কখনও বিশ্বজয়, আবার হতাশা, মারাদোনা-মেসির আর্জেন্টিনা যেন বিশ্বকাপের হাসি কান্নার ককটেল
Fifa World Cup 2022 : আন্দ্রেস ব্রেমে নব্বইয়ে পেনাল্টি মেরে জেতানোর পর মারাদোনা একা কাঁদেনি৷ এ পাড়ায় যে সব বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি, তারাও কাঁদল।
আর্জেন্টিনার যে কোনও শহরে পায়ে হেঁটে ঘুরলে মনে হবে যেন মাদ্রিদের রাস্তা ধরে হাঁটছে কেউ। বড় বড় বাজারের সামনে জটলা করে যে সব জনতা দাঁড়িয়ে তাঁদের নিরানব্বই ভাগই স্প্যানিশে কথা বলছেন। ইউরোপের বড় শহর যেমন প্যারিস, লন্ডন এমনকী মাদ্রিদের রাস্তাঘাটের সঙ্গেও বুয়েনস এয়ার্স, কর্ডোবা বা রোজারিওর রাস্তার কোনও মিল নেই। ভূ-প্রাকৃতিক কারণ তো আছেই, সঙ্গে আছে আর্থ-সামাজিক অবস্থা। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে দুর্নীতি, আর্থিক তছরুপ, দারিদ্রের ধারাবাহিক এসে পড়া ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পুরো শহরগুলিই ঢালু, উঁচু নিচু,গলি। শহরের আনাচে কানাচে স্প্যানিশ ঔনিবেশিকতার ছাপটা সুস্পষ্ট। আর্জেন্টিনার ঘিঞ্জি অঞ্চল ছাড়িয়ে এগোতে থাকলে ছোট ছোট মাঠ নজরে পড়ে। সেখানে বিশাল হাঁড়িতে ফোটানো হচ্ছে মাংস আর আলু। সেদ্ধ খাবার। ছোট ছোট ক্লাবের উদ্যোগে ফুটবল প্র্যাকটিস করে ছেলেরা। এদের বেশিরভাগই স্কুলছুট, কেউ কেউ ব্রুকলাইন কারখানার চাকুরে। শহরের গা ঘেঁষে মূলত ফুড প্রসেসিং আর টেক্সটাইলের বড়বড় কারখানা। লাতিন আমেরিকা থেকে জাহাজে ইউরোপে চলে যায় জ্যাম-জেলি-চামড়ার সরঞ্জাম।
কিন্তু এসব তো নগণ্য। আর্জেন্টিনার যে সম্পদটি সবচেয়ে সুলভে বিক্রি হয়ে যায় ইউরোপে তা হল ফুটবলার। স্প্যানিশ কলোনিগুলোয় সন্ধ্যে নেমে এলে টিমটিমে আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে কয়েকটা মুরাল পেইন্টিং। পলেস্তারা খসা দেওয়ালে বিশাল বিশাল অবয়ব। দেওয়ালে খোদাই হয়ে থাকেন দিয়েগো মারাদোনা, কার্লোস তেভেজ, মারিও কেম্পেসরা। রাতের অন্ধকারে হলদে আলোর নিচে চলে ২ বা ৩ পেসোর বিনিময়ে বল জাগলিং। আর স্ট্রিট ফুটবল? আর্জেন্টিনার কুখ্যাত স্ট্রিট ফুটবল নিয়ে রয়েছে অজস্র উপকথা। গরিব কলোনিগুলোয় পেরেক ছড়ানো গলিতে খালিপায়ে বল ড্রিবল করার মতো ভয়ংকর খেলাও হত একসময়ে।
