নির্ভেজাল, নিঃশর্ত বন্ধুত্বে বিশ্বাস করেননি সত্যজিৎ?
Satyajit Ray: সত্যজিতের লেখায় দুই বন্ধুর সম্পর্ক খুবই জটিলতর বিষয়।
কিছুই সহজ নয় আর। সহজ ছিল কি কোনও দিন? সহজ বন্ধুতা, যাকে বলে সখ্য, যাকে মধুর রসের তলায় রাখেন বৈষ্ণব রসতাত্ত্বিকরা, সেই সহজ বন্ধুতা সম্বন্ধে খুবই দ্বন্দ্বময় অবস্থান ছিল সত্যজিতের। তারই কিছু খুচরো নমুনা।
এমনিতে লালমোহন আর ফেলুদাকে পরস্পরের বন্ধু বলেই মনে হয়। লীলা মজুমদার দু'জনের সম্পর্কের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে লিখেছিলেন,
গোয়েন্দা ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারে তৃতীয় যে মানুষটা অপরিহার্য তাঁর নাম লালমোহন গাঙ্গুলী– জটায়ু ছদ্মনামে তিনি লোম-খাড়া-রহস্য-উপন্যাস লেখেন। তাঁর মজাদার হাবভাব আর বোকামি-ভরা সরস কথাবার্তার মধ্যেও, সোনার মতো ঝকঝকে একটা সরল মন দিব্যি প্রকাশ হয়ে পড়ে। আহা, মাটির পৃথিবীতে এমন খাঁটি বন্ধু ক’জনের জোটে?... লালমোহনবাবু পরম বন্ধু বলেই নানা ব্যাপারে তাঁকে টিটকিরি দেন ফেলুদা, বারে বারে তাঁর ভুল শুধরে দেন– ওটা কিছু দোষের জিনিস নয়, খুব স্বাভাবিক। ওটা খাঁটি বন্ধুত্বের টান! লালমোহনকে আড়ালে টিটকিরি দিলে বুঝতাম, ফেলুদা লোকটা কিঞ্চিৎ ইয়ে!
ফেলুদা-লালমোহনের কথা আপাতত থাক।
সত্যজিতের লেখায় দুই বন্ধুর সম্পর্ক খুবই জটিলতর বিষয়।
আরও পড়ুন: যৌন শোষণই নিয়তি! বাংলা সাহিত্যের নারীমন তবু চেনা ছকের বাইরে
তাঁর একাধিক গল্পে যেমন দুই বন্ধুর সম্পর্কের মধ্যে অহমিকা ও তিক্ততার বিষ দেখা যায়, তেমনই আবার চোখে পড়ে বন্ধুর প্রতি বন্ধুর দায়িত্বের নানা প্রকাশ। বন্ধু ও বন্ধুতা সত্যজিতের লেখায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে, কয়েকটি গল্প পাশাপাশি রাখলেই তা টের পাওয়া যায়। ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’, ‘জুটি’ ‘দুই বন্ধু’ এই তিনটি গল্পেই একদা যাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, তাদের মধ্যে ঘটনাগতিকেই বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। এই বিচ্ছেদের পর আবার ঘটনাক্রমে দেখা হচ্ছে দু'জনের। যখন দেখা হচ্ছে, তখন দুই বন্ধুর মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য থাকলে প্রতিক্রিয়া একরকম আর পার্থক্য না থাকলে প্রতিক্রিয়া আরেকরকম।
