তুঘলক থেকে বিবেকানন্দ, ইলিশ মানে মৃত্যু? উত্তর রয়েছে বাংলা সাহিত্যে
ইলিশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লেখালিখি কিছু কম হয়নি। ২০১১ সালে হঠাৎ বাজার করতে বেরিয়ে ছশো-সাতশো টাকা দাম দেখে সুনীলের পিলে চমকানোর কথা মনে পড়েছিল। ভাগ্যিস এখনকার অবস্থা তাঁকে দেখে যেতে হয়নি।
রথ টানলে যেমন দুর্গা আসে, তেমনই রথ টানলে আসে নাকি ইলিশও। অন্তত আগেকার দিনের লোকজন তাই বলতেন। ইলিশ নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির মাতামাতি কম না। বরং খাবারের রঙ্গমঞ্চে বছরের এই নির্দিষ্ট সময়টিতে ইলিশের আনুষ্ঠানিক প্রবেশ এবং প্রস্থানকে মধ্যবিত্ত বাঙালি প্রায় পুজোর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। উৎসব বলা যেত। কিন্তু উৎসবে আপামরের অংশীদারি থাকে। ইলিশে সাধারণের অংশীদারি যে কোনওকালেই ছিল না, একথাটা নিতান্ত ফাঁপা না। একটু পরে তার প্রমাণ দেব। আপাতত, একটা গল্প বলা যাক।
অনেকদিন আগের কথা। তখন দিল্লির মসনদে মুহম্মদ-বিন-তুঘলক। জীবনের নানা পর্যায়ে নানা কীর্তির স্বাক্ষর রেখে আপামরের কাছে নাম কুড়িয়েছেন পাগলা রাজা। সেই রাজা জীবনের সায়াহ্নে ছুটলেন গুজরাত। কী, না, গুজরাতে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তা দমন করতে হবে। সেনা-টেনা নিয়ে দিব্য দমনপীড়ন চলছে। তুঘলক ব্যাপারটাকে বেশ স্পোর্টিংলি নিচ্ছেন আর কী, এমনিতেই তার লাফঝাঁপের শেষ নেই, তার ওপর এমন একটা উত্তেজনার ব্যাপার, স্বভাবতই তিনি মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত। কখনও ডাঙায় বিদ্রোহীদের তেড়ে যাচ্ছেন, কখনও নৌকোয়। জলপথে তেড়ে যাওয়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ রয়েছে। এমনই এক বিকেলবেলায় জলাভূমির মধ্য দিয়ে নৌকো ছুটে চলেছে, হঠাৎ একটা মাছ লাফিয়ে উঠে পড়ল নৌকোয়। ঝকঝক সাদা রং, গড়নে চোখ টানে। সম্রাটের তো খুব কৌতূহল, এটা কী মাছ? কেউই জানে না। সেনারা কেউই স্থানীয় না। তা শুনে তুঘলকের কি আর মন ভরে? বললেন, "এটা কেটে রান্না করে দাও। এখনই। আমি খাব।" মন্ত্রী আর পারিষদরা আঁতকে উঠেছে তাই শুনে। বলে কী! কোথাকার মাছ ঠিক নেই, কেমন খেতে, বিষাক্ত কি না কিছুই জানা নেই। তার ওপরে রোজার মাস। রাজা তো বলেই খালাস, ঘুম উড়ল তাদের! অনেক বুঝিয়েও ফল হলো না। মাছ রান্না হলো এবং তুঘলক খেলেন। খুব সম্ভবত অনেকটাই খেলেন। রাজকীয় খাওয়া বলে কথা! দিল তার পেট ছেড়ে। সেই কারণেও হতে পারে, অন্য কারণেও হতে পারে, এর কয়েকদিনের মাথায় তুঘলক মারা গেলেন।
লিখছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ঐতিহাসিক সত্যাসত্য জানা নেই, তবে গুজরাতে সত্যি ইলিশ পাওয়া যায়। 'পাল্লা' নামেই চেনে তাকে লোকে। বিবেকানন্দ একবার পদ্মার বুকে পুরো এক টাকা দিয়ে ষোলোখানা ইলিশ কিনেছিলেন। বেলুড় মঠেও একবার এমন ইলিশের তেল দিয়ে ভাত, ডাল দিয়ে ভাজা মাছ, ইলিশের ঝোল, টক খেয়েছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে সেদিনই তাঁর মৃত্যু হয়। এইসব দেখে-শুনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন,
