নর-নারীর মিলন নিয়ে চিত্তপ্রসাদের স্বাধীন ভাবনা মেনে নেয়নি বামপন্থীরা

Chittaprosad: কেনই বা চিত্তপ্রসাদ অস্বীকার করবেন ব্যক্তিমানুষের প্রেমানুভূতি!

নাম তাঁর চিত্তপ্রসাদ। শেষ অবধি ফিরেছিলেন চিত্তের কাছেই– নিজের মনের নিকটে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নীতি আর তত্ত্বের সঙ্গে যদি চিত্তের অমিল হয় তাহলে মনের সেই অমিল নিয়ে দলচর হয়ে থাকতে তাঁর বয়েই গেছে। থাকেননি তিনি, থাকেননি তাঁরা– চিত্তপ্রসাদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দু'জনের কেউই থাকতে পারেননি শেষ অবধি। চিত্তপ্রসাদের তুলি আর সুভাষের কলম তাঁদের ব্যক্তিমনের অনুগত। সেই মন মানুষকে ভালবাসে, মানুষের কাছে যায়।

Subhas Mukhopadhyay

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

চিত্তপ্রসাদ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দুর্দশার ছবি আঁকেন, কৃষক বিদ্রোহের ছবি আঁকেন, আঁকেন কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ছবিও– এইসব ছবিতে বড় হয়ে ওঠে মানুষ, শুধু মানুষ। শ্রমিকদের ছবিতে চিত্তপ্রসাদ কখনও শ্রমভারে পীড়িত মানুষটিকে হেরে যেতে দেখান না– তাঁর ছবিতে মুখ্য হয়ে ওঠে মজুরের সামর্থ। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ। চিত্তপ্রসাদের কাঠখোদাই কুলির ছবিটি দর্শকদের সামনে এল। গরুর গাড়িতে মাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চালক। আর তার সামনে এক মালবাহী কুলি। পিঠে তার মস্ত বোঝা। সেই বোঝার ভার চোখে পড়ে, তবে চোখ টানে কুলিটির সুঠাম পদযুগল। অপূর্ব তার সৌষ্ঠব ও সামর্থ। বোঝাই যায়, ইচ্ছে করেই মালবাহী পশুর সামনে মালবাহী মানুষটিকে বড় করে তুলেছেন শিল্পী। তার ওই পা-দু'টি, শক্তিশালী পা-দু'টি যেন আশ্চর্য সুন্দর ও স্থাপত্যময়। একদিকে সম্পদের অসম বণ্টন, অবসরহীন কায়িক শ্রমে বাধ্য করার নির্মম ব্যবস্থা– তারই মধ্যে শ্রমনিষ্ঠ মানুষটি শরীরের সৌকর্য আর সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিচ্ছেন শিল্পীর চোখে।

Painting

চিত্তপ্রসাদের চোখে নরনারী

চিত্তপ্রসাদ মনে করেন, ‘শুধু মন দিয়ে দেখলেই তা দেখতে পাওয়া সম্ভব...।’ ( ‘চিত্রকরের বিচারে চিত্রসমালোচক’) এই শরীরকে দিনের পর দিন ছবিতে ধরেছেন তিনি– ‘ছবি তো কথা নয়, শব্দ নয়, ছবি দর্শনীয় কাব্য।’– লিখেছিলেন তিনি ‘চিত্রকরের বিচারে চিত্রসমালোচক’ নামের ছোট্ট কিন্তু ধারালো লেখাটিতে।

আরও পড়ুন: ভালবাসা মরে গেলেও থাকে স্মৃতিতে! ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা চেনায় অন্য প্রেম

সেই দর্শনীয় কাব্যে কি কেবল শ্রমের রূপকথা থাকবে, প্রেমের অপরূপ কথা থাকবে না?