‘ক্লাস ফ্রেন্ড’ গল্পে বড়লোক মোহিত সরকারের কাছে ইস্কুলবেলার বন্ধু জয় যখন অনেকদিন পরে দেখা করতে আসে, তখন জয়ের অর্থনৈতিক অবস্থাই কেবল পড়তির দিকে, তাই নয়, চেহারাও সম্পূর্ণ বদলে গেছে। দেখে চেনা কঠিন। মোহিত সরকার বন্ধুত্ব অস্বীকার করতেই চান, জয়ের অর্থ-সাহায্যের আবেদন কৌশলে কাটিয়ে দিতে পারলে বাঁচেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পারলেন না। জয় তার তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেকে মোহিতের কাছে পাঠিয়েছে অর্থ-সাহায্যের আবেদন নিয়ে। ‘জয়কে দেখে না চিনলেও’ মোহিত জয়ের ‘ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে তাঁর ত্রিশ বছর আগের ক্লাস ফ্রেন্ডটিকে ফিরে’ পেলেন। তাই চারটে পঞ্চাশ টাকার নোট (গল্পটি 'সন্দেশ' পত্রে ফাল্গুন ১৩৮৫ সংখ্যায় প্রকাশিত, দুশো টাকার তখন ‘দাম’ ছিল) দিতে দ্বিধা করলেন না।
‘জুটি’ গল্পে আছে নির্বাক যুগের দুই কমিক-শিল্পীর কথা। বিশু আর শিবু নামে নির্বাক ছবিতে কমিক রোল করতেন রতন রক্ষিত আর শরৎ কুণ্ডু। কুণ্ডু-রক্ষিত জুটি সবাক যুগে আর রইল না। রক্ষিতমশাইয়ের কণ্ঠস্বর ভালো ছিল বলে সবাক যুগে হিরোর পার্টে খাপ খেয়ে গেলেন। কুণ্ডুমশাই হারিয়ে গেলেন দারিদ্রের অন্ধকারে। পরে যখন রক্ষিতমশাই তাঁদের করা নির্বাক-যুগের ছবিগুলি সংগ্রহ করে ব্যক্তিগতভাবে দেখার ব্যবস্থা করছিলেন, তখন সে খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে বেয়ারার কাজ নিলেন কুণ্ডু। ছবিগুলো দেখতে পাবেন, এই লোভেই বেয়ারার কাজ নেওয়া, তাছাড়া পেটের দায়ে যিনি কুলির কাজ করেছেন, তাঁর কাছে বেয়ারার কাজ তো স্বর্গ! গল্পের শেষে রক্ষিত কুণ্ডুকে চিনতে পারলেন। বিখ্যাত জুটির পুনর্মিলন হলো। রতন রক্ষিত তাঁর একদা বন্ধুর দায়িত্ব অস্বীকার করলেন না– বললেন, ‘তুমি এখন থেকে হবে আমার ম্যানেজার।’ বেয়ারা থেকে ম্যানেজার, কর্মোন্নতি সন্দেহ নেই।
এই দুই গল্পেই বিচ্ছেদের পর যখন দেখা হচ্ছে, তখন দু'জনের একজন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সংকটের মুখে। সেই সংকট-মোচনের সামান্য দায়িত্ব নিয়েছেন মোহিত, বন্ধুপুত্রকে দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে। রক্ষিতমশাই বন্ধু-কুণ্ডুকে ম্যানেজার করে দিয়ে তাঁদের জুটি জোড়া লাগিয়েছেন। কোনও ক্ষেত্রেই কিন্তু বন্ধুত্বের প্রসঙ্গে শরীর-মনের অহেতুক আবেগ প্রকাশিত হয়নি, যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা যুক্তিনিষ্ঠ দায়িত্ব। যা প্রকাশিত হয়েছে, তাকে খুব বেশি হলে দয়া-মায়া-করুণা বলা চলে। যিনি অর্থনৈতিকভাবে ওপরে, তিনি দয়া-মায়া-করুণা প্রদর্শন করতে পারছেন। বন্ধুত্বের নির্ভেজাল আবেগ, অবস্থানগত সমত্ব বজায় থাকেনি বলেই সেখানে তার অপ্রকাশ।
