পুরস্কারের লজ্জা! নোবেল পায়নি জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহাদের
Nobel prize 2022: কত মুখ প্রাপ্য কৃতিত্ব পায় না, কত মূল্যবান গবেষণা চোখ এড়িয়ে যায় নোবেল পুরস্কারের।
নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে ইন্টারনেটের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা এখন নির্বিকল্প, আর সেই কারণেই ওয়াইফাই এখন রীতিমতো অপরিহার্য। আজ ওয়াইফাই যে স্তরে পৌঁছেছে, তার নেপথ্যে বহু মানুষের অবদান আছে, কিন্তু আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ওয়াইফাই-এর কথা বললে কার কথা আপনার মনে পড়ে? বা আজকের ফাইভ জি-তে উত্তরণের আগেও এই প্রযুক্তির মেরুদণ্ডটা যিনি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি-ই বা কে?
এই প্রশ্নের উত্তরে আসার আগে একটু ছানবিন করা যাক নোবেল পুরস্কারের কিসসার।
২০২২ সালের নোবেল পুরস্কারজয়ীদের নাম আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি। কেবল বিজ্ঞানবোদ্ধা নয়, বিজ্ঞানে উৎসাহী বহু মানুষ নোবেল পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণার ওই একটি সপ্তাহ পথ চেয়ে বসে থাকেন। যাঁরা নোবেল পেলেন এই বছর, বিজ্ঞানে তাঁরা অনির্বচনীয় অবদান রেখে গেলেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু প্রতি বছরই নোবেল পুরস্কারজয়ীদের নাম ঘোষণার এই একটি সপ্তাহে যেন বারবার মনে হয়, আহা একজন বাঙালি অন্তত বিজ্ঞানে নোবেল পান যেন এইবার, নিদেনপক্ষে একজন ভারতীয়! তার কিছু ব্যত্যয় বোধ করি এই বছরেও ঘটেনি।
আরও পড়ুন: সম্পূর্ণ নতুন মানুষ প্রজাতির সন্ধান এনে দিল নোবেল! যে রহস্যর সমাধান করল বিজ্ঞান
ভারতে বিজ্ঞান-গবেষণা আন্তর্জাতিক স্তরে গিয়ে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, এ-দেশে গবেষণার পরিকাঠামো আছে কি না, ভারতীয় ল্যাবগুলি ফান্ডিং পায় কি না বা এ দেশের রিসার্চ স্কলাররা কেমন আছেন, এসব কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও বাঙালি বিজ্ঞানী ভারতে বসে গবেষণা করে নোবেল পাবেন, এই কথা বাঙালি আজও মনে করেন কি না- তা আমাদের অজানা।
অনেকে বলেন বোলৎজ়ম্যান প্রাইজ় নাকি নোবেল জয়ের পূর্বের ধাপ মাত্র। ভারতের প্রথম বোলৎজ়ম্যান প্রাইজ়জয়ী ড. দীপক ধরের সঙ্গে ইনস্ক্রিপ্ট-এর মুখোমুখি আড্ডায় তিনি জানালেন, জহরলাল নেহরুর আমলেও ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার যে বাতাবরণ ছিল, তা আর এখন নেই। (প্রসঙ্গত, পদবির সঙ্গে মিল থাকলেও ড. ধর বাঙালি নন। তিনি উত্তরপ্রদেশীয়, কলেজ স্তর অবধি উত্তরপ্রদেশেই তিনি পড়াশোনা করেছেন।)
কিন্তু ভারতীয় হিসেবে একথা অস্বীকার করার জো নেই, ভারতেও একদিন সেই স্বর্ণযুগ ছিল, যখন দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুপরিবেশ ছিল। ভারতে বসে গবেষণা করেও সি. ভি রামন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
তবে কোনও বাঙালি যে বিজ্ঞানে আজও নোবেল পাননি, সেই আক্ষেপ বোধহয় অল্পবিস্তর সমস্ত বাঙালির রয়েছে। অথচ আবিষ্কারের গুরুত্ব বিচার করলে, পাওয়ার কথা কি ছিল না? শুরুতেই যে প্রশ্নের মুখে আপনাদের ঠেলে দিয়েছি, এখানেই রয়েছে তার উত্তর। আজকের ওয়াইফাই, বা ফাইভ-জি-র মেরুদণ্ডটা যিনি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু স্বয়ং।
টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের কৃতিত্ব মার্কনি পেলেও, আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস একই সময়ে এদেশে বসে রেডিও তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। এবং জগদীশচন্দ্র বসুই প্রথম, যিনি হাতেনাতে দেখিয়েছিলেন, কয়েক মিলিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যর রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ সম্পন্ন করা যায়। পরে মার্কনি নিজেও রেডিও তরঙ্গ নিয়ে গবেষণার নেপথ্যে জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান স্বীকার করেছিলেন।
জগদীশচন্দ্র বসু কেবল পদার্থবিদ্যায় নিজের গবেষণাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, জীবজগৎ সম্পর্কেও যে তাঁর প্রবল অনুসন্ধিৎসা ছিল, সেকথা বলার আলাদা করে প্রয়োজন নেই বোধহয়। বাঙালি একথা সাধারণ জ্ঞানের মতোই জানে যে, তিনি-ই প্রথম, যিনি বলেছিলেন গাছের প্রাণ আছে।
তবে জগদীশ বোস একা নন, তালিকায় আছেন এরকম অনেক বাঙালি, যাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অবদান অশেষ। অবশ্য 'অশেষ' বললে হয়তো সরলীকরণ করা হয়ে যাবে; বরং বলা ভালো, তাঁদের আবিষ্কার আদতেই আবিশ্ব বিজ্ঞানসমাজে তোলপাড় ফেলার ক্ষমতা রাখত। ক্ষমতা রাখত আমাদের চারপাশ, পরিবেশ, জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলোকে নাড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু তাঁরাও নোবেল পাননি।
যেমন ধরা যাক মেঘনাদ সাহার কথা। একবার নয়, দু'বার নয়- আটবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি, অথচ নোবেল পাননি একবারও। কেন পেলেন না তিনি নোবেল? উত্তরটা সোজা। কারণ তিনি ভারতীয়, আর দেশটা তখন ব্রিটিশদের হাতে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা আবিষ্কার করেন সাহা-ল্যাংমিয়ার সমীকরণ। একটি নক্ষত্রে তাপমাত্রা কতটা, তার ওপর নির্ভর করে সেই নক্ষত্রে কী পরিমাণ আয়নিত কণা রয়েছে, তা হিসেব করা যায় এই সমীকরণ দিয়ে। পরবর্তীকালে অবশ্য (১৯২৩) রালফ ফোলার এবং এডওয়ার্ড আর্থার কিছু ত্রুটি খুঁজে পান এই সমীকরণে এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা কিছু পরিবর্তন ঘটান সাহা-ল্যাংমিয়ার সমীকরণে।
কিন্তু তারপরেও এই সমীকরণের নেপথ্যে যে মূল তত্ত্ব বা থিওরি, তা আসলে কার, সেই নিয়ে দীর্ঘ চাপানউতোর চলতে থাকে ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহলে। সাহা এই থিওরিটির নাম দেন 'থিওরি অব সিলেক্টিভ রেডিয়েশন প্রেশার'।
১৯১৭ সালে তাঁকে সেই থিওরিটি পৃথিবীখ্যাত অ্যাস্ট্রোফিজি়কাল জার্নাল-এ পাঠাতে হতো। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁকেই সেই প্রকাশনার খরচ জোগাতে হবে, এই ছিল শর্ত। মেঘনাদ সাহা তখন অর্থকষ্টে। প্রকাশনার খরচ দেওয়ার সামর্থ তখন তাঁর নেই। অগত্যা বাধ্য হয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'জার্নাল অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স'-এ প্রকাশ করতে বাধ্য হন তাঁর গবেষণাটি।
বিজ্ঞান প্রসারের আর্কাইভ থেকে মেঘনাদ সাহার হুবহু বক্তব্য তুলে ধরা হলো এই বিষয়ে:
… I might claim to be the originator of the Theory of Selective Radiation Pressure, though on account of discouraging circumstances, I did not pursue the idea to develop it. E.A. Milne apparently read a note of mine in Nature 107, 489 (1921) because in his first paper on the subject ‘Astrophysical Determination of Average of an Excited Calcium Atom’, in Month. Not. R. Ast. Soc., Vol.84, he mentioned my contribution in a footnote, though nobody appears to have noticed. His exact words are: ‘These paragraphs develop ideas originally put forward by Saha’.
