ফিতে কাটলেই কি মিলবে বাংলার বিনোদনের হারানো জহরত?

Entertainment: দুর্গাপুজোর ফিতে কাটা নিয়ে কী বললেন শোলাঙ্কি রায়, স্বস্তিকা দত্ত ও অর্কজা আচার্যরা?

ফিতে কাটার তালিকা দেখে আপামর বাঙালির আচমকা চক্ষু চড়কগাছ! অথচ বিষয়টা দিব‍্য চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। যেই চোখের ওপর পারিশ্রমিক-সমেত একখানা লিস্টি মেলে ধরা হয়েছে, অনেকেই ভ‍্যাবাচ‍্যাকা খেয়ে গেছেন। সেই লিস্টের সঙ্গে বলে দেওয়া হয়েছে সরাসরি, যদি এঁদের দিয়ে ফিতে কাটাতে চান, তাহলে জেনে নিন, কে কত পারিশ্রমিক নেবেন। অনেকটাই যজমান ডাকার মতো বিষয়। সঙ্গে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বদলে যেতে পারে হিসেব, এবং সব হিসেব টাকায় (ভাগ্যিস, 'নগদে' লেখা হয়নি)।

ব‍্যাপার এমন গুরুতর কিছু নয়, টেলিভিশনের বেশ কিছু তারকা, তাঁরা দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করতে কত পারিশ্রমিক নেবেন বা নিতে পারেন, তার একটা রূপরেখা দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। এতেই বেধেছে বিপত্তি। যাঁরা ট্রোল করেন, তাঁরা রেগে যান না আনন্দ পান, বোঝা শক্ত। শুধু ফিতে কাটতেই এত টাকা কেন নেবে- এজাতীয় অকিঞ্চিৎকর প্রশ্ন কেউ কেউ করছে বটে, তেমনই আবার কে কত নিচ্ছেন, যাঁদের নাম তালিকায় নেই, তাঁরা ঠিক কত নিতে পারেন- এমন একটা জন-আগ্রহও তৈরি হচ্ছে সহজেই। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, দুর্গাপুজোর বাজারে এমনটা নতুন নয়। আগেও ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। তাহলে হঠাৎ জনপিণ্ডর সুড়সুড়ি লাগছে কেন?

যত দূর সম্ভব, পুজোর বাজার সঠিকভাবে জমে ওঠার আগেই টাকার পাহাড় দেখে ফেলেছে বাঙালি, রাজনৈতিক কাওতালি পেরিয়েও তা একটা জাতিকে দরিদ্র বোধ করিয়েছে। না, প্রতারিত নয়, প্রবঞ্চিত নয়, হঠাৎই নিজেদের খানিক খাটো ভেবে নিয়েছে জনসাধারণের একাংশ। আমার পকেটে কেন নেই এত টাকা- পুরন্দর ভাটের কাব‍্যপংক্তির ওপর খুচরো বাটপাড়ি করে বলা চলে, এমন ভাবনাই অনেককে পীড়া দিয়েছে। তাই স্বাভাবিক কোনও পেশাদারি বোঝাপড়াও হয় মানুষের চোখে লাগছে, নয় তার কৌতূহল উসকে দিচ্ছে খানিক।

আরও পড়ুন: সুশান্ত থেকে কে কে- আমাদের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয় মুহূর্তের প্রতিশোধ

এই তালিকায় নাম রয়েছে টেলিভিশন ও সিনেমার প্রখ্যাত অভিনেত্রী শোলাঙ্কি রায়ের। এই মুহূর্তে স্টার জলসা-র 'গাঁটছড়া' ধারাবাহিকে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। ইনস্ক্রিপ্ট-এর তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি সরাসরি বলছেন, "এখানে তো কোনও আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণের প্রশ্ন উঠছে না। বিষয়টা একান্ত পেশাদারি। ফিতে কাটা হোক বা উদ্বোধন, সেটা অভিনেতা বা অভিনেত্রী পেশার খাতিরেই করেন।" সঙ্গে অবশ্য একথাও বললেন তিনি, "আমার যে পারিশ্রমিকের অঙ্ক জনসমক্ষে এসেছে, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করে লেখা হয়নি। আমি বিশেষ উদ্বোধন করি না। মাঝেমধ্যে করি। এছাড়াও পুজো পরিক্রমায় যাই। ভাল লাগে।"

