রহস্যময়তাই রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার ভিত্তি
Ramprasad Sen: আধুনিক মানুষের কাছে কালীপুজোর দিনে শ্যামাসংগীত হিসেবে শুধু নয়, আমাদের দুঃখদিনের রক্তজবা হয়ে প্রতিদিনই কি বাজে না রামপ্রসাদের গান?
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকে সবাই চেনে। পরিবার কিংবা স্কুল— কোনও প্রতিষ্ঠানের অনুশাসনেই যাকে বেঁধে ফেলা যায়নি, সেই ছেলেও তার সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে আঁধার রাতের একলা পথে রামপ্রসাদী সুরকে সহায় করেছে। এই সামান্য বয়সে জীবনকে যে সবেমাত্র দেখতে শিখছে, তার কাছে কী জাদু ছিল এই গানে? নিয়মতন্ত্র আর প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসন থেকে মুক্তির আহ্লাদ? না কি তারও অধিক কিছু? ওই বয়সে খানিক বন্ধু-পরিজনহীন নিঃসঙ্গতার কাছে কি পৌঁছেছিল এমন কোনও বারতা, যেখানে সে গানের ভেতর খুঁজে নিতে পারে ‘আমি’-রই কোনও ‘তুমি’? ভগবৎ-লীলার অপার রহস্যে সেই ‘তুমি’-কে ঘিরে ‘ভক্তের আকুতি’-ই তো তখন ভক্তের নিরাময়, সুশ্রুষা। বিষাদ আর আনন্দের এমন বিচিত্র সম্মিলনই সঙ্গলিপ্সা আর নিঃসঙ্গতার মধ্যে ভগবান এবং ভক্ত, কিংবা অন্যার্থে ‘তুমি’ বা ‘আমি’-কে অস্তিত্বময় করে রাখে। তাই তো ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।’
যদি বলি, ভক্তিমার্গের এই কথাই রামপ্রসাদী সুরে খুঁজে পেয়েছিল ইন্দ্রনাথ, এবং এইটেই রামপ্রসাদের আধুনিকতা? আধুনিক মানুষের কাছে কালীপুজোর দিনে শ্যামাসংগীত হিসেবে শুধু নয়, আমাদের দুঃখদিনের রক্তজবা হয়ে প্রতিদিনই কি বাজে না রামপ্রসাদের গান?
রামপ্রসাদ শাক্ত কবি ও সাধক। ঈশ্বর গুপ্ত থেকে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত- তাঁর জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে যাঁরাই আলোচনা করেছেন সবাই এ-বিষয়ে সহমত। তাঁকে ঘিরে যেসব কিংবদন্তি-কাহিনি ছাপার অক্ষরে কিংবা লোকমুখে চালু আছে, সেগুলো ঠিক একরকমের রামপ্রসাদকে হাজির করে না। এক তরফে তিনি বীর সাধক। বীরতন্ত্র-মতে কলিতে বীর-ভাবনার সাধনা প্রত্যক্ষ ফলদায়ক। ‘মহানির্ব্বাণতন্ত্র’-র চতুর্থ উল্লাসের ১৯ নং শ্লোকে অন্তত সেরকমই উল্লেখ আছে। এইসব সাধনা কৃষ্ণপক্ষে প্রশস্ত। সেরকমই কোনও এক কৃষ্ণাচতুর্দশীর মঙ্গলবার রাতে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধক রামপ্রসাদের সাধনার আখ্যান প্রচলিত। এই আখ্যানের অনুসারী পদ হিসেবে ‘জগদম্বার কোটাল/বড় ঘোর নিশায় বেরুলো’ পদটির কথা অনেকেই উল্লেখ করেছেন। শেষমেশ সমস্ত মোহান্ধকার দূর করে সাধকের সিদ্ধি মানে ‘Divine wisdom’ লাভ। ‘আগম নিগমতীতা/খিলমাতাখিল-পিতা/প্রকৃতি পুরুষরূপিণী।’ ‘শ্রীশ্রীকালী কুল-কুণ্ডলিনী’-র লেখক ভুলুয়া বাবার লেখায় আবার সাধনার সঙ্গে বলিদানের কাহিনিও আছে।
আরও পড়ুন: অনুবাদের আকাল, কালজয়ী বাংলা সাহিত্য পৌঁছতেই পারল না নোবেলের ধরাছোঁয়ায়
এসব ইতিহাস-কল্পইতিহাসের মিশেলে রামপ্রসাদ শুধুই কালীসাধক, তান্ত্রিক। রহস্যে ঘেরা তাঁর জীবন। উপরি আছে তাঁর তন্ত্রজ্ঞানী, ষট্চক্রভেদের পদ—
কালিকুণ্ডলিনী ব্রহ্মময়ী তারা তুমি আছো গো অন্তরে, মা আছো গো অন্তরে।
এক স্থান মূলাধার, আর স্থান সহস্রার।
আর স্থান চিন্তামণি পুরে।
অ্যাকাডেমিয়ার তত্ত্বজ্ঞানী যে ব্যাখ্যাই করুন না কেন, তন্ত্রসাধনার বিচিত্র মার্গভেদে এসব কথার নিহিতার্থ জনপরিসরে রহস্যকাহিনি ছাড়া আর কিছুই কমিউনিকেট করে না। বাঙালি কালীকে ‘মা কালী’ ছাড়া উচ্চারণ করতে না পারলেও আদত যা ভাবে, সেইটে ওই ‘কৃষ্ণা চতুর্দশীর’ রাতে ‘শশ্মান-মশানে’-র ‘করালবদনা’-ই। মায়ের এই ‘ভয়ংকর’ রূপকল্প যে ‘বরাভয়দাত্রী’ হয়ে ওঠে আমাদের সমষ্টিগত অবচেতনে,— সেই রহস্যই রামপ্রসাদের জনপ্রিয়তার ভিত্তি।
সেই কালী আর রামপ্রসাদ দু’জনে ঠিক কীরকম? ভক্ত হিসেবে একজন ‘বিনা মাইনের চাকর কেবল চরণ ধূলার অধিকারী’। আর ভগবান? তিনি ভক্তের কষ্ট সইতে না পেরে বাড়ির সামনের বেড়া বাঁধার সময় কঠিন পরিশ্রমের কাজকে অনায়াসসাধ্য করে দেন। স্নেহের ভিখারি ভক্তর নিবেদন আর ভগবানের প্রকাণ্ড প্রশ্রয়ে গৃহী থেকে সন্ন্যাসী- সকলেই বেশ নিরাপদ বোধ করেন। এই নিরাপত্তাই কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি রামপ্রসাদের পদে? বিশেষত, নবাবি আমল থেকে কোম্পানির আমলের সূচনাপর্বে বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনে যে বিপুল বিপর্যয়ের বোঝা, তা ন্যূনতম বেঁচেবর্তে থাকাকেই বিপন্ন করে তুলেছিল। ভারতচন্দ্র যেমন অন্নপূর্ণার কাছে সন্তানের দুধে-ভাতে থাকার আশ্বাসটুকু শুনতে চেয়েছিলেন, রামপ্রসাদ সম্ভবত বুঝেছিলেন, এইটুকুতে পেট ভরবে বটে, তবে সর্বগ্রাসী যে ‘ভয়’- তার থেকে মানুষ কোনও বিশ্বাসে ফিরতে পারবে না। দুর্ভিক্ষ, বাইরের শত্রুর অভিযান, নিজের প্রজার ওপর শাসকের অমানুষিক অত্যাচার ইত্যাদি বহুবিধ আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত বাঙালির আস্থা ফেরানোর জন্য ‘ভক্তি’-ই কি আশ্রয় হয়ে ওঠে রামপ্রসাদী গানে? দুঃখ-লাঞ্ছিত, অভাবপীড়িত, অত্যাচারিত মানুষেরই কথা হয়ে ওঠে ‘মন করোনা সুখের আশা/যদি অভয় পদে লবে বাসা।' অন্যথা, ‘ডুব দে মন কালী বলে/হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।’
যদি বলি এসবই চিরকালের কথা? এই ধরুন আমাদের প্রাত্যহিকতার ক্লান্তি, দুঃখ থেকে দু'-দণ্ড শান্তির জন্য আমাদেরও কি ‘অগাধ জলে’ ‘ডুব’ দিতে কি সাধ হয় না? ‘আধুনিক’ মানুষের যন্ত্রণা উপশমের জন্য যাবতীয় জাগতিকতাকে অস্বীকার করে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও কি তার ইঙ্গিত দেয় না? প্রবল যুক্তিবাদী মানুষও কি সজ্ঞানে অন্তত বৌদ্ধিক ‘প্লেজারের’ জন্য ভাবের ঘরে আরাম নেন না? আমাদের গড়পড়তা জীবনে প্রাত্যহিকতার সংগ্রাম এবং এই পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার নিত্য টানাপোড়েনে ধ্বস্ত এবং ক্লান্ত মানুষ যে ‘ঈশ্বর’ খোঁজেন বা যাঁকে পরম নিয়ন্তা ভেবে সমর্পণ করে কিছুটা স্বস্তি বোধ করেন, তিনি ‘মনোময়ী প্রতিমা’। রামপ্রসাদের ‘জগৎপালিনী মাতা’ শুধু শক্তি উপাসনার দেবী নন, তাঁর অধিষ্ঠান—
