অনুবাদের আকাল, কালজয়ী বাংলা সাহিত্য পৌঁছতেই পারল না নোবেলের ধরাছোঁয়ায়
Nobel prize 2022: পাঠকের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে চললে আগামী একশো বছরেও বাঙালি সাহিত্যিকদের নোবেল অধরাই থেকে যাবে।
নোবেল কমিটি সম্প্রতি ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া সাহিত্যিকদের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, বাঙালি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম রয়েছে। এতে স্বভাবতই বাঙালি মহলে উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙা প্লাবন, সেই ঢেউয়ে প্রায় সকলেই একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন, হুম! তারাশঙ্করের নোবেল পাওয়া অবশ্যই উচিত ছিল; অন্যদিকে কেউ-কেউ আবার খানিক হতাশ হয়ে অভিযোগ করছেন, আরও অনেকেই তো ছিলেন, তাঁদের নামও মনোনয়নে আসা উচিত ছিল, কেন এল না! এমত অবস্থায় আবার কয়েকজন সাহিত্য-বিশারদ অনুমান করছেন, মহাশ্বেতা দেবীও নাকি একদা মনোনয়ন পেয়েছিলেন, নোবেল কমিটির ৫০ বছর পরে তালিকা প্রকাশের পলিসির চক্রান্তে নাকি এসব বাঙালিরা বর্তমানে জানতে পারছে না। চারপাশে জাগো-জাগো রব, যেন এখনই সময় এসেছে তারাশঙ্করকে ও মহাশ্বেতাকে এবং আরও খ্যাত-অখ্যাত সাহিত্যিককে দিব্যচক্ষু উন্মীলন করে অনুধাবন করার, যেন এতদিন তাঁরা বিস্মৃতির অতল সাগরে তলিয়ে ছিলেন!
আমাদের দেশের গরিষ্ঠ-সংখ্যক কবি-সাহিত্যিকরা বরাবরই বিদেশ তথা মূলত আমেরিকা ও ইউরোপের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। এশিয়ার প্রচুর এমন দেশ আছে, যেখানে রীতিমতো নতুন ছন্দে নতুন ব্যাকরণ গড়ে সাহিত্যচর্চা হয়ে এসেছে এবং এখনও বর্তমানে হয়ে চলেছে, অথচ আমরা বরাবরই ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে হওয়া সাহিত্য নিয়েই কথা বলে এসেছি ও এখনও তাই বলে চলেছি। যতটা কথা জয়েস, বোর্হেস, কুন্দেরা, বোদলেয়ার, মার্কেজ, কামু-কে নিয়ে হয়, ততটা কথা সুবিমল মিশ্র, দেবেশ রায় বা অমিয়ভূষণকে নিয়ে হয় কি? হয় না, কারণ এঁরা প্রথমত বাংলায় সাহিত্যচর্চা করেন বা একদা করেছেন, পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ব্যাকরণ ও প্রকৌশলকে ভেঙে দিয়েছেন, ফলে যেহেতু বাঙালি মানসিকতায় বাংলায় লেখা সাহিত্য নিয়ে কিছু স্টিরিওটাইপ বরাবরই রয়েছে, সেই কারণে স্টিরিওটাইপ ভেঙে তছনছ করা সাহিত্য কোনও ভাবেই আলোচনাযোগ্য হয়ে ওঠে না। কোন সেই এককালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' নিয়ে লিখেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, এই এক 'ঢোঁড়াই'-এর কারণেই সতীনাথ নোবেল পাওয়ার যোগ্য। হতেই পারে, সুনীলের বক্তব্য সুনীলের সাপেক্ষে অবশ্যই সঠিক হতে পারে, আবার অন্য সাহিত্যিক বা পাঠকের মত এক্ষেত্রে ভিন্ন হতেও পারে। তবে, কেবল বললেই তো আর হয় না― বাঙালিদের যদি নোবেলে স্বজাতির নাম দেখার এতই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, তাহলে অনুবাদ সাহিত্যকেও উন্নতমানের করতে হয়। সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার জন্য বাঙালিরা যোগ্য বিবেচিত হতেন তখনই, যদি ভালো অনুবাদ সাহিত্যের চর্চা এখানে থাকত।
আরও পড়ুন: নোবেলের দাবিদার, তাই হঠাৎ বাঙালির বাজি তারাশঙ্কর! কী ভাবছেন লেখকরা
