ভালবাসা মরে গেলেও থাকে স্মৃতিতে! ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা চেনায় অন্য প্রেম

Bhalobasar Karok Prokoron: বিশুদ্ধ ভালবাসা তবু, ভাস্কর জানেন, তা থেকে যায় ভালবাসা মরে গেলে স্মৃতিতেই।

মানুষের মৃত্যু হলে মানব থেকে যায়, তবুও মানব থেকে যায়। কিন্তু ভালবাসার মৃত্যু হলেও কি থেকে যায় ভালবাসা? কোথায় থাকে? কোন কোঠায়?

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'শাশ্বতী' কবিতায় ছিল,

সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না

এই স্মৃতিতেই তো শাশ্বতীর অবস্থান। এই স্মৃতিতেই তো সর্বস্ব। তাহলে ভালবাসার মৃত্যু হলেও, কোনও একজন অপরজনকে ভুলে গেলেও, কেউ ধারণ করতে পারেন সেই চলে-যাওয়া মানুষটিকে স্মৃতিতে। স্মৃতিই তাহলে শাশ্বতীর প্রকৃত আধার! সেই স্মৃতির স্বরূপ কেমন?

সেই স্মৃতি নিহিত না কি প্রতি মুহূর্তে জেগে থাকে? নিহিত স্মৃতি শান্ত। আর প্রতি মুহূর্তে জেগে থাকা স্মৃতি, সে কি বিষণ্ণ করে, না কি অধীর বেদনাবাহী প্রসন্নতায় ডুবিয়ে রাখে মন। ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় ‘হঠাৎ দেখা’ সুপ্ত স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলল। ভাস্করের কবিতায় ভালবাসার মৃত্যুর পর দু'জনের অবয়বের রূপবদল, অবস্থান বদলের ছবি স্পষ্ট বাস্তবতায় ফুটে ওঠে। কিন্তু স্মৃতি? সেখানে যে রূপ ধরা আছে, তা তো এই বদলের স্পর্শহীন। যা দেখলাম আর যা দেখতাম- দুয়ের কথা উঠে আসে ইঙ্গিতে।

শহরের মাথার ওপর দিয়ে সাঁতরে চলেছি
আলো কম-দূরে
বাচ্চাদের হই-হল্লা শোনা যাচ্ছে
এক যুগ পরে আজ তোমাকে দেখলাম

ভাস্করের এই ‘আরেকটি প্রেমের কবিতা’-র শেষ পঙ্‌ক্তিতে কোনও পূর্ণচ্ছেদ নেই। আসলে এই যে একযুগ পরে দেখা, এই দেখার প্রতিক্রিয়া তো ‘ছেদ’ দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যাবে না। স্মৃতি সেখানে খেলা করে যাবে। সেই প্রতিক্রিয়ার কথা, স্মৃতিকাতরতার কথা লেখেননি তিনি এই কবিতায়। কেবল যেখানে প্রচলিত অর্থে ছেদ পড়ার কথা, সেখানে যতিচিহ্ন ব্যবহার করলেন না। জাগর স্মৃতির প্রতিক্রিয়ার কথা লিখেছিলেন অবশ্য অন্য এক কবিতায়। নাম তার ‘আরো প্রেমের কবিতা’।

কলকাতা থেকে লিখি– পুরনো হাতের লেখা – চিনবে নিশ্চয়।
তোমাদের শহরে এখন বাতাস কি?– বৃষ্টি কি?
আমার খেলাধুলায় মন নেই আর।
কেন লিখে জানাও না কার সঙ্গে ফেঁসেছ বিকেলবেলা কাকে তুমি হরদম মিথ্যে বলছ-
মস্করার মধ্যে রেখো না গীতবিতান
ছাড়ো ওই খেলা, শুধু ছেড়ো না আমাকে মরে যাব।

এই একখানা চিঠি। পাঠানোর ইচ্ছে নিয়ে লেখা চিঠি শেষ অবধি না-পাঠানো চিঠি হয়েই থেকে যেতে পারে। দূরত্ব, দু'জনের মধ্যবর্তী দূরত্ব, অতিক্রমের চেষ্টায় পুরনো স্মৃতি উসকে দেওয়ার চেষ্টা। প্রেমের মধ্যে ধরা দেওয়ার ও পালিয়ে যাওয়ার টানাপড়েন থেকে কত মিথ্যে, মশকরা। শেষ পঙ্‌ক্তিতে তীব্র স্বীকারোক্তি ও প্রার্থনা ‘শুধু ছেড়ো না আমাকে মরে যাব।’ কবিতার শুরু তো জানিয়ে দিয়েছে দু'জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দু'জনের মধ্যে দু'-শহরের দূরত্ব। তাহলে কেন উঠল না ছাড়ার প্রসঙ্গ? প্রার্থনা স্মৃতির কাছে – নাছোড় স্মৃতির মধ্যে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে। সেই জাগর স্মৃতি জানিয়ে দিচ্ছে এখন অন্য কারোর সঙ্গে ‘ফেঁসেছ বিকেলবেলা’ কিন্তু তবু স্মৃতি আমাকে ছেড়ো না।

ভাস্কর একদিকে যেমন স্মৃতিকে নিয়ে খেলেন তেমনি আরেক দিকে পরিবর্তিত অবয়বকে, পরিবর্তিত প্রেমহারা সময়কে বিবৃত করেন।

প্রেমিকারা? তারা বা কোথায় যায়?– তারা তো স্ত্রী হয়, আর
পেটে বাচ্চা ধরে।
কথাগুলো, কোথায় হারিয়ে যায়। রান্নাঘরে আলো জ্বলে ওঠে।

(‘প্রেমিকেরা প্রেমিকারা’)


এই যাপনের বাস্তবতার মধ্যে নিজেকে জিজ্ঞাসা তাঁর,

শুধু তুমি, এখনো কেন যে ভাবো, ভালোবাসা

ভালোবাসা মৃতসঞ্জীবনী

(‘মৃতসঞ্জীবনী)

সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় ঘোষণা ছিল, তীব্র ঘোষণা। স্মৃতিতে রেখে দেওয়ার ঘোষণা। ভাস্কর ঘোষণাবিহীন। নিজের সঙ্গে মশকরা করছেন। নিজের বদলে যাওয়া এখনকার যাপনকে মেনে নিচ্ছেন। তবু কোথাও অধিকরণ হিসেবে স্মৃতিকে নিয়ে খেলছেন। সুপ্ত স্মৃতি, জাগরস্মৃতি। সেই স্মৃতি-উচ্চারণের মধ্যে আছে উদাসীন নাগরিক অনাসক্তি খানিক– ঠাট্টা নিজের সঙ্গে, নিজেদের চারপাশের সঙ্গে।

বিশুদ্ধ ভালবাসা তবু, ভাস্কর জানেন, তা থেকে যায় ভালবাসা মরে গেলে স্মৃতিতেই– নিহিত, জাগর অথবা নিহিত-জাগর এই দুই বিপরীতের মাঝখানে আশ্চর্য ধূসরতায়– ভালবাসা থেকে যায়।

যেখানে পায়ের ছাপ পড়ে দেখি সেখানেই রক্ত ফুটে ওঠে

(২২, জিরাফের ভাষা)

এই ভালবাসা– রক্তাক্ত স্মৃতি কিংবা রক্তগোলাপ। অন্তত ভাস্করে– তখনও এমন করে আসেনি আমাদের কাছে স্মৃতিহারা বর্তমান। এখনও কি ভালবাসা স্মৃতিতেই থাকে, না কি মানুষ ভুলে যেতে শিখে ভালবাসা থেকে শিখেছে দূরে যেতে!

More Articles