অবস্থানগত সমত্ব, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানগত সমত্ব, না-থাকলে বড়বেলায় বন্ধুত্ব বজায় থাকে না, একথাই যেন বোঝাতে চান সত্যজিৎ। ইস্কুলবেলার অহেতুক আবেগ বড়বেলায় নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থভাবে বজায় থাকে না। তবে দু'জনের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থান যদি মোটের ওপর কাছাকাছি হয়, তাহলে বন্ধুত্ব স্বীকারে বাধা থাকে না। সে বৃত্তান্ত রয়েছে ‘দুই বন্ধু’ গল্পে। মহিম আর প্রতুল ইস্কুলবেলার বন্ধু। তাদের শেষ দেখা ১৯৬৯ সালের ৭ অক্টোবর। তারপর স্থির হয়েছিল, তারা দেখা করবে ১৯৮৯ সালের ৭ অক্টোবর লাইটহাউস সিনেমার টিকিট কাউন্টারের সামনে। মহিম এল, প্রতুল এল না। পরিবর্তে এল পত্রবাহক। মহিমের ঠিকানা লিখে দিলে প্রতুল নাকি নিজেই যাবে তার বাড়ি। প্রতিষ্ঠিত পুরস্কারপ্রাপ্ত সুলেখক মহিম চট্টোপাধ্যায় ঠিকানা লিখে দেবে না কেন? দিয়েছে লিখে। প্রতুল এল, রবিবার সকালে। মহিম বলেন, ‘শুধু গতরে বেড়েছিস– চেহারা একটুও পালটায়নি।’ ক্রমশ প্রকাশ প্রতুল বিখ্যাত, মহিমের থেকেও বিখ্যাত, কারণ সে চলচ্চিত্র-অভিনেতা কিশোরীলাল। প্রতুল অর্থাৎ কিশোরীলালকে দেখতে ভিড় জমে যায়। ভিড় ঠেলে একটা ছেলে মহিমের দিকে এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে জানতে চায়, ‘কিশোরীলাল আপনার বন্ধু?’ মহিমের জবাব ‘হ্যাঁ ভাই, আমার বন্ধু।’ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের সমত্ব থাকলে ‘হ্যাঁ ভাই, আমার বন্ধু’ একথা বলা আটকায় না। তবে মহিম জানে যে, বেশি পরিচিত সামাজিক পাল্লা তার দিকেই থাকে। ‘তার আসল নাম মুছে গিয়ে তার জায়গায় নতুন নাম হবে– ‘কিশোরীলালের বন্ধু’।’ বোঝা যায়, সত্যজিৎ অহেতুক বন্ধুত্বের প্রণয়-স্বর্গে বিশ্বাসী নন। তাঁর কাছে দুই পরিণত বয়সি মানুষের বন্ধুত্ব শর্ত-সাপেক্ষ সামাজিক সম্বন্ধ।
দেরিদার 'The Politics of Friendship' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তার দু'-বছর আগে ১৯৯২ সালে সত্যজিতের প্রয়াণ। দেরিদা বই প্রকাশের আগে তাঁর বন্ধুতাবিষয়ক বক্তৃতামালায় বন্ধুত্বের অসম্ভবত্ব ও বন্ধুত্বের শর্তসাপেক্ষতাকে নানাভাবে বুঝতে চাইছিলেন। অ্যারিস্টটলের ‘ওগো আমার বন্ধুরা, কোনও বন্ধু নেই’– এই বাক্যের মধ্যে যে স্ববিরোধ, তার কারণাকারণ পর্যালোচনা করছিলেন তিনি। দেরিদার মতে, বন্ধুত্ব- এই সম্পর্ক সময়-নিরপেক্ষ নয়, সত্যজিৎও সময়ের কষ্টিপাথরেই বন্ধুত্ব যাচাই করতে চান। বন্ধুত্বের যে স্বর্ণময় অতীত তাঁর গল্পে বিবৃত, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই অপরিণত বয়সির জীবনের শৈশব-কৈশোর কাল। সেই দু'-জন যখন ভবিষ্যতে পরিণত-বয়সি হবে, তখন সেই ভবিষ্যতে কীভাবে নিপাট বন্ধুত্বের মধ্যে নানা কারণে