Solanki Roy

শোলাঙ্কি রায়

এই প্রসঙ্গে আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা দত্ত বললেন, "অবশ্যই আমি উদ্বোধন করতে যাই। ইন্ডাস্ট্রিতে দু'ধরনের অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন। কেউ কেউ পুজোর সময় একেবারেই কাজ করতে চান না। নিজের মতো করে সময় কাটাতে চান। কেউ কেউ আবার এই সময়টাই বেশি করে ইভেন্টে উপস্থিত থাকেন। এখন এই সংখ‍্যাটা মিলেমিশে গেছে। কারণ, সারা বছর অভিনয়ের ফাঁকে খুব একটা এই ধরনের ইভেন্টে উপস্থিত থাকতে পারি না আমরা। ফলে, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া খুব একটা বুঝতে পারি না। কিন্তু দুর্গাপুজো বাঙালিদের এত বড় উৎসব, সেই সময় অনেক মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। তাদের ঠিক কতটা ভালো লাগছে আমাদের কাজ, সেটা বোঝা যায়।"

Swastika Dutta

স্বস্তিকা দত্ত

এই তালিকাতেই রয়েছে অভিনেত্রী অর্কজা আচার্যর নাম। তিনি সরাসরি অস্বীকার করছেন এই সংবাদ। পুজোর সময় তিনি কোথাও উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন না, এমনকী, তিনি কলকাতার বাইরে থাকতে পারেন বলেও জানান। তবে এর পাশাপাশিই অর্কজা বললেন, "যদি উদ্বোধন করতেও যাই, সেখানে কী পারিশ্রমিক নেব, এটা আমার ব‍্যক্তিগত বিষয়। জনসমক্ষে তা জানাতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না।"

Arkoja Acharyya

অর্কজা আচার্য

তবে এর বাইরে গিয়ে, বিনোদনের দুনিয়ার সঙ্গে ফিতে কাটার সম্পর্ক এই দুর্গাপুজোর বাজারে একটু অন‍্যভাবে নেড়েচেড়ে দেখা প্রয়োজন। এই বছরদশেক আগেও পুজোর ফিতে কাটা বাংলা বিনোদনের জন্য যতটা সুবাতাস, যতটা টাটকা নিশ্বাস বয়ে নিয়ে আসছিল, তা আচমকা ভীষণ ম্রিয়মাণ। হঠাৎই টেলিভিশনে একের পর এক সিরিয়াল বন্ধর সংবাদ হোক, বা পুজোয় বাংলা সিনেমা রিলিজের যে বান ডাকত দিনকয়েক আগে পর্যন্ত, তা প্রায় নিভু নিভু আঁচে এসে ঠেকা হোক।

কেন এই পরিস্থিতি হলো আচমকা? অতিমারীর কোপ, না কি অন্য কোনও গোপন খেলা কাজ করছে এই হঠাৎ ভাটার নেপথ্যে? বোঝা মুশকিল। করোনার পর উৎসবের আমেজ গিয়েছিল জলাঞ্জলি। তাও ২০২০ সালে 'ড্রাকুলা স‍্যর', 'রক্তরহস‍্য', ২০২১ সালে 'গোলন্দাজ', 'বনি' বা 'এফআইআর'- শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর আবহকে সঙ্গী করেই বক্স অফিসে লক্ষ্মীলাভ করেছিল খানিক। এবছর পুজোয় বাধানিষেধ নেই। প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের প্রবেশাধিকারে কোনও শতাংশের কাঁটা নেই। তাও কেন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না বাংলার টিনসেল টাউনকে?

