তিথি হিসেবে মহালয়ার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিল 'মহিষাসুরমর্দিনী'

Mahisashuramardini: হয়তো বা বিভ্রম জাগে, দুর্গাপুজোর অবশ্য-পালনীয় পুণ্য কাজকম্মর অন্যতম 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনা!

এ যেন এক আশ্চর্য দুর্ঘট? আসমুদ্রহিমাচলে তো বটেই, গোটা দুনিয়াতেও কি এ রকম উদাহরণ খুব বেশি মিলবে, যেখানে রেডিও-অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় ক্যালেন্ডারের সময়মাফিক নয়– বরং তিথি-নক্ষত্রর নিক্তি মেপে?

আকাশবাণীর সম্প্রচারিত 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠানটি নানা কারণেই ব্যতিক্রম! ঈষৎ কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ করলেই ভাবা যায়, রেডিও একটি আদ্যন্ত প্রযুক্তিসম্ভূত, আধুনিক প্রতিষ্ঠান। যে পাবলিক সে রচনা করে, তা-ও খাতায়-কলমে আপাদমস্তক সেকুলার। অন্তত, তেমনটাই হওয়ার কথা। অথচ, প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতায় যোজন ফাঁক থেকে যায়। উপমহাদেশের ধর্মসংকুল আবহে শ্রুতি-পরিসরের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে ভাবতে বসলে অতএব 'মহিষাসুরমর্দিনী'-কে এড়িয়ে কিছু ভাবাই যাবে না!

এখনও খাতায়-কলমে শতবর্ষীয়ান হয়ে ওঠেনি এই বেতার-নিবেদন। অথচ, এই ন'-দশকেই 'মহিষাসুরমর্দিনী' যেন হয়ে উঠেছে হিন্দু বাঙালির শারদ-অভ্যেসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, পুজোর আবশ্যিক এক উপাদান-বিশেষ। স্বাভাবিকতার এহেন অমেয় প্রকোপেই হয়তো বা বিভ্রম জাগে, দুর্গাপুজোর অবশ্য-পালনীয় পুণ্য কাজকম্মর অন্যতম 'মহিষাসুরমর্দিনী' শোনা! যার ইতিহাস নিতান্তই কয়েক দশকের, থেকে থেকে তাকে মনে হয় আবহমান, চিরন্তন৷ গত ন'-দশকে তাই মহিষাসুরমর্দিনী-প্রসঙ্গে গালগল্পর তালিকা বেড়ে গেছে ক্রমে– আদতে যা হতে পারত নিতান্তই সাধারণ একটি সংগীত-আলেখ্য, তাতে জুড়ে বসেছে দৈব অনুষঙ্গর ইশারা। কে বলতে পারে, তিথি হিসেবে মহালয়ার গুরুত্বও হয়তো-বা বেড়ে গেছে কিঞ্চিৎ!


বাঙালির রেডিও শোনার ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে অবসর সময়ের ইতিহাসের সঙ্গে। দিনমানে ক্ষমতার কলে পেষাই হতে হতে যে আধমরা– উদ্বৃত্ত, একান্ত সময়ে সে-ই উড়াল দিত রেডিও নামক এক ব্যক্তিগত জাদুডানায় ভর করে! এই উদ্বৃত্ত সময়কে সে কাজে লাগায় সংস্কৃতির আখর কুড়োতে– যেখানে সে স্বরাট, স্বতন্ত্র। সেই সংস্কৃতিতেই বাঙালি মধ্যবিত্তর অমোঘ জন্মদাগ। বেতার-মাধ্যম স্বাধীনতার অব্যবহিত আগের দশকগুলিতে সেই জরুরি দায়িত্ব সম্পাদন করেছিল।

তারপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে। হিন্দু বাঙালির অবস্থানও এক নেই আর। সে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু, তার অর্থনৈতিক কলজের জোর কমতির দিকে, রাজনীতিতেও ক্রমশ কমে এসেছে মধ্যবিত্তর লুকোনো প্রতাপ। এ এক পতনের গল্প: মা কী ছিলেন, আর, মা কী হয়েছেন– হালফিলে, অধুনায়।

ভাবা যেতেই পারে, এই সময় একাভিমুখী। তার তুঙ্গ সাফল্য থেকে একাদিক্রমে হেরে যাওয়ার ইঙ্গিত। এ এক সরলরৈখিক কালচেতনা– যেখানে সময়বিন্দুগুলি আর ফিরে আসে না কখনও– যা যায়, তা জন্মের মতো যায়।

এখানেই লুকোনো থাকে নস্টালজিয়া। হালকা, পালকের মতো। ঘরে ফেরার তীব্র আকুতি। আর্তি। উদ্বায়ী। এ-স্মৃতির ভার থাকে না কোনও।


শরৎ এলে স্মৃতিও আসে। এই সময় ঋতুসন্ধির। এই সময় কেবল নির্বিবাদ, নিরঙ্কুশ এগিয়ে-যাওয়া সময় নয়– ট্রানজিটে, হাওয়া ও আলোর থিয়েটারে এ এক নিত্যবৃত্ত সময়। চক্রবৎ, এবং পুনরাবৃত্তিময়।

