খেজুর গাছে ঝুলে আছে ফাঁকা হাঁড়ি, কোথায় গেলেন বাংলার শিউলিরা?
Nalen Gur: এককালে গ্রামবাংলা জুড়ে দেখা যেত গুড় সংগ্রাহক শিউলিদের। তবে এখন তাঁদের অবস্থা কেমন?
“দইওয়ালা, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা!”
রাতের চাদরটুকু সরিয়ে একটু একটু করে ফুটে উঠছে আলো। কে যেন ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে বারবার; আর বলছে, “চল অপু, রেলগাড়ি দেখতে যাবি?”। তারপর সারা স্বপ্নে অমল হয়ে জানলার ধারে বসে অপেক্ষা করা। দইওয়ালা, রেলগাড়ি… সব অনেকদূর চলে যায়। একটু একটু করে আলোর পরত এসে লাগে গায়ে। এখনও কেমন শিশির লেগে আছে ঘাসে। শীতের ভোরে ছোট্ট অমলরা বসে রইল জানলার ধারে। ওই যে দূরে, কে জানি আসে! দইওয়ালা! না, তেমন তো কেউ নয়। এক হাতে কলসি, আরেক হাতে দা নিয়ে ওঁরা গাছের দিকে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ে খেজুর গাছ, তাল গাছের সামনে। তারপর তরতর করে উঠে যায় ওই ওপরে। কেউ আবার গাছে বাঁধা হাঁড়ি নিয়ে এগিয়ে পড়ে ঘরের দিকে। শীতের ভোরে অবাক বিস্ময়ে শিশুর চোখ দেখে চলে সেসব কাণ্ড-কারখানা। আহা, আমিও যদি ভোরের ‘শিউলিদের’ মতো হতাম!
এসব আজ অলীক কল্পনা মনে হয় অনেকের কাছে। শিউলি মানে তো ফুল; এর বাইরে আমরা বেরতেই পারি না আর। শরতের ভোরে গাছের নিচে পড়ে থাকা সাদা শিউলির গোছাতেই সীমাবদ্ধ আমাদের গল্পকথা। সেই ভোরও নেই, গ্রাম, মফস্বলের ছোট্ট অমলরাও কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, যে শিউলিরা গাছের নিচে থাকে না, গাছের ওপরে যাঁদের কারবার, তাঁদের কথা মনে পড়ে? রোজকার হাওয়ায় হালকা শীতের নাচন এলেই যারা বেরিয়ে পড়েন হাঁড়ি নিয়ে। খেজুর, তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে তৈরি করেন গুড়, তালমিছরি। খেজুরের রস, নতুন গুড়ের স্বাদ এই সংগ্রাহকদের ছাড়া কখনই আমরা পেতাম না। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, আলপথে হেঁটে চলা সেই গুড় সংগ্রাহকদেরই চলতি নাম ‘শিউলি’। নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বিশ্বকোষ’, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসেরে ‘বাঙ্গালাভাষার অভিধান’-এ শিউলির এই অর্থটিরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন : নলেনের স্বাদ নোনতা! শেষ পাতে গুড়ের বদলে কেমিক্যাল খাবে বাঙালি?
কাশফুল দুলতে দুলতে, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলার মাঝেই শুরু হয় দুর্গাপুজো। পুজো শেষ হওয়ার পরই নড়েচড়ে বসেন এই শিউলিরা। বছরের বাকি সময় এঁদের কোনও নির্দিষ্ট কাজ থাকে না। কেউ ঠিকা শ্রমিকের কাজ করেন, কেউ রাজমিস্ত্রি। ঘরে দু’বেলা দু’মুঠো জোগাড়ের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেন। কিন্তু একটু শীত পড়লেই জেগে ওঠে শিল্পীসত্তা। হ্যাঁ, গুড় সংগ্রহ ও তৈরি একটি শিল্প তো বটেই! খেজুর, তাল গাছের একেবারে মাথায় উঠে পড়েন শিউলিরা। তারপর দা দিয়ে নিপুণভাবে নির্দিষ্ট আকারে কেটে ফেলেন গাছের শীর্ষভাগের নরম অংশটি। তারপর বাঁশের ছোট্ট নল ঢুকিয়ে সেখানে বেঁধে দেন হাঁড়ি। এরপর সেই রস এনে জ্বাল দিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় গুড়। তাল গাছের রস থেকে তৈরি হয় তালমিছরি। এই যে গাছের একদম ওপরে বা একেবারে ‘শিয়রে’ উঠে রস সংগ্রহ, সেখান থেকেই অপভ্রংশ হয়ে শিউলি নাম এসেছে বলে মনে করা হয়। গাছের ‘শিয়রে’ উঠে কাজ করেন বলে ‘শিয়রী’, কালে কালে সেটাই বদলে যায় ‘শিউলি’-তে। একটা সময় এমন গুড় জ্বাল দেওয়ার গন্ধেই মেতে উঠত গোটা এলাকা। নতুন গুড়ের গন্ধ জানান দিত, শীতের মাস এসে গিয়েছে।