দেশ-কাল-সময়। ডিঙিয়ে গেলে, এ আর্জেন্টিনা আর ভৌগোলিক মানচিত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। থাকে না, কারণ ফুটবল এক অদৃশ্য উড়ান দিয়েছে দেশটাকে। বিশ্বকাপ। জুলেরিমা। কোপা। লাতিন আমেরিকানা। পড়শি দেশ ব্রাজিলের জোগো বোনিতোর সিগময়েড দোলন,পাঁচটা বিশ্বকাপ, তারকার ছড়াছড়ির মাঝে আর্জেন্টিনা একটা আটাত্তর, একটা ছিয়াশি; এই মাত্র। তবু, আর্জেন্টিনা ফুটবলের দেশ। ঘোরতর ফুটবলের দেশ। এর কারণটা মজার। প্রশ্নগুলো সহজ নয়৷ উত্তরও জানা নেই। শুধু জানি, আটাত্তরের কেম্পেস একটা সলতে পাকিয়েছিলেন মাত্র। তখনও আমরা আর্জেন্টাইন হওয়ার স্ক্রিপ্টটা চোখেই দেখিনি। আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়া, আমাদের রোয়াক, আমাদের গলির মোড়, আমাদের ধর্মতলার মোড়ে লেনদেন লেনদেন লেনিন, হাত ছড়ানো শ্যাওলা ধরা কুমিরের মতো পড়ে থাকা সবুজ গড়ের মাঠ কয়েকটা দশকজুড়ে শুধু তো ব্রাজিলেরই ছিল। কালের শহর তখন পেলের শহর। হলুদ-সবুজ-পেলে-গ্যারিঞ্চা-জিকো-সক্রেটিস, একটা আকস্মিক যতিচহ্ন!
হুড়মুড় করে কিছু একটা হয়ে গেল। মেক্সিকো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন কেউ একটা। দু'পায়ে দু'সাইজের জুতো। চেহারা ভারী হয়ে গেছে। প্রতিপক্ষে ফ্যালকাও-সক্রেটিসের ব্রাজিল, এঞ্জো বিয়ারজোতের বিশ্বজয়ী ইতালি, মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্স, লাউড্রপের ড্যানিশ ডিনামাইট- সবার বিরুদ্ধে একা। আমাদের শহরটা চোখের সামনে ফেটে গেল। ফেটে গেল রোয়াকের লাল পাথর।
আমরা ভাবিইনি কোনওদিন, বারবার হাইলাইটস চালিয়ে দেখেও বিশ্বাস করতে পারিনি পিটার ব্র্যাডস্লে ওভাবে কেটে যাবেন, ওভাবে টেরি বুচার শুয়ে পড়বেন মাঠে, ওভাবে ফ্যানউইককে বোকা বানিয়ে, পিটার শিল্টনকে মাটি ধরিয়ে একটা চল্লিশ গজ দৌড় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে এই শহরটাকে। এ বিশ্বের প্রতিটা শহরকে। সে ফাটল ছড়াবে মফসসলে, গ্রামে। একটা হলদে পৃথিবীর ধর্মান্তকরণ করে দেবেন নাস্তিক ঈশ্বর, দিয়েগো-দিয়েগো! ওই প্রথম আর্জেন্টিনা ঢুকে পড়ল, হেঁশেল ফোড়নে, বাঙালি ঘরে বোরোলিন আর চেসমি গ্লিসারেনের মতো। কাগজে ছবি ছাপা হলে কেটে লুকিয়ে রাখল কিশোরী! মারাদোনার সমস্ত ভুল তখন মাফ, আন্দ্রেস ব্রেমে নব্বইয়ে পেনাল্টি মেরে জেতানোর পর মারাদোনা একা কাঁদেনি৷ এ পাড়ায় যে সব বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি, তারাও কাঁদল।
চুরানব্বই। আমেরিকানা। গ্লোবালাইজেশন। মার্কিন পুঁজির ওপর সেঁকা হচ্ছে ফুটবল। গ্রিসের বিরুদ্ধে গোল করে বুক বাজিয়ে ক্যামেরার সামনে এসে গেলেন মারাদোনা, যেন ডেকে ডেকে দেখাচ্ছেন- "আমি ফুরিয়ে যাইনি, দেখো তোমরা৷ আমিই মারাদোনা, আমিই দশ, আমিই লাতিন আমেরিকা..."; এফিড্রিনের নাম বারুদের মতো ছড়াচ্ছে, মারাদোনার দোষ নেই। নিষিদ্ধ ড্রাগের