প্রথম শোনা গেল ১৯৬২-র রেকর্ডিং, যেভাবে বারবার বদলেছে 'মহিষাসুরমর্দিনী'
Mahisashuramardini: ১৯৬২-তে আকাশবাণী-তে মহিষাসুরমর্দিনীর কোনও রেকর্ডিং হয়েছিল বলে এ-যাবৎ আমাদের জানা ছিল না। আজকের সম্প্রচারিত রেকর্ডিংটি সেই দিক থেকে এই অনুষ্ঠানের প্রথম ধ্বনিমুদ্রণ।
'মহিষাসুরমর্দ্দিনী' (বর্তমানে অবশ্য মহিষাসুরমর্দিনী) বাংলা ১৩৩৯ সালের (১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ) আশ্বিন মাসে দুর্গাষষ্ঠীর ভোরে প্রথম প্রচারিত হয় কলকাতা বেতার থেকে। আক্ষরিক অর্থে এই অনুষ্ঠান তৈরি হয়ে উঠতে পেরেছিল তিনজন মানুষের মেধা, ভালবাসা, উদ্যম আর দূরদৃষ্টিকে হাতিয়ার করে। কীভাবে তৈরি হয়ে উঠেছিল এমন একটি জনচিত্তহারী অনুষ্ঠান? মহিষাসুরমর্দিনী-র পশ্চাৎপট একটু দেখে নেওয়া যাক এই সুযোগে।
গত শতাব্দী আমাদের সভ্যতাকে যে-সমস্ত উপহার দিয়েছে, তার মধ্যে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য অন্যতম দু'টি গুরুত্বপূর্ণ উপহার হলো ধ্বনিমুদ্রণের প্রযুক্তির আবিষ্কার (গ্রামোফোন রেকর্ডের আবিষ্কার) এবং ইথার তরঙ্গের মাধ্যমে শব্দকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া (বেতার যন্ত্রের আবিষ্কার)। গ্রামোফোন রেকর্ড ভারতের শ্রোতার কাছে পৌঁছতে শুরু করে ১৯০০ সালের আশপাশে। আর ১৯২৭ সালের ২৬ অগাস্ট কলকাতায় ভারতের প্রথম নিয়মিত বেতারকেন্দ্র গড়ে ওঠে (অবশ্য কলকাতায় প্রথম সফলভাবে বেতার সম্প্রচার প্রদর্শন করেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে)। শুরুতে নাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’— ১৯৩০-এ সে নাম বদলে হয় ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’, ১৯৩৬-এ ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’। এই দুই মাধ্যমের হাত ধরে সংস্কৃতির এক রকমের গণতন্ত্রীকরণ ঘটল— মধ্যবিত্তর হাতের নাগালে চলে এল মনোরঞ্জন এবং বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের বিরাট সুযোগ।
বেতার পরিষেবা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একগুচ্ছ উৎসাহী তরুণ কলকাতা বেতারে এসে জড়ো হন। বেতারকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য সেই তরুণদের উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় শুরুর সেই দিনগুলোতে বেতারের বিস্তার ঘটে। নানা রকমের নতুন নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সেদিনের সেই তরুণদের সৃষ্টিশীলতাকে পল্লবিত করেছিল। সে-সময়ে বেতারে জড়ো হয়েছিলেন বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য), প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নলিনীকান্ত সরকার, রাইচাঁদ বড়াল, যোগেশ বসু (গল্পদাদা), নৃপেন্দ্র মজুমদার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, রাজেন সেন, সাগিরুদ্দিন খাঁর মতো আরও অনেকে। এরই পাশাপাশি ১৯২৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতা বেতারের মুখপত্র 'বেতার জগৎ' প্রকাশিত হতে শুরু করে (যদিও কেউ কেউ ১২ সেপ্টেম্বরকেই বেতার জগৎ-এর প্রথম প্রকাশের দিন বলে ধরেন)।
আকাশবাণী না থাকলে মহিষাসুরমর্দিনী-র জন্ম হতো না সম্ভবত। এই প্রসঙ্গে এই অনুষ্ঠানের জনয়িতা বাণীকুমারের লেখা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিলে মন্দ হবে না—
এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র উৎপত্তি ও প্রচার কলিকাতা বেতার-প্রতিষ্ঠান আকাশবাণীতে। এই সর্বজন-নন্দিত অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলিকাতা বেতারের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য।
বাণীকুমার লিখছেন—
সে-সময়ে (ইণ্ডিয়ান্ স্টেট্ ব্রড্কাস্টিং সার্ভিস্) নামে খ্যাত কলিকাতা বেতার-প্রতিষ্ঠানের জেগে উঠেছে জনচিত্তের ’পরে আকর্ষণী-শক্তি সবিশেষ বিস্তার করবার অদম্য উৎসাহ...এরি ফলে জন্ম নিল...‘বেতার-বিচিত্রা’। সেই সূত্রে শ্রীশ্রীমার্কণ্ডেয়-চণ্ডীর বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি ক’রে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটী চম্পূ রচনা করি, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ।...এই অনুষ্ঠানটিই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-পরিকল্পনার উৎস।