প্রতি বছর, অতএব, শরৎ ফেরে৷ তাকে ফিরতে হয় বলে৷ ব্যোমকেশের গল্পে অজিতের মন কেমন করত শরৎ এলে৷ সে বেরিয়ে পড়বে৷ হাওয়া তাকে বাইরে থেকে ডাকছে। রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসবে বণিক ঘর ছাড়ে শরতে, সন্ন্যাসী বিবাগী হয়। যোদ্ধা চলে যায় যুদ্ধে। ফুল ঝরে যায়, নতুন ফুল জন্মায়। এ এক মহাজাগতিক সময়– ছায়াপথের নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে মাটির ওপর৷ দিন হয় ছোট, রাত আরও বড়। মেঘ ও আকাশের কোনও গোপন যোগাযোগে, এই মহাজগৎ বেজে ওঠে প্রতি বছর– তীব্র সংরাগে, আকুতিতে।


যে দিন ভেসে গেছে, তা কি একেবারেই গেছে? বছরভর যে মাকড়সাপ্রতিম ঊনমানুষ হয়ে ছিল, আশ্বিন কাজে এলে, অনেক হারানোর পরেও সে গ্রেগর সামসা হিসেবে বেজে ওঠে চরাচরে৷ পরম আলস্য নিয়ে আসে মহালয়ার সকাল, তার কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই৷ পড়ে-আসা আলো শুয়ে আছে উল্টো দিকের ছাদে, আর চামড়ার ভেতর একটা গোপন শিরশিরানি। আশ্বিন কি এসেই গেল তবে? আস্তে আস্তে ঋতুমালা গুটিয়ে এল, শহরের সর্বত্র একটা হাওয়া বুলোয় বিকেল হতে না হতেই, তার নাম দেওয়া যায়: ‘মেলানকলি’। এই হাওয়া উতল করে, তাড়িত করে। বর্ষার সমস্ত কালো ঝরিয়ে আকাশের গা আরও ফর্সা, মিহি হিম ছুঁয়ে যাচ্ছে উঠোন, টুপটাপ। দূর থেকে এক-আধটা গাড়ি চলে যায়, পিচরাস্তার সঙ্গে তাদের ধাতব সংঘর্ষের শব্দ সচকিত করে, জাগ্রত রাখে৷ বেকার যুবকটি কাককে খেতে ডাকলেন– আয়... আয়... দু’ বার চুমরে দিলেন বাটি, ওল্টানো ভাত, ছড়ানো শস্য খেতে উড়ে এল শহরের সমস্ত পাখিরা। তর্পণ। বেলা গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে, মেঘ বলছে এই তো আসি, অবসন্ন লাগে, বর্ষা চলে গেছে... বাদল ধারা হলো সারা, বাজে বিদায় সুর/ গানের পালা শেষ করে দে, যাবি অনেক দূর। আলো আশ্চর্য অগোছালো। সময়কে মনে হচ্ছে আরও শ্লথ। শিশিরের মতো এক-এক করে বিভাস রাগ থেকে ঝরে পড়ছে স্বরগুচ্ছ। তব অচিন্ত্য, রূপচরিত মহিমা৷ আশ্বিনের ওই পরাজাগতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বিপজ্জনক হাঁটতে হাঁটতে, সময়কে কেবলই মনে হয় সে পিছলে আসছে, আস্তে হাঁটছে? এই তো, একটু পরেই বেরোব। ঘড়িগুলো ছুটবে। আবার। একটা সময় আছে, যে কেবল ঘড়ির শাসনে চলে না। বদ্ধ, বিভাজিত সময়-ইউনিটগুলো যাকে চোখ রাঙাতে পারে না। সে একটা সময়– একটা আস্ত, ব্যক্তিগত সময়। 

যে দিন ভেসে গেছে...

১৯২৭। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখছেন, জাভা থেকে৷ অমিয় চক্রবর্তীকে। বলছেন, ট্যুরিস্টের সময় বড় দ্রুত চলে। নিত্য ধাক্কাধাক্কি, হট্টগোল। তাকে বশ মানানো যায় না৷ মনের ওপর অভিজ্ঞতার পাহাড় উজাড় হয়। ধরতে পারা যায় না কেবল৷ এই তো, লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, একটু পরে সুনীতি আসবে, আমায় ডাকবে৷ চলুন। বেরোই। চিঠি লেখার এই শিথিল, স্থবির অবসর, এই মনকেমন দুলুনি কাটিয়ে আবার ঘড়িটায় দম দিতে হবে। অভ্যস্ত। নিয়মতান্ত্রিক। যেমন হয় আর কী। 

এবং? একটা অদ্ভুত শব্দ লিখছেন: ‘লয়’। সময়ের লয়। সে কেবল একই মাত্রায় চলে না। কখনও বাড়ে, আবার কমে কখনও। ঢিমে। এই ছুটন্ত। ট‍্যুরিস্টের দেহ আর আমাদের অভ্যাসমাফিক জৈব শরীরের লয়– দুটো একই সমে ফেরে না কখনও। রবীন্দ্রনাথ বলছেন। 

কেন এমন হয়, বিভাস শুনলে ভেতরে আশ্বিন ঘনিয়ে আসে? সময়কে মনে হয় শ্লথ– যে, নিশ্চিন্ত নির্বেদে হেঁটে যাচ্ছে এই ধুলো আর কাঁকরবিছানো আলোপথ দিয়ে? ভোর। আকাশের রং ঘাসফড়িংয়ের মতো। আবছা ও নীল। আলোর গর্ভসঞ্চার ঘটল ক্রমে৷ ওই তো, শেষ গানে এগিয়ে গেলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। রূপং দেহি, জয়ং দেহি। বাংলার একান্ত পুজোয় ঘনিয়ে এল কোন সুদূরের হাওয়া, মধ্যপ্রাচ্যর সুর।

আশ্বিনেরও বয়স বাড়ল। দেখতে দেখতে।

More Articles