প্রতিহিংসায় প্রেম নেই, অহং আছে

আমাদের খবরের কাগজ ভরে যায় অ্যাসিড বাল্‌বের গল্পে, প্রতিহিংসার কাহিনিতে। এই প্রতিহিংসা প্রেম নয়, অহং-এর আঘাত।

বৈষ্ণবরা বলেন স্নেহ দু'-রকম– ঘৃতস্নেহ আর মধুস্নেহ। ঘৃতস্নেহ থেকে মধুস্নেহ শ্রেষ্ঠ। কারণ ঘিয়ে হাত দিলে ‘দানা, দানা’ লাগে। মধুতে সেই দানার বালাই নেই। যে প্রেমে যত দানা, সে প্রেমে তত বিপত্তি। দানা মানে তো অহং। আমার আমির অধিকার। রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাই, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ পদ আছে, কিন্তু পজেসিভ কেস নেই। তবু আমরা তো প্রেম বলতে অধিকারকেই বুঝি, দানার আঘাতে সম্পর্কের ফুল ছিন্ন হয়। 

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ গোবিন্দলাল রোহিণীকে খুন করল। কেন করল? বঙ্কিমের পাঠক বলবেন, অধিকারবোধ এই হত্যার কারণ। গোবিন্দলাল রোহিণীর রূপে মুগ্ধ। সেই রূপমুগ্ধতা থেকে নিজের আবিষ্ট মনকে সে তুলতে পারে না, সেই রূপলুব্ধতাকে রোহিণীর প্রতি গুণমুগ্ধতায় উত্তীর্ণ করতে পারে না। জমিদার গোবিন্দলালের বাগানে অর্ধনগ্নিকা শ্বেতপাথরের মূর্তি ছিল। গোবিন্দলালের স্ত্রী কৃষ্ণাঙ্গী বালিকা-ভ্রমর, ভ্রমরে তার বাসনা তৃপ্ত হয়নি। সাহেব-মেমদের এদেশে আশার ফলে বাঙালি পুরুষদের রূপবাসনার চরিত্র বদলে যায়– শ্যামাঙ্গিনীর বদলে শ্বেতাঙ্গিনীদের প্রতি তাদের আকর্ষণ তীব্র হয়ে ওঠে। গোবিন্দলাল শ্বেতবর্ণা রোহিণীতে আসক্ত। তার বাগানের অর্ধনগ্নিকা মূর্তি আর বাস্তবের রোহিণী তার বাসনা-বিলাসে মিলে-মিশে একাকার। গোবিন্দলাল গ্রাম ছাড়ল। রোহিণীও। তাদের যাত্রার সময় আলাদা, উপায়ও আলাদা– কিন্তু গন্তব্য এক। গোবিন্দলাল রোহিণীকে নিয়ে গিয়ে তুলল প্রসাদপুরে একটি দ্বিতল অট্টালিকায়। সেই অট্টালিকার ওপরতলায় ওস্তাদ গান করে, রোহিণী নাচে– গোবিন্দলাল দেখে। দেওয়ালে সুরুচিবিগর্হিত ছবি ঝোলে। এই দমবন্ধ কামনাবিলাসে রোহিণী গোবিন্দলালের পণ্য। সেই রোহিণীকে অবিশ্বাসিনী মনে করে, গোবিন্দলাল খুন করে তাকে। বঙ্কিমের উপন্যাসের কথক লেখেন, ‘বালক-নখর-বিচ্ছিন্ন পদ্মিনীবৎ রোহিণীর মৃতদেহ ভূমে লুটাইতেছে।’ 

এই খুন গোবিন্দলালের প্রতিহিংসা-পরায়ণতার ফল। রোহিণী বিধবা। সেই বিধবার জন্য অর্থব্যয়  করে গোবিন্দলাল তার বাসনা তৃপ্ত করতে চায়। সেই বাসনাবিলাস পূরণের উপায় মাত্র রোহিণী। তার কি স্বাধীন ইচ্ছে বলে কিছু থাকতে পারে? তার কি আর কারও প্রতি আসক্তি প্রকাশের অধিকার আছে? নেই। সে গোবিন্দলালের পুষ্প। সেই পদ্ম নিয়ে গোবিন্দলাল খেলবে– চাইলে নখ দিয়ে ছিন্ন করবে। গোবিন্দলালের এই অনৈতিক অহং ও অধিকারবোধ রোহিণীর খুনের কারণ। 

স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ জাগলেই কি স্বামী তাঁকে খুন করবে?

ওথেলো ডেসডিমোনাকে হত্যা করেছিল। নবকুমার কিন্তু কপালকুণ্ডলাকে খুন করার কথা ভাবেনি। নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে ভালবেসেছিল। সেই ভালোবাসার সূত্র কপালকুণ্ডলার রূপ। সেই রূপমুগ্ধতা নবকুমারকে আবদ্ধ করেনি। বঙ্কিম লিখেছিলেন, নবকুমারের,

যেখানে চাপল্য ছিল, সেখানে গাম্ভীর্য জন্মিল; যেখানে অপ্রসাদ ছিল, সেখানে প্রসন্নতা জন্মিল; নবকুমারের মুখ সর্ব্বদাই প্রফুল্ল। হৃদয় স্নেহের আধার হওয়াতে অপর সকলের প্রতি স্নেহের আধিক্য জন্মিল; বিরক্তিজনকের প্রতি বিরাগের লাঘব হইল; মনুষ্যমাত্র প্রেমের পাত্র হইল...।

নবকুমারের চিত্তবৃত্তি প্রেমে সম্প্রসারিত হয়েছিল– গোবিন্দলালের মতো তার মন রূপলুব্ধতায় সংকীর্ণ হয়নি।

কপালকুণ্ডলার প্রতিপালক কাপালিক ও নবকুমারের থেকে ঘটনাচক্রে বিচ্ছিন্না তার প্রথমা পত্নী মতিবিবি, যে মুঘল দরবারে রূপাভিসারী ও ক্ষমতালিপ্সু– তারা দু'জনে মিলে ষড়যন্ত্র করে কপালকুণ্ডলা সম্বন্ধে নবকুমারের মনে কৌশলে সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। সেই সন্দেহ জাগলেও নবকুমার প্রতিহিংসা গ্রহণ করতে চায়নি। কাপালিক মদ খাইয়ে নবকুমারকে উন্মত্ত করে, কপালকুণ্ডলাকে হত্যা করার জন্য নবকুমারকে প্রেরণ করে। তখন নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে বলেছিল, ‘কাঁদিতে পারিতেছি না, এই ক্রোধে কাঁপিতেছি।’ 

নবকুমার তো গোবিন্দলাল নয়। প্রেমিক সে– কপালকুণ্ডলাকে সে ভালবাসে। তাই কান্না পায় তার– প্রবল কান্না। ভালবাসে যাকে, সেই ভালবাসার জন অন্যে উপগত একথা ভেবে সে কাঁদে। সে কান্না মনখারাপের, বেদনার– তার মন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে ওঠে না।

‘কপালকুণ্ডলা’ তো অন্যে উপগত হয়নি। কাপালিক মিথ্যে কথা বলেছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের বিমলা কিন্তু তার স্বামী নিখিলেশকে ছেড়ে সন্দীপে মজেছিল। তা জানতে, বুঝতে পারে নিখিলেশ। তা জেনেও কিন্তু বিমলাকে ধরে-বেঁধে রাখেনি সে। বিমলার ওপর প্রতিহিংসা গ্রহণ করতে চায়নি। নিখিলেশের আত্মকথন যেন প্রবল পুরুষের আত্মকথন নয়। বিমলায় আসক্ত সন্দীপ তার বন্ধু নিখিলেশ সম্বন্ধে ভাবে, 


অদ্ভুত মানুষ ঐ নিখিলেশ। ও বেশ বুঝেছে ওর ঘরের মধ্যে একটা বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু তবু আমাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দেয় না কেন? আমি জানি, ও অপেক্ষা করে আছে বিমল কী করে। বিমল যদি ওকে বলে ‘তোমার সঙ্গে আমার জোড় মেলে নি’ তবেই ও মাথা হেঁট করে মৃদুস্বরে বলবে, তা হলে দেখছি ভুল হয়ে গেছে।

আর নিখিলেশ? কী ভেবেছে সে? 

