা- আর এই যাত্রাপথের জ্বলন্ত দলিল লৌকিক উপকথা ও পালাগানগুলি। সুন্দরবনের লৌকিক উপকথা নিয়ে লিখতে বসলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ ফুরোবে, কলমের কালি ভেসে যাবে মাতলা নদীর স্রোতে। আমরা মূলত বনবিবি ও দক্ষিণরায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব আমাদের আলোচনা, এবং সঙ্গে সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করব বাদাবনের বাঘ ও পরিবেশ সংরক্ষণ ও তার বিবর্তনের চক্র।
দক্ষিণরায়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কিন্তু আজকের নয়। এই বিশ্ব ব্যাঘ্র দিবসের আবহে, নোনাজলের ঝাপটায় অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে কয়েকলাইন কবিতা খুঁজে পেলাম, কবিতা না বলে স্বপ্নাদেশ বলা ভালো- সেই স্বপ্নাদেশ পেলেন কে? মক্কার অধিবাসী বেরাহিম/ইব্রাহিম, যার স্ত্রী ফুলবিবি সন্তানহীন ছিলেন।
দোছরা করিলে সাদি জানিবেক খাটি
তাহার উদরে পয়দা হবে বেটা বেটি।।
যেমন আদেশ তেমন কাজ, ইব্রাহিমের ঘরে এলেন দ্বিতীয় স্ত্রী। 'শাদি' তো হলো, কিন্তু ফুলবিবি মেনে নেবেন এত সহজে? তাঁর ষড়যন্ত্রে গভীর জঙ্গলে ইব্রাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী প্রসব করলেন যমজ কন্যা-পুত্র; বনবিবি ও শাহ জঙ্গালী। অতি দুঃখে দিন কাটে তাঁদের, কিন্তু সবসময় সহায় বনের প্রাণীরা।
বনের হরিণ সব খোদার মেহের
হামেশা পালন করে বনবিবির তরে
বেহেশতের নূর এসে কোলে কাঁখে নিয়া
তুষিয়া মায়ের মত ফেরে বেড়াইয়া।।
অতএব বোঝাই যাচ্ছে, 'খোদার আরশ' অর্থাৎ, আসনে অধিষ্ঠানের ক্ষমতা বনবিবি সঙ্গে নিয়েই জন্মান। সেই খোদার খোদকারিতেই বনবিবি ও শাহ জঙ্গালী এসে উপনীত হলেন সুদূর মক্কা থেকে এক অজানা-অচেনা দেশে, যার নাম 'আঠেরো ভাটির দেশ'- নিত্যদিন জোয়ার-ভাটা খেলা করে যেখানে, আমাদের আজকের সুন্দরবন।
সঙ্গে সঙ্গে সময় এবং সমাজের বিবর্তনটাও লক্ষ করুন পাঠক। সুন্দরবনে জনবসতির হদিশ মেলে প্রায় মৌর্য যুগের কিছু পর থেকে। বনবিবির সঙ্গে সঙ্গেই সুদূর মক্কা থেকে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ এসে পৌঁছলেন এই জল-জঙ্গলের দেশে। এসে দেখলেন চারপাশে শুধুই জল আর ডাঙায় ভয়াল বাঘবাহাদুর, প্রবল পরাক্রমশালী বাঘের সঙ্গে শুরু হলো লড়াই, শেষ পর্যন্ত একটা আপসে আসা গেল বটে- তাড়া খেয়ে বাঘ সেঁধোলো গভীর জঙ্গলে, আর উপকূলের ধার ধরে মানুষ গড়ল তার বসতি।
বাঘ-মানুষের এই অসম লড়াইয়ের দলিল আজও জীবন্ত হয়ে আছে মোহাম্মদ খাতের প্রণীত 'বনবিবির জহুরানামা'-য়। শার্দুলপ্রবর দক্ষিণরায়ের প্রতাপে অতিষ্ঠ মানুষ শরণাপন্ন হলেন বনবিবির এবং প্রবল লড়াইয়ের পর দক্ষিণরায়ের মা নারায়ণীর মধ্যস্থতায় একটা 'মিউচুয়াল সেটলমেন্ট'-এ এলেন তাঁরা, বাঘ চলে গেল গভীর জঙ্গলে।
