আপনারা যেখানে থাকেন, সেখানে প্রেম সম্ভব? প্ল্যানচেটে আত্মার কাছে জানতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ

নিজেদের অভিজ্ঞতার অকপট আত্মকথনে প্রেমকে বোঝার চেষ্টা না করে কতগুলি দার্শনিক ধারণার পেছনে ধাওয়া করা। কাকে বলে প্রেম? উত্তর মেলে না।

প্রেম কি আর একরকম? প্রেম নানারকম। নানা জনের কাছে তার নানা রূপ, নানা বয়সে তার নানা চেহারা। প্রেম নিয়ে তাই নানা সময়ে নানা জনের মনে নানা প্রশ্ন ওঠে। দিলীপকুমার রায়ের মনেও উঠত। সেইসব প্রশ্ন উত্থাপন করার উপযুক্ত একজন মানুষ তিনি পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নানা বিষয়ে চিঠি লিখতেন তিনি, রবীন্দ্রনাথও পুত্রপ্রতিম স্নেহভাজন দিলীপকুমারকে যথাসাধ্য উত্তর দিতেন।

দিলীপকুমার তখন পণ্ডিচেরিতে। অরবিন্দ আশ্রম থেকে চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথকে। ১৯২৯ সাল। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় ‘যোগাযোগ’ আর ‘শেষের কবিতা’ এই দুই উপন্যাস লিখে উঠেছেন। ‘শেষের কবিতা’ প্রেমের উপন্যাস আর ‘যোগাযোগ’ ব্যর্থ দাম্পত্যর ইতিকথা। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে টাটকা আধুনিক নর-নারীর ছবি আছে– তাদের মনে প্রেম কী, সে-বিষয়ে কত কী জিজ্ঞাসা।

দিলীপকুমার পণ্ডিচেরিতে আধ্যাত্মিকতার পরিমণ্ডলে বুঝতে চাইছেন আধ্যাত্মিক ভালবাসা আর মানুষী ভালবাসার পার্থক্য। রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন,

একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। প্রেম কি উপলব্ধির পরে থাকে না একেবারে? অর্থাৎ এর মধ্যে personal উপাদানটা কি থাকতে পারে না ? কেন না personal উপাদান না থাকলে তাকে আর প্রেম বলা চলে না – অন্ততঃ এখন প্রেম বলতে আমরা যা বুঝি তা বলা যে চলে না এটা ত নিশ্চয়ই?

আরও পড়ুন: একদিকে উদ্দাম প্রেমের খোলা ময়দান, অন্যদিকে বিরহের নিভৃত কোণ

উপলব্ধি বলতে যে পরম ঐশ্বরিক বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধির কথা বলছেন দিলীপকুমার, তা বুঝতে পারা যায় চিঠির পরের অংশ পড়লে। সেখানে দিলীপকুমারের জিজ্ঞাসা স্তিমিত, নিজেই যেন নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

আমার এক একবার মনে হয় পরম উপলব্ধির আনন্দ এমনই একটা আনন্দ যে সে আনন্দ পাওয়ার পর হয় ত নরনারীর সম্বন্ধ তেমন দরকারই হয় না। কিন্তু আবার এক একবার এ-ও মনে হয় যে মা ছেলের সম্বন্ধে যদি personal উপাদান থাকে তবে নরনারীর সম্বন্ধে যে থাকবে না এটা বলা কি arbitrary নয় অনেকটা?

দিলীপকুমারের জিজ্ঞাসার দু'টি অভিমুখ। পরম উপলব্ধির পর নর-নারীর সম্বন্ধ তেমন দরকার হয় না একথা অধ্যাত্মবাদীরা মেনে নেন – কিন্তু মা-ছেলের সম্পর্ক তো অস্বীকার করেন না! তাহলে!

এই প্রশ্ন রবি ঠাকুরকে করা চলে। কারণ এ-বিষয়টা সারাজীবন ধরে ভেবেছেন তিনি। ব্যক্তিগত প্রেমকে মুছে দিয়ে নির্বিশেষ ঈশ্বরের উপলব্ধির কথা তো তিনি বলেন না। বরং লেখেন প্রিয়কে দেবতা আর দেবতাকে প্রিয় করার কথা। কেন লেখেন?

মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রেম জিনিসটা নিয়ে আমাদের বাঙালিদের অন্যান্য প্রদেশের ভারতীয়দের মতোই নানা দ্বিধা তৈরি হচ্ছিল। প্রেম বিষয়ে আমরা কতগুলি ভাবনার খাঁচা তৈরি করছিলাম। দেহ-দেহাতীত, ব্যক্তিগত-নৈর্ব্যক্তিক, স্বার্থ-পরার্থ- এমন সব ভাবনার খাঁচা। সেই ভাবনার খাঁচা বজায় রেখে আমাদের জীবনের নানা উপলব্ধিকে বিচার করছিলাম। যদি ভিন্ন অভিমুখে যেতাম! জীবনের অজস্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হাত-পুড়িয়ে যদি বলতে পারতাম এটা হলো এই, ওটা হলো সেই। নিজেদের অভিজ্ঞতার অকপট আত্মকথনে প্রেমকে বোঝার চেষ্টা না করে কতগুলি দার্শনিক ধারণার পেছনে ধাওয়া করা। কাকে বলে প্রেম? উত্তর মেলে না।

যে রবীন্দ্রনাথকে এই প্রশ্নগুলি করছিলেন দিলীপকুমার, সেই রবীন্দ্রনাথের নিজের কাছেও সদুত্তর ছিল না, এই সময় প্ল্যানচেটে খুব আগ্রহী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যাঁরা চলে গিয়েছেন, সেই বিদেহী আত্মাদের ডাকছেন মিডিয়ামের মাধ্যমে। বিদেহী আত্মারা সত্যি আসতে পারেন কি না, কিংবা মৃত্যুর পর জীবন হয় কি না এসবের বাইরে গিয়ে সেই প্ল্যানচেটে রবীন্দ্রনাথ যে প্রশ্নগুলি করেছিলেন, সেগুলো পড়লে বেশ মজা লাগে। রবীন্দ্রনাথ আত্মাদের জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা এখন যেখানে থাকেন সেখানে প্রেম সম্ভব কি না? সেই প্রেম কেবল মানসিক কি না? 

জীবনের শেষ পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন  ‘ল্যাবরেটরি’। সেই গল্পে তিনি আঁকলেন সোহিনীকে। সেই সোহিনী অবশ্য বাঙালি নয়, পাঞ্জাবী। বিশ বছরের অসংকোচ, ঘাগরা দোলানো মেয়ে। ঠোঁটে তার শান দেওয়া ছুরির মতো হাসি। এই মেয়ের শরীরের সংকোচ নেই– কিন্তু তার ভেতরে আছে ‘ক্যারেকটারের তেজ’। সেই ক্যারেকটার দিয়ে তার স্বামী নন্দকিশোরের বিজ্ঞান সাধনার ল্যাবরেটরিকে রক্ষা করেছিল সে। স্বামী চলে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর কর্মের সাধনা সেটা রয়ে গেল। সেই কর্মের ইমপার্সোনালের মধ্যে মিশে রইল সোহিনীর পার্সোনাল।

দিলীপকুমারের প্রশ্নের একরকম উত্তর যেন রবীন্দ্রনাথের এই গল্প।

সোহিনীর স্বামী নন্দকিশোরের বিজ্ঞানসাধনা বাইরের দিক থেকে সাধারণের কাছে জ্ঞানের সাধনা, তাই ইমপার্সোনাল। সোহিনীর কাছে তা নন্দকিশোরের সাধনা বলে পার্সোনাল। পরমের অনুভূতি কী, যিনি তা জানেন, তা জানেন। সেই উপলব্ধির অধিকারী যিনি, তিনি আর ব্যক্তি-ভালবাসায় ফিরতে পারবেন কি না, তা বলা মুশকিল। কিন্তু সেই মানুষটিকে, সেই মানুষের সাধনাকে ব্যক্তিগত ভালবাসায় ভরে দিতে পারেন কেউ প্রত্যাশাহীনভাবে, যেমনটি পেরেছিল সোহিনী।

ভালবাসা কি আর একরকম?

তার নানা রূপ।

চিন্তা আর দর্শনের খাঁচা ধরে, আবার সে খাঁচা ফেলে মানুষের যাত্রা।  

উত্তর মেলে, উত্তর মেলেও না। 

More Articles