স্রেফ শ্যামাসংগীতই নয়, স্বতন্ত্র শাক্তদর্শন ছিল নজরুলের
Kazi Nazrul Islam: দেবীকে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত হতে আহ্বান করছেন এক ভক্তকবি। মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর প্রলয়ঙ্করী রূপ।
দেশমাতৃকা বিষয়ে যে ধারণাটি উত্তর ভারতে বহুল-প্রচলিত, যে সিংহবাহিনীর অবয়বটি আমরা সচরাচর দেখতে পাই, আরএসএস উগ্র হিন্দুত্বের প্রতীক হিসেবে যে দেবীকে সামনে রেখে সনাতন ভারত গড়ার ডাক দেয়, তার সঙ্গে বাঙালির অপরিচিতিটাই বেশি। বাঙালি সমাজের একটা বড় অংশের মন আবহমানকাল থেকেই শাক্তরসে দ্রবীভূত। ভক্তিতে, বিপ্লবে, মেদুরতায় সে ডেকেছে তার ঘরের শ্যামা মেয়েকেই। নজরুল ইসলামের কালীকল্পও এই একই পথের অনুসারী। নজরুল-উৎসাহীদের মধ্যে এমন একটা চালু ধারণা আছে যে, পুত্রশোকে বিষাদসিন্ধুতে ডুবন্ত নজরুল বরদাচরণ মজুমদারের সান্নিধ্যে আসার পর থেকেই কালীভক্ত হয়ে ওঠেন। ক্রমে কালীগানগুলি লেখেন বেদনাভার লাঘব করতে। এই ধরনের ব্যখ্যা তৈরির বড় কারণ, নজরুলের দার্শনিক প্রস্থান সম্পর্কে সুবিবেচনার অভাব। বেশিরভাগ গবেষকই নজরুলের তারুণ্যের ঝোঁক পেরিয়ে তাঁর মনের অতল চলাচল পড়তে পারেন না। কিন্তু কাজ তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, একদম শুরু থেকেই বাংলার শাক্তচিন্তার সমষ্টিগত স্রোতে মনের শ্যামনৌকা ভাসিয়েছিলেন নজরুল। এক্ষেত্রে ধর্মের আগেও জাতিসত্তা তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে। একজন বাঙালি হিসেবেই কালীনির্জ্ঞানের বীজে কমবয়স থেকে জল-সার দিয়েছেন নজরুল। তারই সঙ্গে এসে জুড়েছে বিপ্লববাদের উত্তরাধিকার। এই নজরুলকেই মুছে ফেলতে চাইবে কট্টর ইসলামি মৌলবাদীরা। গানের থেকে ছেঁটে দেবে পঙক্তি। আর আত্তীকরণ করতে চাইবে আরএসএস। এই কারণেই মিথ সরিয়ে নজরুলের সৃষ্টির দিকে তাকানো জরুরি, নজরুলকে যে কখনও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা দলে টানার প্রচেষ্টায় সফল হবে না, এই প্রত্যয়ের বীজও লুকিয়ে আছে সৃষ্টিতেই।
নজরুলের লেখায় কালীপ্রসঙ্গ আসে একেবারে তাঁর লেখাজীবনের উন্মেষপর্বেই, যখন তিনি 'ধূমকেতু' পত্রিকায় সাংবাদিকতায় হাত পাকাচ্ছেন। 'ধূমকেতু'-র চতুর্থ সংখ্যাতেই নজরুলের ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতাটি প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে। ধূমকেতুর ক্ষেত্রে এটিই সম্পাদকীয় পাতা হিসেবে বিবেচিত হত, অর্থাৎ কবিতাটিকে সম্পাদকীয় বিবৃতি হিসেবেই পড়তে হবে। নজরুল মাতৃকাশক্তির বন্দনায় লিখছেন-
রক্তাম্বর পর মা এবার
জ্বলে পুড়ে যাক শ্বেত বসন
দেখি ঐ করে সাজে মা কেমন
বাজে তরবারি ঝনন্-ঝন্
দেবীকে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত হতে আহ্বান করছেন এক ভক্তকবি। মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর প্রলয়ঙ্করী রূপ। সর্বচরাচর যেন তাঁরই জাগরণে প্রতীক্ষায়। চিরায়মানা, চিরপ্রণাম্যাকে ডাকতে গিয়ে নজরুল এই কবিতার অন্য অংশে লিখছেন-
নিদ্রিত শিবে লাথি মারো আজ,
ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা,
পিয়াও এবার অ-শিব গরল
নীলের সঙ্গে লাল মেশা।
দেখা মা আবার দনুজ-দলনী
অশিব-নাশিনী চণ্ডি রূপ;
দেখাও মা ঐ কল্যাণ-করই
আনিতে পারে কি বিনাশ-স্তূপ।
নিদ্রিত শিবকে লাথি মেরে ব্রহ্মাণ্ড রণিত করে যে রূপ উদ্ভাসিত হবে, তা তো কালীর। লজ্জায় যার জিভ কাটা। এই যে দেবী, তিনি অবাঙালি দেশমাতৃকা নন। আবার তিনি শতচ্ছিন্ন মোটা কাপড় পরা দীন-দুঃখিনী নন। তিনি রক্তলোলুপ, সহিংস, নৃমুণ্ডমালিনী, বাঙালির রক্তে তাঁর নাম ধ্বনিত হচ্ছে শাক্তসাধকদের সৌজন্যে।
'ধূমকেতু' যাত্রা শুরু করে ১১ অগাস্ট, ১৯২২। এই পর্যায়ের লেখাগুলি নজরুল যখন লিখছেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। শুধু শ্যামাসংগীত দিয়ে নজরুলের কালীকল্পকে বিচার করা মানে তাঁর জীবনের এই প্রারম্ভিক পর্বকেই নস্যাৎ করা। এই পত্রিকাতেই বারবার এসেছে কালীপ্রসঙ্গ। উক্ত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত নবম সংখ্যায় একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের নাম, ম্যায় ভুখা হু। এই 'ম্যায়'টা আসলে ছিন্নমস্তা, ভবতারিণী, যিনি পূজা চাইছেন, এই পুজোয় বলি হচ্ছেন, সেই মায়ের ছেলেরাই। সেই বলিদানের পুণ্যে, শক্তির পদসঞ্চারে, দেশ কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পাবে, এমন অভিপ্রায়ই নিবন্ধে ধরতে চান নজরুল, সেখানে লেখা হচ্ছে-
অধীর ক্ষিপ্ত কন্ঠে দস্যি ছেলের দল চিৎকার করে উঠল, বল বেটি কি চাস নৈলে তোর একদিন কি আমাদের এক দিন,- কি চাস তুই? আশ্রয়? পাগলি বেটি কিন্তু কোথাও কয় না ফিরেও তাকায় না। একটা একটানা বেদনা-ক্রন্দন ধ্বনি তার আর্ত্তকন্ঠে বারবার গুমরে ওঠে, ম্যায় ভুখা হুঁ, মেয় ভুখা হুঁ।
কালীর একটা উদগ্র ভয়াল রূপ আকতে চাইছেন নজরুল। সন্তানের সঙ্গে তাঁর কথপোকথনের ভিত্তিমূল তো রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণের মা ছেলের তুইতোকারির চিরকালীন রীতিরেওয়াজ। তারই সঙ্গে অনুরণিত হচ্ছে বিপ্লবী শৌর্য।
'ধূমকেতু'-র নবম সংখ্যার এই লেখায় এক জায়গায় নজরুল লিখছেন,
মহা উৎসব পড়ে গেল আজ ছেলেদের মধ্যে। তারা রক্ত-যজ্ঞ করবে। মায়ের পূজোয় বলি হবে মায়ের ছেলেরাই।
এখানে নজরুল যে আত্মবলিদানের অহং তুলে আনছেন, তা বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে নতুন প্রস্তুতির আহুতি। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নরমপন্থী আন্দোলন এবং অসহযোগের চাপে এই আন্দোলনের তেজ অনেকটাই মিইয়ে গিয়েছিল। 'ধূমকেতু'-কে কেন্দ্র করে সেই সময়ের বিপ্লবীরা ফের একজোট হতে শুরু করে। ফলে পুলিশ 'ধূমকেতু'-র অফিসে হানা দিত মাঝেসাধেই। নজরুল 'ধূমকেতু'-তে একদিকে তুলে আনছেন, বিপ্লবীদের জীবন-আলেখ্য অন্য দিকে ঠিক গোপন সভা-সমিতিতে জড়ো হওয়া বিপ্লবীদেরই মতো কালীর শরণ নিচ্ছেন লেখায়। কাগজের পাতাই যেন অনুশীলন দল, যুগান্তর সমিতির মতো আখড়া। নজরুলের প্রেরণা যে স্পষ্টতই উনিশ শতকের প্রথম দশকের গোপন বিপ্লবী সমিতির কার্যকলাপ, তার ইঙ্গিত আছে নজরুলের লেখা একটি চিঠিতেই। 'কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা'-য় মুজফফর আহমদ জানিয়েছেন, পল্টন থেকে ফেরার পরে নজরুল নিজেই তাঁর কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি রানিগঞ্জের সিয়ারসোল গ্রামের বিপ্লবী মাস্টারমশাই নিবারণচন্দ্র ঘটক ঘটক দ্বারা তাঁর মতবাদের দিকে আকর্ষিত হয়েছিলেন। 'শেকল ভাঙার পণ ও বাংলার মেয়ে দুকড়িবালা' গ্রন্থের পরিশিষ্ট-'খ' অংশে গ্রন্থকার সৌরেন্দ্রকুমার চক্রবর্তী নিবারণচন্দ্র ঘটকের কাছে থাকা নজরুলের একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন। সেখানে বিপ্লবমন্ত্রের দীক্ষাগুরুর প্রতি নজরুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে নজরুল লিখেছেন,
মাস্টারমশায়, ...আমার ভিতরে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আপনারই করুণার দান। আপনার প্রেরণাতেই আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার শিখতে যুদ্ধে গেছিলাম। আজ আমি বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুল। কারার লৌহ কপাট ভেঙে ফেলার ডাকে আজ শত সহস্র তরুণের রক্তে ঝড়ের মাতন জাগে। সৃষ্টিকে নিয়েই তাদের উল্লাস, তাদের আনন্দের অভিব্যক্তি। স্রষ্টাকে তারা জানতে চায় না এমনই তারা অভাগা।... আপনাকে ভোলা যায় না- ভুলতে পারি না- ভুলতে পারবো না। আপনি আমার গর্ব আমি আপনার গৌরব।
বিপ্লবীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন নিবেদিতা। কালী প্রসঙ্গে কলকাতা শহরে তিনি দুটো বক্তৃতা দেন। পরে 'কালী দ্য মাদার' নামে এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে তাত্ত্বিকভাবে কালীদর্শন ব্যক্ত করলেন নিবেদিতা। এই বইটি বাংলার তদানীন্তন বিপ্লবীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বয়ং অরবিন্দ ঘোষের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই ছিল এই বই। নিবেদিতা মনে করতেন কালী ‘মৃত্যুরূপা মাতা’। জীবন যে মহাসমর্পণের জন্য সদাপ্রস্তুত, নশ্বর- তা নিবেদিতাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে কালীমূর্তি। বোমা বাঁধার সময়ে এই কালীকেই স্মরণ করেছে বিপ্লবীরা। এই বিশেষ মতের প্রচারকের ভূমিকায় নজরুল যখন প্রথমজীবনে আত্মপ্রকাশ করছেন, তাঁর লেখায় কালী এই বিশেষ চিন্তাস্রোতের অংশ হিসেবেই উদযাপিত হয়। নজরুল প্রয়োজনানুগ ভাবেই জাতিসত্তাকে এগিয়ে দেন, পরিচিতিসত্তার তুলনায়। অন্য বহু লেখায়, বিশেষত নবজাগরণের দমকা হাওয়ায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার প্রশ্নে নজরুল আবার পরিচিতি সত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেন। মনে রাখতে হবে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে 'ভারতমাতা' ছবিটি এঁকেছিলেন, প্রথমে কিন্তু তার নাম ছিল 'বঙ্গমাতা', অর্থাৎ স্বদেশচেতনার প্রশ্নে বারবার প্রাধান্য পেয়েছে বাঙালি অস্মিতা।
উল্লেখ্য, নজরুল 'ধূমকেতু'-তে অক্টোবরে একটি দীপাবলি সংখ্যাও করেছিলেন। সেখানে নামপ্রবন্ধটিতে (দেওয়ালি) তিনি লিখছেন-
পার তো তেমনি ক'রে আর একবার দেওয়ালি উৎসব কর। সে উৎসব যারা করে তারাও অমর হয়, যারা দেখে তারাও বড় হয়। ওগো বাঙালি ওগো ভারতের আগুন দেবতা, ওগো বিদারণের মহাপ্রলয় তোমরা তোমাদের বিস্মৃত মূর্তিকে আজ মনে করো। এই দেওয়ালির রক্ত আলো আর বোমা বিদারণের মধ্যে।
ছত্রে ছত্রে আগুন জ্বালার ডাক। বিস্মৃত মূর্তি বলতে নজরুল বোঝাতে চাইছেন কালী নামে ভরসা রেখে বোমা মারতে যাওয়ার আগে বিপ্লবীদের যে পূজা-উপাচার তার প্রজন্ম ভুলেছে। ফেরাতে চাইছেন সেই হারানো সময়কেই যা ঘুম কেড়েছিল ব্রিটিশের। সাধে কি আর তাঁর ওপর চটছে পুলিশ! প্রতিটি পাতা ধরে চলছে নজরদারি। অবশেষে নেমে এল সরকারি খাঁড়ার ঘা। 'ধূমকেতু'-র সম্পাদকীয় অংশে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশের জন্য ১২৪এ ও ১৫৩ক ধারায়, স্থিতাবস্থা নষ্টে ইন্ধনের অভিযোগে নজরুলকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ। আশ্চর্যের বিষয়, এর আগে নজরুল এই কাগজ থেকে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাকও দিয়েছেন। সরাসরি কোনও অ্যাকশন নেয়নি পুলিশকর্তারা। ঘুম উড়ল যে কবিতায়, তা আসলে কালীবন্দনাই (আনন্দময়ীর আগমনে) নজরুল সেখানে লিখছেন,
আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল
দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা— আসবি কখন সর্বনাশী?