কোনও মৃত্যুর সঙ্গেই ইলিশ ভক্ষণের নিশ্চয়ই কোনও সম্পর্ক নেই। আসল কথা হচ্ছে, খুব ভাল জিনিস একসঙ্গে বেশি আহার করতে নেই। বাঙালদের অভ্যাস আছে। তারা তবু অনেকটা খেয়ে নিতে পারে। বিবেকানন্দ বাঙাল ছিলেন না। তাই সহ্য করতে পারেননি। আবার ভক্তদের মতে, তিনি পুণ্যাত্মা মানুষ, ওই রাতেই তাঁর চলে যাওয়ার কথা ছিল, যাওয়ার আগে বেশ তৃপ্তি করে ইলিশের সব রকম স্বাদ নিয়ে গেলেন।
যাই হোক, ইলিশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লেখালিখি কিছু কম হয়নি। ২০১১ সালে হঠাৎ বাজার করতে বেরিয়ে ছশো-সাতশো টাকা দাম দেখে সুনীলের পিলে চমকানোর কথা মনে পড়েছিল। ভাগ্যিস এখনকার অবস্থা তাঁকে দেখে যেতে হয়নি।
ইলিশ যে আম-বাঙালির মাছ ছিল না, 'প্রাকৃতপৈঙ্গল'-এর চরণগুলি তারই সাক্ষ্য দেয়।
অগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক দুগ্ধ সজুক্তা
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা(ই) পুনবন্তা।।
কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, গরুর দুধ, মৌরলা মাছ ও নালিতা শাক- আমবাঙালির রোজের খাবার বোধহয় ছিল এই। মুকুন্দরামের 'চণ্ডীমঙ্গল' বলছে,
কটু তৈলে রান্ধে রামা চিতলের কোল।
রুহিতে কুমড়ো বরি আলু দিয়া ঝোল।।
কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ।
মুঠো নিঙাড়িয়া তথি দিল আদারস।।
আসি বিজয়গুপ্তের 'মনসামঙ্গল'-এ
মৎস্য কাটিইয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ।।
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ।
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খসুনা মাছ।।
ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জড়ায়ে সুতা।
তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা।।
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মৎস্য দিয়ে রান্ধে মরিচের ঝোল।।
ময়মনসিংহের 'ডাকের বচন' বঙ্গের নানান খাবারের উল্লেখের জন্য প্রসিদ্ধ। সেখানে দেখা যাক,
পলতাশাক রুহি মাছ। বলে ডাক ব্যঞ্জন সাঁচ।।
মদগুর মৎস্য দায়ে কাটিয়া। হিং আদা লবণ দিয়া।।
তেল হলদি তাহাতে দিব। বলে ডাকে ব্যঞ্জন খাব।।
পোনামাছ জামিরের রসে। কাসন্দি দিয়া বেজন পরশে।।
তাহা খাইলে অরুচি পালাএ।।
কোথাও ইলিশের নামমাত্র উল্লেখ নেই। আপামরের সাহিত্যে তথা গানে ইলিশের উল্লেখ এ-সময় তেমন পাওয়া ভার। পাচ্ছি কোথায়, না দিগেন বর্মনের 'ইলিশ পুরাণ' বইমাফিক সর্বানন্দের 'টীকাসর্বস্ব' বইয়ে। তবে সেখানে তা 'ইল্লিষ'। বলাই বাহুল্য, এই বই সাধারণের বই নয়। সর্বানন্দও আপামরের মধ্যে পড়েন না। 'ইলিশ পুরাণ'-এই পাচ্ছি দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনও 'ইলিশ'-এর তেল ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেছেন। সরষে শাক দিয়ে একবার ইলিশ রান্নার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, লখিন্দরকে বেহুলার ভ্রাতৃবধূ তারকা সেই পদ খাওয়াচ্ছে রান্না করে। বেহুলার বাবা পাত্রপক্ষকে যে পনেরো পদের মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করেন, ইলিশভাজা পাচ্ছি সেখানেও। কিন্তু কোনওটিতেই ইলিশের তেমন গুরুত্ব নেই। বরং শাস্ত্রকারেরা 'মীনশ্রেষ্ঠ' বলেছেন 'রোহিত মৎস্য' অর্থাৎ রুইকেই। কে জানে, সি ফুডে তাদের অ্যালার্জি ছিল কি না, শাস্ত্রে সেসবেরও খুব একটা উল্লেখ নেই। প্রবাদও বলছে, "মাছের মধ্যে রুই, শাকের মধ্যে পুঁই।" বাংলা সাহিত্য একটু খতিয়ে দেখলে চোখে পড়বে, ইলিশের গুরুত্ব বেড়েছে মূলত ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার সময়। ১৭১১-'১২ সালে রামেশ্বর চক্রবর্তী 'শিবায়ন' লিখছেন, তাতে ইলিশের যে উল্লেখ আছে সেও ওজনহীন। এর মোটামুটি চার দশক পরে ভারতচন্দ্র লিখছেন 'অন্নদামঙ্গল', সেখানে পাচ্ছি 'পাঙ্গাস ইলিশা'। এখানে 'পাঙ্গাস'-এর অর্থ অনেকেই মনে করেন বড় বা বৃহৎ। সে যত বড়ই হোক, জায়গা পেয়েছে একত্রিশটি মাছের তালিকায় একত্রিশ নম্বরে। অথচ রায়গুণাকর রাজসভার কবি।