পুরুলিয়া, বাঁকুড়া থেকে জয়নগর, বসিরহাট, হাসনাবাদ, মেদিনীপুর- গোটা রাজ্যেই ছড়িয়ে রয়েছেন শিউলিরা। দরিদ্র পরিবার, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, সমাজের পিছিয়ে পড়া সমাজের প্রতিনিধি, তবুও গুড় সংগ্রহকে এতদিন আঁকড়ে রেখেছেন তাঁরা। আর মরসুম এলে মূলত তাঁদের জন্যই আপেক্ষা করে বসে থাকেন মিষ্টি বিক্রেতারা। গুড় শিল্পের কাঁচামালের জোগানও দেন এই শিউলিরা। কাজেই বাংলার শীতকালীন ভোজন, ইতিহাস ও চর্চায় এঁদের অবস্থান কোনও অংশে কম যান না। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী থেকে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নানাভাবে নানা রকম অনুসঙ্গ নিয়ে হাজির হয়েছেন শিউলিরা। এমনকি, বলিউড পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল তাঁদের দৌড়। সত্তরের দশকে ‘সওদাগর’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন বিগ বি অমিতাভ বচ্চন। সেখানে তাঁর চরিত্রটির পেশা ছিল খেজুর রসের কারবারির, নাম ছিল ‘মোতি শিউলি’। পাশাপাশি বাংলার আবহমান ধারায় শরতের শিউলির সঙ্গেই হাজির হন শীতের শিউলিরা। এটা তো তাঁদেরও বাংলা, তাঁদেরও সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ধারা।
কিন্তু মেঘ এলে প্রখর, উজ্জ্বল সূর্যও তার আড়ালে ঢাকা পড়ে। মানতে না চাইলেও, একই মুদ্রার দু’টি পিঠই সমানভাবে সত্য। ২০২২-এর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিপ্লবের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। নাগরিক ঢেউ আস্তে আস্তে গ্রাস করছে মফস্বল, গ্রামকে। নস্টালজিয়ার খাতায় তালিকাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কবীর সুমন একসময় গেয়েছিলেন, ‘এই ফাটকাবাজির দেশে স্বপ্নের পাখিগুলো বেঁচে নেই’। পেটকাটি, চাঁদিয়াল পেরিয়ে কেমন আছে সেই শীতের শিউলিরা? প্রশ্নটি শোনার পর ওই মানুষগুলোর মুখের শুকনো হাসি আরও মিলিয়ে যায়। যারা আগে দাপিয়ে বেড়াতেন, গাছে উঠে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতেন হাঁড়িভর্তি টাটকা, মিষ্টি খেজুর রস, তাঁদের এখন বয়স হয়েছে। শিরওঠা হাত কেঁপে ওঠে, দৃষ্টি শূন্য। অভাবের সংসার যেন আরও কোটরে ঢুকে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই আর শিউলি বা গুড় সংগ্রাহক হতে চাইছেন না। বেকার থাকতে থাকতে পাড়ি দিচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে। কিংবা শহরে গিয়ে রাজমিস্ত্রি, মজুরের কাজ করছেন। কেউ আবার অন্য কোনও কাজে যুক্ত হচ্ছেন। ঐতিহ্য, খেজুর রসের গন্ধ তো আর পেট ভরাবে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে, ওই ক’টা টাকায় সংসার চলে না যে! এদিকে বাড়তি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরাও গুড়ে ভেজাল মেশাচ্ছেন। বাজারে আসছে প্যাকেটজাত, টিউবজাত গুড়।
আরও পড়ুন : গুড়ের সন্দেশকে টেক্কা দিল চকোলেট সন্দেশ! মিষ্টিমুখেও সাম্রাজ্যবাদ
এসবের মধ্যে বাধ সেঁধেছে খেজুর গাছ। নগরায়ন ও অন্যান্য উন্নয়নের জোয়ারে কমছে সবুজ। কমছে খেজুর গাছও। আগে যে পরিমাণ গাছ ছিল, এখন অনেকটাই কমেছে। জ্বালানির জন্য খেজুর গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। গাছ কমে গেলে সেই গাছের রসও কমবে। শিউলিদের মুখে তাই হাসি নেই। এদিকে শিউলিদের কাজে ভাটা পড়া মানে শীতের গুড় ও মিষ্টি তৈরির কাজেও সমস্যা হবে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেন শিউলিরা। বাঙালির মিষ্টিমুখ তো আজও কমেনি। শীত এলে তাই খোঁজ পড়ে খাঁটি নলেনগুড়, জয়নগরের মোয়ার।
সেদিকে তাকিয়েই কোমর বেঁধে প্রতিবছর নেমে পড়েন বাংলার শিউলিরা। তাঁদের কি মনে পড়ে, শীতের ভোরে জানলার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা অমলদের কথা? “আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম তো যেতুম”। সেই সময়টায় আবার হয়তো ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় মানুষগুলোর। কিন্তু তাঁদের তো আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই…