পুরস্কারের বোঝা থেকে ছুটি চাইতেন রবীন্দ্রনাথ
Rabindranath Tagore: কুকুরের লেজে বাঁধা টিনের ক্যানেস্তারার মতো অস্বস্তিকর এই পুরস্কার, এই খ্যাতি, এই অভিবাদন-স্রোত!
রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এই খবর কলকাতায় এসে পৌঁছয় ১৯১৩-র ১৪ নভেম্বর। তারপরই, স্বাভাবিকভাবেই, রবীন্দ্রনাথকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠি ও টেলিগ্রামের এক বিপুল প্রবাহ আছড়ে পড়তে থাকে শান্তিনিকেতনের দিকে। সাধারণভাবে প্রাপ্ত চিঠির উত্তর নিজের হাতে লিখে দেওয়া ছিল কবির চিরকালের অভ্যাস। এবার তার একটা বিকল্প ভাবতেই হয় তাঁকে। “আমার সম্মানলাভে যাঁহারা আনন্দ প্রকাশ করিয়াছেন তাঁহাদের প্রতি আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি। ইতি ১লা অগ্রহায়ণ ১৩২০”– এই সাধারণ-বয়ানটি সাইক্লোস্টাইল করে পাঠানো হতে থাকে প্রত্যুত্তর হিসেবে। একই সঙ্গে শান্তিনিকেতনে ও অন্যত্র নানা সংবর্ধনা-মঞ্চেও তাঁর ডাক পড়তে থাকে। সেই ইতিহাস বিস্তারিতভাবে নানা জায়গায় লেখা আছে।
সংবর্ধনা-মঞ্চের ভাষণ বা ছাপানো বয়ান নির্বিশেষ-সাধারণের উদ্দেশে বিবৃত করা বলেই তার মধ্যে রয়ে যায় কিছু-বা সাজানো-কথা, যা অনেক সময়েই প্রথাবদ্ধ ও বহুব্যবহৃত। কিন্তু এরই ফাঁকে-ফাঁকে কিছু বিশেষ-জনকে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে-লিখে যেসব উত্তর দিচ্ছিলেন, তারই মধ্যে বোধকরি তাঁর এইসময়কার মনের ভাবটা ঠিকঠাক ধরা পড়ছিল। যেমন, ১৬ নভেম্বর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখেছিলেন, ‘সম্মানের ভূতে আমাকে পাইয়াছে, আমি মনে মনে ওঝা ডাকিতেছি...।' এই চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ অব্যর্থভাবে উল্লেখ করেন প্রায় বছরদেড়েক আগে (৩১ মার্চ, ১৯১২) লেখা একটা গানের 'কোলাহল তো বারণ হল এবার কথা কানে কানে’। যখন রাজার পথে লোক ছুটেছে আর বেচাকেনার হাঁক উঠেছে, তখন কে-যেন বারে বারে বিনা কাজের ডাক দিয়ে যায় কবিকে।
আরও পড়ুন: যৌন শোষণই নিয়তি! বাংলা সাহিত্যের নারীমন তবু চেনা ছকের বাইরে
কিন্তু কোলাহল যে সহজে বারণ হওয়া শক্ত, সেকথা বিলক্ষণ জানতেন রবীন্দ্রনাথ। রোটেনস্টাইনকে ১৮ নভেম্বর লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন যে, চারপাশের পরিস্থিতি খুবই ‘frightful’, আর তার সঙ্গে এক অস্বস্তিকর উপমান জেগে উঠেছিল চিঠির ভেতরে, ‘It is almost as bad as tying a tin can at a dog’s tail making it impossible for him to move without creating noise and collecting crowds all along.’
কুকুরের লেজে বাঁধা টিনের ক্যানেস্তারার মতো অস্বস্তিকর এই পুরস্কার, এই খ্যাতি, এই অভিবাদন-স্রোত! সেইজন্যই নভেম্বরের ‘উৎপাত’ মিটিয়ে ডিসেম্বরের গোড়ায় তাঁকে চলে যেতে হয় শিলাইদহ। অবশ্য কাজের চাপে সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে ফিরেও আসতে হয়। কিন্তু আবার কাজ সেরে ফের জানুয়ারির গোড়ায় তিনি শিলাইদহে কার্যত আত্মগোপন করেন।
আসলে তো ভিড় থেকে নিজের দিকে ফেরার ইচ্ছে। সেই ইচ্ছের কথাতেই ভরে থাকে এই সময়ের অনেকগুলি কবিতা ও গান। কখনও স্বীকারোক্তির মতো জেগে থাকে এই লাইন যে, “ঘরে আমার রাখতে যে হয়/ বহুলোকের মন/ অনেক বাঁশি অনেক কাঁসি/ অনেক আয়োজন।’’ কখনও এই অনিচ্ছা-ভরা আয়োজনের বুক চিরে যেন জেগে ওঠে এই আর্তরব, “সুখ যারে কয় সকল জনে/ বাজাই তারে ক্ষণে ক্ষণে,/ গভীর সুরে ‘চাই নে, চাই নে’/ বাজে অবিশ্রাম।”
কবি, তিনি ছুটি চান। কিন্তু একে কাজের থেকে ছুটি-চাওয়া ভাবলে ভুল হবে। এ কেবল ওই বিপুল সম্মানের বিরামহীন বোঝার থেকে ছুটি চাওয়া। অনেকদিন আগে, ১৯০৬ সালে, বন্ধুবর জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে কবি অভিমানভরে লিখেছিলেন, ‘আপনারাও যদি আমাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন তাহলে আমার কি উপায় হবে।’ সম্মান ও শ্রদ্ধা লাভ করে ‘হয়রান্’ হয়ে গেছেন তিনি, ১৯০৬-এ এই ছিল তাঁর আন্তরিক অস্বস্তি। সেই অস্বস্তি যে এখন, এই ১৯১৩-তে, কার্যত যন্ত্রণার রূপ নেবে তা এইবার বোঝা যায়। কিন্তু ভিড় থেকে পালানো আর মানুষ থেকে পালানো তো ঠিক এক জিনিস নয়। সেই আশ্চর্য কিন্তু জরুরি কথাটা রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন এক ভিড়ে-ঠাসা সভাতেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে আসতে পারেননি দীর্ঘকাল। ১৯২০ সালের জুন মাসে অবশেষে তিনি পৌঁছলেন ইংলন্ডে। সেখানে এক সভায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় ইউরোপীয় গুণীজনের সামনে এই সম্মানলাভের এক আন্তরিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন: ‘সম্মান, সে তো সমাধিস্তম্ভের মত, তা মৃতের জন্য।’ কিন্তু এত সব আয়োজনের ভেতর জীবিতের জন্য কি কিছু পড়ে নেই? কবি বললেন, 'আছে। প্রীতি। সতিকারের প্রীতি যদি থাকে কোথাও, সেইটুকুই প্রাপ্তি। প্রীতিসমুজ্জ্বল সূর্যালোক, তা জীবিতের জন্য।’ যেখানে হৃদয়ের স্পর্শ আছে সেখানেই ছুটি। যা-কিছু কেবলই আনুষ্ঠানিক, তা বেঁধে ফেলতে চায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে, সেই সোনার শিকল চলতে-ফিরতে পায়ে বাজে।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পিছনে ছিল সাহিত্যের বিবেচনা। আমরা জানি, একটা রাজ-পুরস্কারও পেয়েছিলেন কবি। নাইটহুড। সে পুরস্কার ইতিহাসের এই রক্তাক্ত সন্ধিক্ষণে তিনি ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। তিনি যে নিজে একজন ‘জমিদার’, এই নিয়ে প্রায় সারাজীবন রবীন্দ্রনাথের মনে একটা চোরা অস্বস্তি ছিল। প্রমথ চৌধুরীর লেখা ‘রায়তের কথা’ বইয়ের ‘ভূমিকা’-য় সেই অস্বস্তি তীব্র আত্মধিক্কারে ব্যক্ত হয়েছিল একবার, ‘প্রজারা আমাদের অন্ন জোগায়, আর আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়– এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই।’ একইরকমভাবে রাজার-উপাধি গ্রহণও হয়তো-বা রবীন্দ্রনাথের এক স্থায়ী অস্বস্তির কারণ ছিল। ১৯৩২ সালে হেমন্তবালা দেবীকে লেখা এক আশ্চর্য চিঠিতে তিনি কার্যত অস্বীকার করেছিলেন তাঁর যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মপরিচয়কে। লিখেছিলেন, ‘আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে গণ্যই করি নে।’ আর এই কথারই সূত্র-ধরে ফিরে এল রাজার-দত্ত উপাধিটিরও কথা, চিঠি শেষ হলো এই ঘোষণা দিয়ে যে, ‘আমি নিজেই যূথভ্রষ্ট... রাজার দত্ত উপাধি আমি ত্যাগ করেছি সম্প্রদায়ের দত্ত উপাধিও আমার নেই।’
উপাধি জিনিসটাই আসলে বেশ গোলমেলে। যূথভ্রষ্টতাই কবিকে মানায় বেশি। তাই না?