কবি পাঁঠা, পাকা মেষ, দইয়ের আগা, ঘোলের শেষ।
শাকের ছা, মাছের মা, ডাক বলে- বেছে খা।।
বাংলার প্রথমদিকের উপন্যাস-গল্পেও ইলিশের তেমন উল্লেখ রয়েছে কি না, জানা নেই। ফের ইলিশের দেখা পাওয়া যাচ্ছে ১৮৯৭-এ 'কষ্টিপাথর' নাটকে। রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাচ্ছি, আবদুল মাঝির কথা-
হালের কাছে আবদুল মাঝি, ছুঁচলো তাঁর দাড়ি, গোঁফ তার কামানো, মাথা তার নেড়া। তাকে চিনি, সে দাদাকে এনে দিত পদ্মা থেকে ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম।
বোঝা যাচ্ছে, ঠাকুরবাড়িতে পদ্মার ইলিশের তখন বেশ কদর। ছড়ায়-প্রবাদে দেখা যাচ্ছে, ইলিশ এসময় মাছের রাজা হয়ে গিয়েছে। রুই-কাতলা তার প্রজা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের ঠিক কোন সময় এই বদল, তা নিয়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে। এরপর মানিকের 'পদ্মানদীর মাঝি'-র সেই বিখ্যাত উচ্চারণ,
বর্ষার মাঝামাঝি।
পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।...শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে নীলাভ মণির মতো দেখায়।
কুবের মাঝি আজ...।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইলিশের ছড়াছড়ি। সত্যেনের 'ইলশে গুঁড়ি' ছড়ায় ঘুরেফিরে এসেছে এই প্রসঙ্গ। কখনও প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদায়, কখনও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখালিখিতে। কখনও বুদ্ধদেব গুহ, কখনও বুদ্ধদেব বসু।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ -উৎসব।
আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ধারাবাহিকভাবে তখন লিখছেন বুদ্ধদেব বসু। প্রমথনাথ বিশীর তো গল্পই রয়েছে 'গঙ্গার ইলিশ'। শক্তির লেখায়, মোহাম্মদ রফিকের কবিতাতে ইলিশ এসেছে। ইলিশ নিয়ে সংকলন করেছেন মঈনুল হাসান ও মোজাফফর হোসেন, 'কল্পে গল্পে ইলিশ'। সৈয়দ আহসানের বর্ণনায়, সতীনাথের 'জাগরী'-তে, নামের তালিকা শেষ হওয়া ভার। বেশিরভাগটাই মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা। তাই বর্তমানে ফের ইলিশ নাগালের প্রায় বাইরে গিয়ে ঝুলোঝুলি করায় তাদের আক্ষেপের শেষ নেই। আপামর বাঙালির মধ্যে আক্ষেপ খুব একটা চোখে পড়ে না। বিবেকানন্দের আমলেই যে মাছের দাম চার আনা, তাও বাংলাদেশের মতো মাছবহুল জায়গায়, সেই মাছ সাধারণ মানুষ খুব বেশি চেখে দেখতে পেরেছে বলে তো মনে হয় না। এখনও ইলিশ নিয়ে আমরা যারা আহা-উহু করি, তারা বাঙালি বলতে মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণকেই বুঝি। যাদের নস্টালজিয়া-বিলাসের সুবিধে রয়েছে। সাধারণ মানুষ মুখে মুখে ইতিহাস মনে রাখে, তাই নিয়ে রোমান্টিক স্মৃতিকাতরতার সময়, সুযোগ বা সুবিধে কোনওটাই তাঁদের নেই। তাদের সেই ইতিহাসেও ইলিশ কখনও ছিল কি না, গবেষণার বিষয়।