'কালীর বেটা' কমলাকান্ত একই সঙ্গে সন্ন্যাসী ও প্রেমিক

Kamalakanta Bhattacharya: এক অন্ধকার কালের কবি কমলাকান্ত। তাঁর গানও তাই ভারতচন্দ্রের মতো ‘অমাবস্যার গান’।

মাস্তানরাজের গ্র্যান্ড দিওয়ালি উদ্‌যাপন। তার পাশেই পাড়ার ছোট্ট কালীপুজো। জনারণ্যের মধ্যে বিরাট শব্দবাক্সের হাড়হিম করা দাদাগিরি। তার কোণ থেকেই ক্ষীণভাবে ভেসে আসে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর মায়াস্বর-

জানো না রে মন পরম কারণ, কালী কেবল মেয়ে নয়,
ও যে মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ কখন কখন পুরুষ হয়...

আর এক মুহূর্তে বুটিদার শাড়ি, রংমিলান্তি পাঞ্জাবির ভিড় পিছিয়ে যায় তিনশো বছর আগের দুপুরে। ছায়াসুনিবিড় বটের নিচে জড়ো হওয়া প্রবীণের দল, নবীনার জোট। ভক্তির পড়া পাঠ নেই তাঁদের, অকুণ্ঠ বিস্ময় আছে, প্রেম আছে, প্রণতি আছে। সেই সমূহেরই একজন, অল্প বয়সে ঘরছাড়া, কিঞ্চিৎ খ্যাপাটে, সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। মন্ত্র, নিয়ম, আচার, অনুষ্ঠান জানা নেই, আছে অনাবিল আদর আর অকপট নিবেদন।

তবে কমলাকান্তের কালীগান কি শাস্ত্র-মন্ত্র-পুরাণ-তন্ত্র বাদ দিয়েই তৈরি? একেবারেই নয়। কবিত্বের দ্যুতি আর তন্ত্রপাণ্ডিত্যের অলংকার তাতে যথেষ্টই আছে।

অচিন্ত্য অব্যয় রূপা, গুণাতীতা নারায়ণী।
ত্রিগুণা ত্রিপুরা তারা, ভয়ঙ্করা কাল কামিনী।।
সাধকের বাঞ্ছাপূর্ণ, কর নানা রূপধারিণী।
কভু কমলের কমলে নাচ, পূর্ণব্রহ্ম সনাতনী।।

আরও পড়ুন: ডালে দোল খাওয়া বালিকাই আসলে কালী! কিংবদন্তি কথা বলে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের মন্দিরে

আছে সাধনতত্ত্বের গূঢ় কাব্যিক সংকেতও। এই সাধনা ত্যাগের। সাধককে বিষয়মধু ত্যাগ করতে হবে। এই আরাধ্যা ত্যাগ, বৈরাগ্য, প্রশমনের অধিষ্ঠাত্রী। শুধু বিষয়-সংসার নয়, নিজের দেহও তো বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাধনায়। রিপুকে তো আর মুছে ফেলা যায় না। অথচ তন্ত্রের সাধনায় দেহই তো সার! এই আক্ষেপ কীভাবে পেরনো যায়? পথ কী? কমলাকান্ত বলেন-

বড় আশা ছিল মনে, ফল পাব মা এই তরুতে
তরু মুঞ্জরে না, শুকায় শাখা, ছটা আগুন বিগুণ আছে।
কমলাকান্তের কাছে ইহার একটি উপায় আছে।
জন্ম-জরা-মৃত্যুহরা তারা নামে ছেঁচলে বাঁচে।

তত্ত্বের শূন্য খোলস নয়, ভাবের জিজ্ঞাসা প্রবল বলেই কখনও নিবেদিত ভক্তির মধ্যেই উচ্চারিত হয়ে যায় অমীমাংসিত ধাঁধা- “যখন ব্রহ্মাণ্ড না ছিল হে মা, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি!”

নিতান্তই কম বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলেন কমলাকান্ত। বিবাহিত হলেও দাম্পত্যধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল না তাঁর। শাক্তসাধনায় আরাধ্যার ভজনা তাই করলেন কন্যারূপে, জননীরূপে। আর রামপ্রসাদের মতোই সরল অভিমানে মায়ের কাছে, মেয়ের কাছে দাবি ও অভিযোগের স্রোত বইয়ে দিলেন-

কুপুত্র অনেক হয়
কুমাতা কখন নয়,
বঞ্চনা উচিত হয় কি অধীন জনে মা!

কিংবা,

জগত জুড়ে নাম দিয়াছ কমলাকান্ত কালীর বেটা
এখন মায়ে পোয়ে কেমন ব্যাভার, ইহার মর্ম্ম জানবে কেটা!