বসন্তেশ্বরী সম্প্রচারিত হয় ১৩৩৮-এর “চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে (বাসন্তী ও অন্নপূর্ণাপূজার অনুষ্ঠান-সন্ধিক্ষণে)”। ১৩৩৯-এ “সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’" (বা oratorio) নাট্যরচনাশৈলী অনুসরণে নবভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন” করেন বাণীকুমার। ১৩৩৯-এর আশ্বিন মাসে “দেবীপক্ষে শুভ ষষ্ঠীর প্রত্যূষে” কলকাতা বেতারে এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয় প্রথম বার। শুরুতে অবশ্য মহিষাসুরমর্দিনী নামে সে অনুষ্ঠান হয়নি। ১৯৩৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত 'বেতার জগৎ'-এর সূচনা পৃষ্ঠায় ঘোষণা করা হচ্ছে—
আগামী ১৯শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবারে মহালয়া। সে দিন সকাল ছ’টা থেকে সাতটা পর্য্যন্ত এক ঘণ্টা কাল প্রত্যূষ প্রোগ্রামের জন্য নির্দিষ্ট হ’য়েছে। এই এক ঘণ্টা কাল জগন্মাতার বন্দনা-গানে মুখরিত হ’য়ে উঠ্বে।
অর্থাৎ, ১৯৩৩-এও মহিষাসুরমর্দিনী নামটি এই বীথী রচনার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়নি।
১৯৩৬-এর ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত 'বেতার জগৎ'-এ 'মহিষাসুর বধ' নামে অনুষ্ঠানটি তালিকাবদ্ধ হয়েছিল। সম্ভবত ১৯৩৭ সাল থেকে মহিষাসুরমর্দিনী নামেই অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হতে থাকে।
১৯৫৯ সালে (ভাদ্র, ১৩৬৬) মহিষাসুরমর্দিনীর একটি মুদ্রিত পাঠ আমাদের হাতে আসে অধুনালুপ্ত ত্রিগুণা প্রকাশনীর মাধ্যমে। সে সময় মহিষাসুরমর্দিনীর ত্রয়ী বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ জীবিত। কাজেই সেই পাঠটিই অদ্যাবধি প্রকাশিত একমাত্র অনুমোদিত (authorized) পাঠ হিসেবে ধরা যেতে পারে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত মহিষাসুরমর্দিনীর বাণীকুমার লিখিত 'উপক্রমণিকা'-য় রয়েছে—
বৎসরে বৎসরে না হোক—এই গ্রন্থকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করার আগ্রহে আমি বিবিধ বিষয়, স্তব-স্তুতি, দেবীসূক্ত, নব-রচিত গান-সন্নিবেশ করেছি। অন্তত ছয়-সাত বার এই রচনার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
১৯৫৯-এর পরেও কি এই পরিবর্তনের ধারা বজায় থাকেনি? এই উত্তর পাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রাস্তা হল আকাশবাণী থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানের রেকর্ডিংগুলোকে তুলনা করে দেখা। মহিষাসুরমর্দিনীর যে রূপটির সঙ্গে আমরা ১৯৭৩-২০১৭ পর্যন্ত পরিচিত ছিলাম সেটি ১৯৭৩ সালে রেকর্ড করা— গ্রামোফোন কোম্পানি সেই রেকর্ডের দীর্ঘবাদন সংস্করণ বাজারজাত করে ১৯৭৩ থেকেই। এর আগে ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি লাইভ সম্প্রচারিত হয়েছে আকাশবাণী থেকে— এমনটাই আমাদের জানা ছিল। ১৯৬৩ সালে এই অনুষ্ঠান রেকর্ড করে সম্প্রচার করা হয়। ১৯৬৪ এবং '৬৫-তে '৬৩-র রেকর্ডিংটিই চালানো হয়। ১৯৬৬-তে নতুন করে রেকর্ড করা হয় এই অনুষ্ঠান। ১৯৬৯ সালে আর-একবার রেকর্ড করা হয়। ১৯৭২-এ হয় আরও একটি রেকর্ডিং।
আপাতত এই কতগুলো রেকর্ডিং-এর কথাই আমাদের জানা ছিল। ১৯৬২-তে আকাশবাণী-তে মহিষাসুরমর্দিনীর কোনও রেকর্ডিং হয়েছিল বলে এ-যাবৎ আমাদের জানা ছিল না। আজকের সম্প্রচারিত রেকর্ডিংটি সেই দিক থেকে এই অনুষ্ঠানের প্রথম ধ্বনিমুদ্রণ। লাইভ সম্প্রচারে এই অনুষ্ঠানের কী ধরনের পরিবর্তন হয়ে চলেছিল তা আমাদের জানা সম্ভব নয়— অন্তত সে-সময়ের রেকর্ডিং আমাদের হাতে নেই, অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপিতে তা ধরা থাকলেও আমাদের হাতে সে নথি নেই। কিন্তু আকাশবাণীর মহাফেজ়খানা খুঁড়ে বের করে আনা এই রেকর্ডিংগুলো আমাদের সংস্কৃতিবিদ্যার চর্চায় মূল্যবান সংযোজন হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। আশা করব, আগামী বছরগুলোতেও এরকম প্রায় হারিয়ে যাওয়া বা না-জানা ধ্বনিমুদ্রণের আবিষ্কার আমাদের চমৎকৃত, আমোদিত করবে।