দক্ষিণের রাজা দক্ষিণরায়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ধপধপিতে যার বিশাল মন্দির। কারও মতে সেই সময় হিন্দু রাজা মুকুট রায়ের আত্মীয় দক্ষিণরায় ছিলেন বাদাবনের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। আবার কেউ বলেন, দক্ষিণরায় মার্জারকুলশিরোমণি শার্দুলঠাকুর স্বয়ং। কবে প্রবলপরাক্রমশালী রাজা এবং বাঘবাবাজি একাকার হয়ে গেলেন, সেই তর্ক গবেষকরা করবেন নাহয়, 'ক্রোনোলজি' অনুযায়ী মোদ্দা কথা হলো, প্রবলপরাক্রমশালী শত্রুকে ঠেকানোর জন্য 'ছাপোষা' বাঙালিদের পূর্বপুরুষদের তখন একটি শক্তির প্রয়োজন ছিল, যার ফলে বনবিবির আসরে আগমন। দক্ষিণরায় সুন্দরবনের নিচের দিকে, অর্থাৎ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুপুরুষ দেবতা হিসেবে পূজিত হন আবার বাদাবন অঞ্চলে তিনি কেবলই বাঘ।
অতএব দেখা যাচ্ছে, একটি 'আমব্রেলা স্পিসিস' ( যে প্রাণীটি জঙ্গলকে ছাতার মতো আগলে রাখে, সুরক্ষা দেয়, স্থায়িত্ব দেয়) কেবলমাত্র জঙ্গল নয়, জনজীবন ও তাদের লৌকিক কথকতাকেও কীভাবে প্রভাবিত করে চলেছে যুগে যুগে কালে কালে। ধর্ম-মানুষের কালাপানি পার হওয়ার বৈতরণী, কিন্তু যখন নিরাপত্তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে গড় করে প্রকৃতিদেবীর পায়ে। তাই খুব সম্ভবত সুন্দরবনই একমাত্র জায়গা এই পৃথিবীর, যেখানে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ মুর্তিপূজায় বিশ্বাস করে। হিন্দু-মুসলিম সকলের ঘরের মেয়ে বনদেবী বা বনবিবি। আর লোনা মাটির গন্ধমাখা, ঝড়ের দ্বীপের মানুষ এটাও জানে যে, বাঘ না বাঁচলে বাঁচবে না তাদের জঙ্গল, গাছপালা- শেষ হয়ে যাবে আদরের বাদাবন। তাই আজও, বিস্তীর্ণ নাইলনের জাল ভেদ করে বাঘ গ্রামে চলে এলেও, মধু-কাঁকড়া সংগ্রহ করতে গিয়ে ঘরের মানুষটা বাঘের পেটে চলে গেলেও তাঁদের সাধের দক্ষিণরায়কে বুক দিয়ে আগলে রাখেন সুন্দরবনের মানুষ।
রোজ রোজ নিত্যদিন ক্যানিং লোকাল এই আলোঝলমলে শহরে ফেরে উপকূলের রোজনামচা লিখতে লিখতে, ঝুপ করে নেমে আসা অকালসন্ধ্যায় বা বৈশাখ মাসের কাঠফাটা দুপুরে ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে আজও শোনা যায় সেই বজ্রনির্ঘোষ,
নিন্দের খুমারো ধোনা হাতে কয়।
আপনি কে বটে মোরে দেহ পরিচয়।।
শুনিয়া দক্ষিণরায় কহে এ প্রকার।
মোম মধু বাদাবনে সৃজন আমার।।
দণ্ড বক্ষ মুনি ছিল ভাটির প্রধান।
দক্ষিণা রায় নাম আমি তাহার সন্তান।।
বেঁচে থাকুক বাঘ, তাকে আগলে সুখে থাকুক সুন্দরী গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া নোনা মাটির মানুষজন।