উদ্বেগ, আততি, অনুশোচনা, বিলাপ প্রবেশ করতে পারে, তাই মূলত সত্যজিতের গল্পের বিষয়। কখনও কখনও বন্ধুত্বের মধ্যে ঈর্ষা যে কী ভয়ংকর হতে পারে, তারই জটিল চেহারা ‘ময়ূরকণ্ঠি জেলি’। এই গল্প কিশোরপাঠ্য নয় বলে বড়দের মনোজগতের ও বাসনালোকের ছবি আঁকতে তিনি কার্পণ্য করেননি। কী কী কারণে শশাঙ্ক তার বন্ধু প্রদোষকে ঈর্ষা করেছে গল্পের গোড়াতেই কথক তা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘প্রথমে ঈর্ষা করেছে তার মেধাকে, পরে তার খ্যাতি ও লেখনীশক্তিকে। ঈর্ষার আরেকটি কারণ– নিভা মিত্রকে প্রদোষের পত্নী রূপে লাভ।’
এই যে মানুষে-মানুষে বন্ধুত্বের নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ সম্ভাব্যতার জগৎটিকে সত্যজিৎ প্রশ্ন করছেন, যাচাই করছেন, তার অর্থ এই নয় যে, সত্যজিৎ সহযোগত্ব বা সহচরত্বের ধারণাকে বিশ্বাস করতে চান না। তাঁর গল্পের জগৎ কেবল মানবকেন্দ্রিক (anthropocentric) নয়। অন্য গ্রহের প্রাণীর সঙ্গে কিংবা না-মানুষী পার্থিব প্রাণীর সঙ্গে নানা বয়সের মানুষের বন্ধুত্ব হচ্ছে এমন নানা ঘটনা সত্যজিতের গল্পে ফিরে ফিরে আসে। বঙ্কুবিহারী দত্ত কাঁকুড়গাছি প্রাইমারি ইস্কুলে ভূগোল ও বাংলার শিক্ষক। এই নিরীহ মানুষটিকে নিয়ে শ্রীপতিবাবুর আড্ডার বয়স্ক মানুষজন নানা নকশা করেন। ইংরাজিতে যাকে ‘বুলি’ (bully) করা বলে, এও সেরকম। ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ভিনগ্রহের প্রাণী অ্যাং এই নিরীহ মানুষটিকে একদিন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়, অপমান সহ্য করতে নিষেধ করে। ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পের শেষে অ্যাং-এর পরামর্শে ও সাহচর্যে রূপান্তরিত শিক্ষক বঙ্কুবিহারী দত্ত একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন,
বন্ধুগণ! আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আজ এই আড্ডায় আমার শেষদিন। আপনাদের দলটি ছাড়ার আগে আমি কয়েকটি কথা আপনাদের বলে যেতে চাই এবং তাই আজ এখানে আসা। এক নম্বর– সেটা সকলের সম্বন্ধেই খাটে– আপনারা বড্ড বাজে বকেন। যে বিষয়ে জানেন না, সে বিষয়ে বেশি কথা বললে লোকে বোকা বলে। দুই নম্বর– এটা চণ্ডীবাবুকে বলছি– আপনাদের বয়সে পরের ছাতা-জুতো লুকিয়ে রাখা শুধু অন্যায় নয়, ছেলেমানুষি। দয়া করে আমার ছাতাটা ও খয়েরি ক্যাম্বিসের জুতোটা কালকের মধ্যে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবেন। নিধুবাবু, আপনি যদি আমাকে ব্যাঁকা বলে ডাকেন তবে আমি আপনাকে ছ্যাঁদা বলে ডাকব, আপনাকে সেইটেই মেনে নিতে হবে। আর শ্রীপতিবাবু– আপনি গণ্যমান্য লোক, আপনার মোসাহেব প্রয়োজন হবে বইকী! কিন্তু জেনে রাখুন যে, আজ থেকে আমি আর ও-দলে নেই; যদি বলেন তো আমার পোষা হুলোটাকে পাঠিয়ে দিতে পারি– ভাল পা চাটতে পারে।