পিছনে রহস্য থাকবে নিশ্চিত। অঙ্ক চাইলেও মন মানে না। মারাদোনা চলে গেলেন। বাস্তিল ভেঙে পড়ার মতো ভেঙে গেল আলবিসেলেস্তের মিনার। অথচ, সেই যে হাতে করে নীল-সাদা বীজ ঢুকিয়ে গেছিলেন ফাটলে, সেসব জংলি চারা হল। বাতিগোলের আর্জেন্টিনা, ওর্তেগার আর্জেন্টিনা, হার্নান ক্রেসপোর আর্জেন্টিনা। আটানব্বই। ফ্রান্স। অথচ, ওইভাবে ডেনিস বার্গক্যাম্পের তিনটে টাচ চুরমার করে দিল সব। অপেক্ষা ঘন হয়। হতে থাকে। যেমনটা ২০০২। বিয়েলসার ওই দুর্ধর্ষ দলটা যে গ্রুপ স্টেজ থেকে ছিটকে যাবে ভাবেইনি কেউ। ক্রেস্পো-বাতিস্তুতাকে একসাথে খেলালেন না বিয়েলসা। মোক্ষম সময়ে ডিফেন্সের ভুল!
আর্জেন্টিনার ফুটবল মানেই একটা মনখারাপ। সেদিন থেকে। যত দিন গেল, বিরহ বেড়ে চলে। একটুর জন্য কত কিছু হয়নি। সুমনের গান। একদল বোকার হদ্দ যারা বহুকাল জেতে না কিছুই, আর্জেন্টিনা এই বোকাদের দেশ, আর্জেন্টিনা ফুটবলের দেশ। ব্রাজিলের থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। ফুটবল এখানে নৃশংস, আবার সুন্দরও। আর্জেন্টিনা একগুঁয়ে, জেদি মানুষের দেশ। নতুন শতকের প্রথম দশক। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। পেকেরম্যানের আর্জেন্টিনা। ম্যাক্সি-মাসচেরানো-রিকেলমে-ক্যাম্বিয়াসো। সামনে স্যাভিওলা-ক্রেসপো। এই একটা দলের পোস্টারে অন্যরকম লাগত কার্লোস তেভেজকে। আমাদের পাড়ার দেয়ালে, কে যেন তেভেজের চুলে কালি দিয়ে রঙ করে দিয়েছিল। গলায় দিয়ে গেছিল গাঁদার মালা। কুড়ি বছর ট্রফি নেই। হাহাকারও করিনি আমরা। শুধু ভালবেসেছি। কী অদ্ভুত এক সম্মোহন। রোজারিও মিশে যাচ্ছে গিরিশ পার্কে, কর্ডোবার গলি, ভাঙা গির্জার ছায়া শরত বোস রোডের এই দেওয়ালটার পাশ দিয়ে আমার বিকেলের অঙ্ক ক্লাস, এই সময়টায় ঝটিকা বিশ্বকাপ এলে অচেনা খেলোয়াড়ের ভিড়ে, পাড়ার বিলে-বিষ্টুদাদাদের মাতব্বরির ভিড়ে, এক আধটা ম্যাচ দেখা হয়েই যেত টিভিতে। ছাব্বিশ টাচের একটা গোল নিয়ে সেবার মাতামাতি হল খুব। ম্যাক্সি-হেইঞ্জ-ক্যাম্বিয়াসো-তেভেজ-স্যাভিওলা-ক্রেসপো... ছবির মতো গোল। মনে পড়ে সূর্যদাকে, রিকেলমে কাপ জিতলে এ পাড়ার সবাইকে নিজের গুমটিতে ফ্রি তে বিস্কুট খাওয়াবে বলেছিল। আমার হোঁচট খেয়ে হাঁটু ছড়ে যাওয়ার যন্ত্রণার মতো এসেছিল আবানদাঞ্জিয়ারির চোট। জার্মানি জিতে গেল। আবার হল না। আবার অপেক্ষা। আবার দিন গোনা। তারপর কত কী যে হয়ে গেল! মারাদোনা যেবার কোচ, আমরা বন্ধুরা স্কুলে বেঞ্চ বাজিয়ে গাইতাম-
"মাঠের মাঝে আর্জেন্টিনা/ মনের মাঝে মেসি
বুকের মাঝে মারাদোনা/ তাতেই মোরা খুশি..."