সন্ন্যাস তাঁর ধর্ম; নারীর প্রতি আসক্তি নেই, কিন্তু দেখার চোখ আছে। একই সঙ্গে তিনি তাপস ও প্রেমিক। যে নারীকে তিনি উপাসনার লক্ষ্য করে তুললেন, তার অপার্থিব নিত্য অন্ধকার সৃষ্টির আদিরূপ- অতল, অমূর্ত, দুর্জ্ঞেয়। সে রূপের প্রশস্তি না করেন, সাধ্য কী!

ও রমণী কালো এমন রূপসী কেমনে

বিধি নিরমিল নব নীরদ বরণে।
বামা অট্ট অট্ট হাসে, দশনে দামিনী খসে, কত সুধা ক্ষরে বামার ও বিধুবদনে।

যে দুনিয়া নারীর দাম খোঁজে, যোগ্যতা মাপে গায়ের রঙে, একুশ শতকে যে দুনিয়ায় ত্বক-প্রসাধনীর সঙ্গে রং মাপতে শেড-কার্ড দেওয়া হয়, সেই ভূখণ্ডেরই এক প্রাচীন সদস্য এমন এক রূপের উত্তুঙ্গ উদ্‌যাপন দেখালেন। এই মেয়ে শুধু কালোই না, এ উলঙ্গী, উন্মাদিনী, ‘দিগম্বরী ভয়ঙ্করী’; অলজ্জিতা হয়ে সে এক মরণলড়াইয়ে নেমেছে, সর্বনাশেই তার সিদ্ধি। অসীম ভয়ের এক আশ্চর্য মোহিনী মূর্তি! সে সম্পূর্ণা, আপনাতে আপনি পূর্ণ, নিজে গেয়ে, নিজেই করতালি দিয়ে নেচে বেড়ায়।

এলো থেলো চাচর চুল, তায় দিয়েছে জবাফুল
নাশিছে দানবকুল, সুধায় দুকুল ভাসে রে।...
কমল কহে, কাজলবরণ, অভয়পদে যে লয় শরণ,
কালীনামে কাঁপে শমন, ত্রাসে না যায় পাশে রে...

সাধকের চোখ যাঁকে দেখছে, তিনি একই সঙ্গে গুণময়ী ও মনোময়ী, জ্ঞানময়ী ও প্রেমময়ী, সুখময়ী ও দয়াময়ী, ভয়াল ও অভয়া, কালী ও গৌরী। কমলাকান্তের আগমনী-বিজয়ার পদ বাংলার সংস্কৃতিঘরের মায়াময় অফুরান আলো। আদরের কিশোরী কন্যাকে দেখা আর না-দেখার যুগল কান্না, মা-বাপের স্নেহক্ষরা সুখদুখ তিনি যেমন প্রেমে, শব্দে বুনেছেন, তারই আরেক পিঠ তাঁর শ্যামাগীতি। উমা আর শ্যামায় ভেদ কোথায়? গিরিরাজ যখন মেনকাকে বলেন “ও রাঙা চরণ দুটি, হৃদে রাখেন ধূর্জটি, তিলার্ধ বিচ্ছেদ নাহি করে”, তখন শায়িত মহেশের বুকে দাঁড়ানো সেই দেমাকি মুণ্ডমালিনীকেই তো দেখতে পাই।

অভেদ আরও এক জায়গায়। রামপ্রসাদ লিখেছিলেন, “প্রসাদ বলে, গণ্ডগোলে এ যে কপট উপাসনা/ তুমি শ্যাম-শ্যামাকে প্রভেদ করো, চক্ষু থাকতে হলে কানা।” কমলাকান্তও ভাবলেন সেই শ্যামাঙ্গীর কথা, যে একদিকে এলোকেশীরূপে অসুরনিধন করে, আরেকদিকে ব্রজপুরে বাঁশি বাজিয়ে মনহরণ করে ব্রজাঙ্গনার। পুরুষবেশে? না কি নারীই?

এক অন্ধকার কালের কবি কমলাকান্ত। তাঁর গানও তাই ভারতচন্দ্রের মতো ‘অমাবস্যার গান’। তাই যেসব টোড়ি, পরজ, ঝিঁঝিট, সিন্ধু, জলদের সুরে গান বাঁধলেন কমলাকান্ত, তার গায়ে লেগে আছে সেই অন্ধকারের রং। কিন্তু অন্ধকারের রং কি কেবল কালোই? অন্ধকারের ভেতর আলোর বাস, সাদার বুকে কালোর বসতি। তাঁর সুরে বিভাস আর পূরবী, যোগিয়া আর ইমন হাত ধরে থাকে। কালো-ধলো মিলে যায়। আমাদের নির্ঘুম আহত রাজপথ জেগে থাকে সেই রং ছোঁবে বলে। এই শূন্য দীপান্বিতায় সেই রঙের রেশ থেকে যায়, চিরকালের রামপ্রসাদী রাতের মতোই যা আনত।

More Articles