পুজোর ফিতে কাটা মানে বছরপাঁচেক আগে পর্যন্তও ছিল বাংলা বিনোদনের জোয়ার। আরও পনেরো বছর পিছিয়ে গেলে ছবিটা আবার তেমন ছিল না মোটেই। ধরে নেওয়া যেতে পারে, ২০১০ সালে 'অটোগ্রাফ'-এর মুক্তির পরপরই এই প্রবণতা স্পষ্ট হয় খানিক। অনুপম রায়ের 'আমাকে আমার মতো থাকতে দাও' সে-বছর বাঙালির পুজোকালীন থিম সং হয়ে গিয়েছিল অচিরেই। স্বর্ণযুগে 'পুজোর গান' বলে বাংলায় যে নিয়ত এবং শক্তিশালী বাজার ছিল, তা হারিয়ে গিয়েছিল বহুদিন। পুজোর সময় বাংলা বেসিক ডিস্কের বিক্রিবাটা আস্তে আস্তে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছিল, সিডি নামক বিষয়টি বিলীন হয়ে যেতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই। কলকাতা থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেল পার্ক স্ট্রিটের এককোণের ঝলমলে 'মিউজিক ওয়ার্ল্ড'-এর অস্তিত্ব। তারপর অন্তত সিনেমার গান এবং পুজো রিলিজের এক নতুন বাণিজ্য-অভিমুখ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু এক দশক পেরতে না পেরতেই তা এভাবে হারিয়ে যাওয়ার মুখে কেন? শঙ্খ ঘোষের কবিতা বলেছিল, 'এক দশকে সংঘ' ভেঙে যাওয়ার কথা। তবে কি এক দশকেই জনরুচি বদলাল? এবার পুজো রিলিজের ফিতে কাটার হিড়িক কই? নেই বললেই চলে। একমাত্র 'কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন'-এর ট্রেলার মুক্তি পাবে আজ, যা পুজোয় মুক্তি পাবে। পুজোয় আর কোন কোন বাংলা সিনেমা সাড়ম্বরে মুক্তি পাচ্ছে এবার? একনিষ্ঠ দর্শককে প্রশ্ন করলেও তাঁকে ভেবে উত্তর দিতে হবে।

একইভাবে, টিআরপি-র তুঙ্গ লড়াইয়ে হঠাৎ কেন চড়া? দূরদর্শন যুগ পেরিয়ে রবি ওঝা-র হাত ধরে 'এক আকাশের নীচে' ছিল বাংলা টেলিভিশনের জরুরি মাইলফলক। ২০১০ সালে 'গানের ওপারে'-তে সিরিয়ালের অন‍্য ধারা তৈরির কিছুটা চেষ্টা ছিল। তারপর থেকে একটু নজর করে দেখলে, পুরনো থোর বড়ি খাড়ার বদলে নতুন খাড়া বড়ি থোর এল, এল কিছুটা নতুন ফরমুলা। সেই ফরমুলা বা নীল নকশা তো দর্শককে বেঁধে রাখতে কখনও ব‍্যর্থ হয়নি এই এক দশকে। কিন্তু এবার কি হচ্ছে? এবার কি দর্শক আবার অন্য কিছু চাইছেন?

বলিউডের অবস্থাও তথৈবচ। দক্ষিণ ভারত দক্ষিণ ভারত করে যতই লাফাই, তামিল, তেলুগু, মালয়ালি বা কন্নড় ছবির আঞ্চলিকতার রাজনীতিটা আমরা নিজেদের ছাঁচে গড়েপিঠে নিতে পারছি কই? বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে 'হাওয়া' ছবির দর্শকরা যখন হাশিম মাহমুদের 'সাদা সাদা কালা কালা'-তে উদ্বাহু নৃত্য করছেন, যখন একরকম কার্নিভালের পরিবেশ প্রকট হচ্ছে খোদ সিনেমাঘরের ভেতর, তখন আমাদের দর্শকদের মুখ কেন বেজার?

পুজোর বাকি আর একটি মাসও নয় পুরোপুরি। সামগ্রিকভাবেই দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কেন্দ্রীয় দাদাগিরি, মূল‍্যবৃদ্ধি, সহিংস ট্রোলিং এবং পাল্টা হুমকির রাজনীতির হারাকিরিতে ক্লান্ত বাঙালি কি এবার সত্যিই ফিতে কাটার পরের একগাল হাসিমুখে ধরা দেবে? হলের দরজায় দরজায় হাউজফুল বোর্ড আবার দেখা যাবে ফুরফুরে মেজাজে? প্রশ্ন সহজ হলেও উত্তর হয়তো জানা নেই। তবে আকাঙ্ক্ষা, এখানেও বাংলাদেশের সিনেমা হলের পরিবেশ তৈরি হোক। বাঙালির আনন্দ থেকে রাগ, বিনোদন আবার হয়ে উঠুক তার যথার্থ আধার। ফিতে কাটলেই যেন চিচিং ফাঁক, আলিবাবার চোখের সামনে ফুটে উঠুক যথার্থ এন্টারটেনমেন্ট, উৎসবের পুরনো প্রোজেক্টর নতুন আলো ফেলুক।

More Articles