মা আমার অন্তরে আছ, কে তোমায় বলে অন্তরে শ্যামা
মা আবার অন্তরে আছ; তুমি পাষাণ মেয়ে বিষম মায়া…প্রসাদ বলে আমার হৃদয়, অমল কমল সাঁচ।
তুমি সাঁচে নির্ম্মাতা হবে, মনোময়ী হোয়ে নাচ।
এই জোরেই ব্রাহ্ম দয়ালচন্দ্র ঘোষও রামপ্রসাদে মজেছিলেন। ১২৮২ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘প্রসাদ প্রসঙ্গ’ নিঃসন্দেহে ঈশ্বর গুপ্ত-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এই রচনা করে রাজনারায়ণ বসুর মনে হয়েছিল ‘কবিরঞ্জন’-এর পরিবর্তে রামপ্রসাদের উপাধি ‘সাধুরঞ্জন’-ই শ্রেয় ছিল।
সাধু ও কবির অভেদ কল্পনার মধ্যেই রামপ্রসাদের কবিত্বের মহিমা লুকিয়ে আছে। কালী-সাধক হয়েও তিনি বিশ্বকবি। কারণ ‘তাঁহার কাব্যে ও সাধনায় যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া তিনি প্রকাশ পাইয়াছেন’ এবং বাঙালির বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে ‘ইংরেজ আগমনের পূর্ব্বে’ তিনি তা করেছেন, এমনটাই অভিমত ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। শাক্ত পদকর্তার সীমাবদ্ধ পরিচয়ে আপত্তি ছিল ঈশ্বর গুপ্তরও। তাঁর মতে,
নিরাকারবাদিরা “ব্রহ্ম” শব্দ উল্লেখ পূর্ব্বক যাঁহার উপাসনা করেন ইনি “কালী” নাম উচ্চারণ করত তাঁহারি আরাধনা ও উপাসনা করিতেন, ইঁহাতে পুরুষ আর প্রকৃতি অথবা পরমেশ্বর বা পরমেশ্বরী, এই নামান্তর জন্য ভাব, রস, ভক্তি, প্রেম এবং জ্ঞানগত বৈলক্ষণ্য কিছুই হইতে পারে না, কারণ উভয় পক্ষেরি উদ্দেশ্য এক এবং যথার্থ পক্ষে উভয়েরী মর্ম্ম ও অভিপ্রায় এক হইতেছে।
রামপ্রসাদী কালীকীর্তনে ভাগবতীর গোষ্ঠে গমন ও গোপবধূ বেশে গোচারণের পদগুলো শাক্ত-বৈষ্ণব ভেদে পড়ার কি কোনও উপায় আছে? আজু গোঁসাইয়ের সঙ্গে তর্কে তাঁর উত্তর-প্রত্যুত্তরে প্রচলিত পদগুলি কি শুধুই বিরোধমূলক, না সংযোগ-সহাবস্থানের কোনও বিকল্প বয়ানের ইঙ্গিতবহ? ('চৈতন্যভাগবত'-এ কুমারহট্ট গ্রামে ঈশ্বর পুরীর জন্মস্থান ও চৈতন্য-স্মৃতিবিজড়িত কাহিনির উল্লেখ দেখে সে-বিষয়ে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা রামপ্রসাদ সেনের কোনও যোগসূত্রের সম্ভাবনাটিকেও একেবারে নাকচ করা যায় না।) অনেক পরে 'প্রবাসী'-র সমালোচক রামানন্দ মনে করিয়ে দিয়েছেন, রামপ্রসাদের ভক্তিতত্ত্ব বাংলাদেশে সাধনার এবং কবিতারও নতুন ধারা তৈরি করেছে। ভক্তি-কবিতা হিসেবে রামপ্রসাদকে পড়ার যে প্রস্তাব আমাদের ইতিহাসচর্চায় আছে, তা কি শুধুই প্রতিষ্ঠানের বিদ্যাচর্চার বর্গীকরণে বাধাপ্রাপ্ত হলো, না কি এর মধ্যে রয়ে গেছে আমাদের ভিন্ন কোনও অভিসন্ধি?