হয়নি। কোনওবারই হয়নি। আবানদাঞ্জিয়ারি কখনও চোট পেয়ে যান, কখনও জার্মানির সামনে গুঁড়িয়ে যায়। ২০১৪ সালে এই মেসি৷ আজকের বুড়ো মেসি যখন টগবগে, আমাদের উড়ে বেড়ানো ক্লাস টুয়েলভ, অপেক্ষার পিদিম এক ফুঁয়ে প্রায় নিভিয়ে ফেলেছিলাম। হিগুয়েনের ওই মিস। প্যালাসিওর বোকার মতো রিসিভ। শেষ মুহূর্তে মারিও গোটজে ভেঙে দিয়ে যান সবকিছু, চিনা ফটোগ্রাফারের ছবিতে নিঃস্ব-রিক্ত মেসির মুখ। আবার কোনওমতে গুছিয়ে নেমে পড়ো। একের পর এক কোপা হার। ধুর, ধুর, মারাদোনা টিভি বন্ধ করতে শিখিয়ে যায়নি৷ তার আগেই চলে গেল। যেন টিভি খুলে কষ্ট দেখ। তবে, এর এক অদ্ভুত সমীকরণ, যত কষ্ট পাও, তত ভালবাসা বাড়ে। বাবাদের কাছে শুনতাম, মারাদোনার নব্বইয়ের কান্নার পর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা শক্ত হয়ে গেছে। ওই কান্না যেন আশ্চর্য পেনকিলার যা দশকের পর দশক কষ্ট ভোলাতে পারে। ওই ব্যথার মাঝেও হেঁটে চলাই চিরন্তন।
এবার বিশ্বকাপে গোড়ার ম্যাচটাই হেরে ভূত হওয়ার পর আবারও শামুকের খোলসে। গোটা পাড়াটা গুটিয়ে গেল। বিশ্বের সমস্ত পাড়া-টারার জমাট অন্ধকার। গিলার্মো ওচোয়ার পাশ দিয়ে ওই গোলার মতো শট ঝটিকা যেন হ্যালোজেন জ্বেলে দিল একটা। অন্ধকারের পর আলোয় চোখ ঝলসে যায়, সে অস্বস্তি কাটানোর আগেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে রেমব্রেন্টের তুলিতে আঁকা গোল, আর ফিরে তাকাল না। আট বছর আগের মেসি এবার সিংহের কামড়ে ধরেছেন, একটা অপেক্ষার হরিণকে, পুরো বাগে আনতে আর একটা ম্যাচ বাকি।
ছত্রিশ বছর। ছত্রিশটা বছর মোমবাতির পাশে পিঁপড়ের মতো ঘুরছে একটা বিশ্বাস, ভালোবাসার ডানা খসে পড়লেও প্রজন্ম এসে জায়গা করে নিচ্ছে ফের। মারাদোনা চলে গেলেন। মারাদোনার প্রজন্ম বুড়িয়ে এল। ফুরিয়ে এল সময়। ছত্রিশটা আলাস্কার শীত, ছত্রিশটা পোর্টল্যান্ডের বসন্ত, ছত্রিশটা নটিংহ্যামের গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে শুধু অপেক্ষা- মেসি বলে দিয়েছেন এই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ। জীবনের শেষ লড়াতে নামছেন কমল গুহ।
আমরা মনে মনে শালিখঠাকুরকে ডাকছি প্রাণপণে। অপেক্ষার ঘুড়ি আটকে আছে তালগাছের ডগায়। মোমসুতোয় টান দিচ্ছি, মনে মনে বলছি আর তো একটা ম্যাচ। আর একটা...