সমরেশ বসুর গল্প ‘স্বীকারোক্তি’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, পার্টি কি কঠোর নির্মমতায় স্বাধীন প্রেমানুভূতিকে গলা টিপে মারে। শুধু তাই নয়, প্রেমিকাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেয় প্রেম, ব্যক্তিপ্রেম স্বার্থান্ধ। এই গলা-টেপা যুক্তি চিত্তপ্রসাদ মানেননি, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও না। তাঁরা দু'জনেই টাটকা মানুষটিকে ধরতে চান। সেই মানুষ সমূহের অংশ মাত্র নয়, সেই মানুষ একান্ত, স্বতন্ত্র। চিত্তপ্রসাদের ছবিতে যেখানে কৃষক ও মজুরের শ্রম-অকুণ্ঠ দেহের উদ্‌যাপন, সেখানে সেই মানুষটিকে কেবল সমূহের অংশ বলে মনে হয় না, শ্রেণিচরিত্রে সে অনেকের একজন নয়– ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যে সে একক।

book cover

'দুঁহু ও দোহা'-র প্রচ্ছদ

কাজেই কেনই বা চিত্তপ্রসাদ অস্বীকার করবেন ব্যক্তিমানুষের প্রেমানুভূতি! বন্ধু দেবীপ্রসাদকে ১৯৫১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লিখছেন চিঠিতে,

এখনো আমি খাজুরাহোর নেশায় মশ্‌ত্‌ হয়ে আছি।... চারদিক নির্জন রাত্তির, অন্ধকার পাষাণ মন্দিরে উঠে গিয়ে পশ্চিম মুখো জানলায়– কয়েক শ’ ফিট উপরে– বসে’ বসে’ পঞ্চমীর চাঁদ অস্ত দেখলাম, অপূর্ব সে অভিজ্ঞতা। খাজুরাহোর সে ঐশ্বর্য বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। একটা কথা বারবার মনে হয়েছে ওখানে গিয়ে– (তা আমায় ফিউডাল বলেই হোক কি অন্য যেকোনো গালমন্দই দিন)– মানুষের দেহমনের নিবিড় আনন্দ-বেদনা মন্থিত করে মানুষ জীবন থেকে মণিমানিক তুলে এনে সূর্যের আলোয় অনন্ত আকাশের নীচে তুলে ধরে তা চিরকালই মণিমানিকের চেয়ে মূল্যবান ঐশ্বর্য হ’য়ে থাকে মানুষের রাজ্যে– তার জন্যে যাকে যতো দামই দিতে হোক না কেন। চোখ-মন সব ধাঁধিয়ে গেছে যেন আমার– মানুষ কী সুন্দর– আমাদের পিতৃপুরুষেরা বিশেষ করে’ তাঁদের প্রেয়সীরা কী সুন্দর– কী সুন্দর– মশাই– আমরা কি বেঁচে আছি?

জিজ্ঞাসা তো কেবল দেবীপ্রসাদকে নয়, জিজ্ঞাসা বিশেষ মনোভঙ্গিকে। বামপন্থী দলচারী পার্টিকর্মী, পূর্ববর্তী চরমপন্থী বিপ্লবী, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী- যাঁরা এই প্রেমময় মিলনের সৌন্দর্যকে মানতে দ্বিধাগ্রস্ত, প্রশ্ন তাঁদের প্রতি। রবীন্দ্রনাথ ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে চরমপন্থী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে প্রেমকে স্থাপন করেছিলেন, প্রেম যে বিপ্লবের শত্রু হতে পারে না, সেকথা নিয়ে অনেকদিন আগেই তো তিনি লিখে ফেলেছিলেন নাটক ‘রক্তকরবী’। সেই নাটক বিপ্লবের আবার রঞ্জন-নন্দিনীর প্রেমেরও। গান্ধী তাঁর অহিংসব্রতে নর-নারীর যৌনতাকে যৌন প্রহার বলে ভাবতেন, মিলনের মধ্যে যে স্বেচ্ছায় দু'টি শরীর গলে-মিশে এক হয়ে যেতে পারে, তা যেন অনেকটাই অধরা থেকে যাচ্ছে তাঁর ভাবনায়। মন্দির-স্থাপত্যের অপূর্ব শৃঙ্গারমূর্তিগুলিকে ঢেকে দেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি। ঢাকতে অবশ্য পারেননি। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ- দু'জনেই ভারতবর্ষের বেজে ওঠা পাথরের শৃঙ্গার মূর্তির রূপ আস্বাদন করেছিলেন।