 

আমি কাঁদছি আমার আপন কান্না, সমাজের কান্না নয়। বিমল যদি বলে সে আমার স্ত্রী নয়, তাহলে আমার সামাজিক স্ত্রী যেখানে থাকে থাক্‌, আমি বিদায় হলুম।...

স্বয়ম্বরসভায় আজ আমার গলায় যদি মালা না পড়ে, যদি মালা সন্দীপই পায়, তবে এই উপেক্ষায় দেবতা তাঁরই বিচার করলেন যিনি মালা দিলেন, আমার নয়। আজ আমার এ কথা অহংকার করে বলা নয়। আজ নিজের মূল্যকে নিজের মধ্যে যদি একান্ত সত্য করে না জানি ও না স্বীকার করি, আজকেকার এই আঘাতকে যদি আমার এই মানবজন্মের চরম অপমান বলেই মেনে নিতে হয়, তা হলে আমি আবর্জনার মতো সংসারের আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়ব ; আমার দ্বারা আর কোনো কাজই হবে না।

অতএব আজ সমস্ত অসহ্য দুঃখের ভিতর দিয়েও আমার মনের মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ জাগুক।

কী বেদনাময় এই আত্মকথন! বেদনা মানে তো দুঃখমাত্র নয়, বেদনা মানে উপলব্ধি। স্বয়ংবর সভায় যদি মালা গলায় না পড়ে, তাহলে কি বল প্রয়োগ করতে হবে? তাহলে কি ভাবতে হবে, আমি তুচ্ছ? তারপর নিজেকে তুচ্ছ ভাবার বিপরীতে, যে মালা দিল না, কিংবা দিয়েও প্রত্যাহার করল, তার ওপর সুযোগমতো নিতে হবে প্রতিহিংসা? মহাভারতে স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদী কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বলে কর্ণ,  পাশাখেলায় যুধিষ্ঠির হেরে যাওয়ার পর, পণ-রাখা দ্রৌপদীকে প্রকাশ্যে 'বেশ্যা' বলেছিল। নিখিলেশ জানে এই প্রতিহিংসা পথ নয়, নিখিলেশ জানে নিজেকে যদি সে বিমলার প্রত্যাখ্যানের সূত্রে হীন বলে ভাবে, নিজের অহং-এ আটকে থাকে, তাহলে সে নিজেকেই মানুষ হিসেবে অপমান করবে।

ভালবাসায় প্রত্যাখ্যান আসে, আসতে পারে।  

আমাদের খবরের কাগজ ভরে যায় অ্যাসিড বাল্‌বের গল্পে, প্রতিহিংসার কাহিনিতে।

এই প্রতিহিংসা প্রেম নয়, অহং-এর আঘাত। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হেরে যাচ্ছে ভেবে প্রত্যাখ্যাত মানুষ ছুরি শানাচ্ছে। 

শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় লিখেছিলেন, 

কে আর তোয়াক্কা করে খবরের,

তেলের দরের?

এখানে সোনার চেয়ে দামি কিছু

নীরোগ মানুষ!...

বলো, ভালো আছো আর তোমার অসুখ

সেরে গেছে

বলো, ভালোবাসো তাই তোমার অসুখ 

সেরে গেছে।। 

ভালবাসাবাসি, প্রকৃতপক্ষে কী?  অহং-এর দানাহীন মধুস্নেহ, তাকেই ভালবাসা বলে।

More Articles