মেঘনাদ সাহা তাঁর প্রাপ্য কৃতিত্ব পাননি। আর এখানেই বিজ্ঞানমহলে মুখে মুখে ফেরা সেই প্রশ্নটা আবারও মনের কোনে উঁকি দেয়- বিখ্যাত জার্নালে নিজের আবিষ্কার প্রকাশ না করতে পারায়, আজও কতজন বিজ্ঞানীর কাজ যথাযথ মর্যাদা পায় না? আজও কত বিজ্ঞানীর সাড়াজাগানো গবেষণা নোবেল কমিটির চোখে ধরা পড়ে না?
এরপর আসব সত্যেন বোসের কথায়। আবারও আরেক বিজ্ঞানী, যাঁর সাড়াজাগানো আবিষ্কার সেভাবে কৃতিত্ব পায়নি। পরিহাস এখানেই, বহু নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী তাঁর কাজকে নিজেদের গবেষণায় প্রয়োগ করেছেন।
ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল এ. এম. ডাইরেক নির্দিষ্ট এক ধরনের কণাকে 'বোসন' পার্টিকল নাম দেন সত্যেন বোস এবং আইনস্টাইনের নামানুসারে। ২০১৩ সালে যখন পিটার হিগস এবং ফ্রাঙ্কোয়েস এংলার্ট পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন 'হিগস বোসন' তত্ত্বের আবিষ্কারের জন্য, সত্যেন বোস কেন সেই তত্ত্বের জন্য নোবেল পুরস্কারের ভাগ পেলেন না, স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রশ্ন ভারতীয়দের মনে জেগে ওঠে।
তবে সেই প্রশ্ন বা দাবি, বেশ কিছু অর্থে ভুল। কারণ বোস এবং আইনস্টাইন সমস্ত রকমের বোসন কণার ওপর আলোকপাত করে, সেখানে 'হিগস সিক্স' কেবল একটি নির্দিষ্ট বোসন কণার ওপর কাজ। কিন্তু তারপরেও সত্যেন বোসকে বোধহয় আলাদা করেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া যায় তাঁর কাজের জন্য। এবং নোবেল পুরস্কারের জন্য তিনি দু'বার মনোনীতও হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে একবার কেদারেশ্বর ব্যানার্জি এবং ১৯৬২ সালে এস. বাগচী তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্যে মনোনীত করেন।
এই তিন বাঙালি ছাড়াও মাথায় আসে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের কথা। প্রফুল্লচন্দ্র, যিনি ছিলেন 'ফাদার অফ ইন্ডিয়ান কেমিস্ট্রি', রসায়নে গবেষণায় যাঁর বিস্তর গবেষণা ভারতে বসে, অথচ তিনিই পাননি নোবেল। অসীমা চট্টোপাধ্যায়, যিনি সত্যেন বসুর ছাত্রী, যিনি বিংশ শতকের নামকরা এক রসায়নবিদ, যিনি ঔষধিগুণসম্পন্ন গাছ নিয়ে বিস্তর কাজ করে গিয়েছেন, ম্যালেরিয়া এবং এপিলেপ্সি-র ওষুধ যিনি তৈরি করেছিলেন, নোবেল পাননি তিনিও।
নোবেল নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কার। যাঁরা নোবেল জয় করেন, তাঁদের কাজ নিঃসন্দেহে সাড়াজাগানো। তবু তারপরেও কত মুখ প্রাপ্য কৃতিত্ব পায় না, কত মূল্যবান গবেষণা চোখ এড়িয়ে যায়। আর তখনই মনে পড়ে ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় ড. দীপক ধরের বলা কথা, 'পুরস্কার দিয়ে কাজের বিচার করা বন্ধ করা উচিত।'