book cover

চিত্রঋণ: চিত্তপ্রসাদ, প্রকাশ দাস সম্পাদিত, গাঙচিল, ২০১১

চিত্তপ্রসাদ অবশ্য এখানেই থেমে গেলেন না। যা দেখলেন, তাকে রূপ দিলেন। দেশ স্বাধীন হলো। ছয়ের দশকের গোড়াতে চারপাশ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর কবিতার বই ‘দুঁহু প্রেম ও দোঁহা।’ ‘শিল্পায়ন’ থেকে প্রকাশিত এই কবিতার বইতে ব্যবহার করা হয়েছিল তাঁরই বাছাই করা কিছু ছবি। ব্যক্তিজীবনে প্রেমানুভূতির অধিকারী হয়েছেন তিনি। সেই প্রেমকে পার্টি, আত্মীয়বন্ধুরা ভালো চোখে দেখেননি। চিত্তপ্রসাদ ‘মানুষের দেহমনের নিবিড় আনন্দ-বেদনা মন্থিত’ করে ছবি আঁকলেন। যে শরীর দিয়ে তিনি শ্রমের উদ্‌যাপন করতেন, সেই শরীর দিয়েই এবার প্রেমের উদ্‌যাপন। লিনোকাট। ছবির মধ্যে স্থাপত্যের মেজাজ। দুটো শরীর– পুরুষ ও রমণী, আশ্লেষে-আনন্দে মিশে যাচ্ছে। প্রেক্ষাপটে আর কিছু নেই। সব অপ্রয়োজনীয়– মুহূর্তটি সত্য। দু'জনের কাছে দু'জন সত্য। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গমনাগমন’ রচনায় কোনারকের দিকে যাওয়া আর কোনারক থেকে ফিরে আসার অনুভূতির বিবরণ লিখেছিলেন। যখন গেলেন, তখন মনে হলো তাঁর,

উর্বর পাথর ফুটিয়া উঠিয়াছে নিরন্তর পুষ্পিত কুঞ্জলতার মতো শ্যাম-সুন্দর আলিঙ্গনের সহস্র বন্ধে চারি দিক বেড়িয়া!

এই শ্যামসুন্দর আলিঙ্গন ‘সকল গোপনতার সীমা হইতে বিচ্ছিন্ন, নির্ভীক, সতেজ, আলোকের দিকে উন্মুখ।’ চিত্তপ্রসাদের ভালবাসার লিনোকাটগুলি তেমনই। পার্টি এই নির্ভীকতাকে ভয় পায়, এই সতেজ আলোকে সামলাতে পারে না। অবনীন্দ্রনাথ যখন কোনারক থেকে ফিরছেন তখন মনে হচ্ছিল তাঁর, ‘উদয়ের পার হইতে আবার সেই পারে; আর একবার সংসারের দিকে, সুরুচি-কুরুচি, শ্লীল-অশ্লীলের দিকে’ ফিরছেন। চিত্তপ্রসাদের পার্টির অধিকাংশ মানুষের মন উদয়ের দিকে না গিয়ে অস্তের দিকে ফিরে তাকায়। ফলে চিত্তপ্রসাদ, মানুষের শিল্পী চিত্তপ্রসাদ তাঁর প্রেমের নির্ভীকতায় দলচরদের কাছে ব্রাত্য।

১৯৭৮। চলে গেলেন। তাঁর প্রয়াণের খবরের জন্য সংবাদপত্র মালিকরা বেশি জায়গা বরাদ্দ করেননি। তাঁর পুড়ে যাওয়ার নীরব শ্মশান সাক্ষী মাত্র ক'জন। সমর সেন, গোলাম কুদ্দুস, খালেদ চৌধুরী, অবনীরঞ্জন রায়।

চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর প্রশ্নটি মরে গেল না।

‘মশাই– আমরা কি বেঁচে আছি?’

More Articles