বঙ্কুবাবুর এই দীর্ঘ-সংলাপ শুরু হয়েছে ‘বন্ধুগণ’ এই সম্বোধনে। দেরিদা অ্যারিস্টটলের সংলাপ উদ্ধার করেন, সে সংলাপে বন্ধু বলে ডেকে বন্ধু না-থাকার বাস্তবতাকে প্রকাশ করা হয়। বঙ্কুবাবুর সংলাপও এক অর্থে তেমন। বঙ্গদেশের আবহে বন্ধুত্বের ছলে নিরীহ মানুষদের নাকাল করার যে ‘গ্রাম্য’ দস্তুর, অ্যাংবাবুর বলে বলীয়ান হয়ে রূপান্তরিত বঙ্কুবাবু সেই দস্তুরের বিরোধিতা করেছেন। মোসাহেবি আর বন্ধুত্ব যে এক নয়, সে-কথা জানাতেও দ্বিধা করেননি। নতুন ভিনগ্রহীর বন্ধুত্বের সূত্রেই বঙ্কুবাবু মানুষী বন্ধুত্বের ‘ছল’-কে প্রশ্ন করতে পেরেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বের নামে নানা-মাত্রায় ক্ষমতা-প্রদর্শনের চাতুরি এই গল্পে ভেঙে পড়েছে। সত্যজিতের গল্পের শেষ বাক্যটি মোক্ষম। ‘ঠিক সেই মুহূর্তেই রামকানাই-এর হাত থেকে চা-ভর্তি পেয়ালাটা পড়ে গিয়ে সব্বাই-এর কাপড়ে-চোপড়ে গরম চা ছিটিয়ে চুরমার হয়ে গেল।’
চায়ের কাপে তুফান তুলে বাঙালির বন্ধুত্ব বজায় রাখার যে আদিকল্প, বন্ধুত্বের সেই স্বর্গীয় আদিকল্পের অলীকত্ব চুরমার করে দেওয়ার পক্ষে এমন বাক্যের দোসর মেলা ভার।
সত্যজিতের ঢের আগে প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর কিশোরপাঠ্য ডিসটোপিয়া 'পিঁপড়ে পুরাণ' লিখেছিলেন ‘রামধনু’ পত্রিকায়, পরে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সেখানে, মানুষে-পিঁপড়েতে ভয়ানক লড়াই। ছ'ফুট লম্বা পিঁপড়ে মানুষ তাড়াতে শুরু করে। এরই বিপরীতে রাখা সম্ভব সত্যজিতের ‘সন্দেশ’ পত্রে প্রকাশিত গল্প ‘সদানন্দের খুদে জগৎ’। তেরো বছরের সদানন্দ জানায়, ‘এখন আছি কেবল আমি আর আমার বন্ধু লালবাহাদুর। লালবাহাদুর সিং।’ সদানন্দ জানে সে আর তার পিঁপড়ে বন্ধুদের কথা বড়রা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস না করলে ক্ষতি নেই– সে জানে এই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, বেঁচেও আছে, থাকবে। অ্যানথ্রোপমর্ফিজিম (anthropomorphism) সত্যজিতের আগ্রহের বিষয়– মানুষে-পিঁপড়েতে বন্ধুত্ব হওয়া আটকায় না তাই।
মানুষে-মানুষে বন্ধুত্বকে সময়ের পথে ধারাবাহিকভাবে কেবল দু'-ক্ষেত্রে দু'-রকমভাবে সত্যজিৎ বাঁচিয়ে রাখেন– বাঁচিয়ে রাখেন তাঁর শঙ্কু আর ফেলুদা সিরিজের কাহিনিতে। সে আরেক আলোচনার বিষয়।
আপাতত বন্ধুতার শর্ত-সাপেক্ষতা আর বন্ধুতার জন্য নিঃশর্ত আকুতি দুয়ের টানাপড়েন মনে থাক। বন্ধুতা আছে, বন্ধুতা নেই। ভালবাসা আছে, ভালবাসা নেই।