আমাদের অনুবাদ সাহিত্যতে কিন্তু প্রচণ্ড স্বল্পতা রয়েছে। আমরা যে সময়পর্বটা দেখতে চাইছি, অর্থাৎ বিংশ শতকের পুরো সময়টা― যখন থেকে নোবেল দেওয়া শুরু হয়েছিল, তখন থেকে শুরু করে বিংশ শতকের শেষ পর্ব অবধি― বিশ্বসাহিত্য কিন্তু সেসময়েই নিয়মিত বিভিন্নভাবে ইংরেজি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়ে চলেছিল। ইংরেজি তো শাসকের ভাষা, দেশকালভেদে সমস্ত সংস্কৃতিতে আধিপত্য কায়েম করে এসেছে, বিশ্বসাহিত্য এই ভাষায় অনূদিত হতে পেরেছিল এবং সেই অনুবাদ বিদেশের মাটিতে, বিশেষ করে ইউরোপের মাটিতে প্রচারিত হতে পেরেছিল বলেই কিন্তু অন্য ভাষাভাষী সাহিত্যিকরা নোবেল কমিটির কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিলেন। বিদেশে যে সময় নাম না-জানা বা খানিক পরিচিত সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারের জন্য ভূষিত হচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে আমাদের এশিয়াতে, ভারতে বসে এমন অনেক সাহিত্যিক নিজের সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁদের কাজকর্ম ঠিকঠাকভাবে ভাষান্তরিত হলে অবশ্যই তাঁরা নোবেল পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। আজকে আমরা ১৯৭১ সালে তারাশঙ্করের মনোনয়ন দেখে চমকে যাচ্ছি, তারাশঙ্কর ছাড়াও এমন অনেক সাহিত্যিক ছিলেন, যাঁরা নোবেলের নিশ্চিত দাবিদার। দেবেশ রায়কে ধরুন। অমিয়ভূষণ মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী, সুবিমল মিশ্র, কমলকুমার মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রমথ চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ! এইসব সাহিত্যিকদের কাজ অনূদিত হলে অবশ্যই এঁরা প্রায় সকলেই নোবেল পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারতেন।
এখন আমাদের ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়ে গেছে যে, বাঙালিরা নেহাতই কাঁদুনে জাতিতে পরিণত হয়েছে। তারা নস্টালজিয়ায় ভোগে। বর্তমানে এমন কোনও সাহিত্য পত্রিকা নেই (গুটিকয়েক লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া), যেখানে বিভিন্ন প্রজন্মের সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত তুল্যমূল্য বিচার হয়। হবেও বা কী করে? সাহিত্য এখন আটকে গেছে হরর ফিকশনে, তান্ত্রিকে, নয়তো রসালো থ্রিলারে। মেধাভিত্তিক যে সাহিত্য, সেই সাহিত্য কিন্তু বর্তমানে স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যেই সীমিত। অনুবাদ কর্ম এখন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখন সেই বাঙালি সাহিত্যিকরা নেই, যাঁদের অনুবাদ বিদেশের মাটিতে প্রচার পেলে নোবেল বা অন্য কোনও বড়ো পুরস্কারের জন্য ভূষিত হবে।
অন্যদিকে ভারতীয় সাহিত্যে এখনও সেই গুণমান বজায় রেখে কাজ হচ্ছে। সম্প্রতি গীতাঞ্জলি শ্রী তাঁর উপন্যাস 'রেত সমাধি'-র জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পেলেন, তা কিন্তু তিনি তাঁর যোগ্যতা তথা তাঁর সাহিত্যের সফল অনুবাদ ও প্রচারের কারণেই পেয়েছেন। বাংলায় রবিশংকর বলের কথাই ধরুন। তিনি কি নোবেল পাওয়ার যোগ্য নন? শাহযাদ ফিরদাউস? শহীদুল জহির? এঁদের অবদান অনস্বীকার্য, পাশাপাশি আমাদের ব্যর্থতাও কালো কালিতে লিখে রাখার মতো। বাংলা সাহিত্যকে বাঙালিরাই যদি অনুবাদ করে সঠিকভাবে সেই জায়গায় পৌঁছে দিতে না পারেন, তাহলে কি বিদেশি কোনও গণ্যমান্য এসে বাংলা সাহিত্য অনুবাদ করবেন বলে আমরা ধরে নিচ্ছি? আমরা এই জায়গায় বড্ড দুর্বল। এবং এই দুর্বলতাই ঢাকা দিই নস্টালজিয়ায় ভুগে, অহেতুক গর্ববোধ করে। একটা প্রজন্মের গর্ব তখনই হবে, যখন সেই প্রজন্মের স্বীকৃত কিছু মানুষজন এই ধরনের উদ্যোগ নেবেন। বৃহৎ গোষ্ঠীর পোষ্য প্রিভিলেজড সাহিত্যিকরা বছরের পর বছর মেধাহীন দুর্বল সাহিত্য লিখে গেছেন, অথচ কেউ এতটুকু উদ্যোগ নেননি পূর্ববর্তী প্রজন্মের বাংলা সাহিত্যকে বাংলার বাইরে বের করার, সেসবকে গ্লোবালাইজ করার। এরকম উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টাও কেউ করেননি, ইচ্ছেও প্রকাশ করেননি। এই ধরনের সদিচ্ছা যখন গোটা একটা জাতির মধ্যে না থাকে, তখন মনে হয় না তাদের ক্ষেত্রে নোবেল পাওয়া বা না-পাওয়া কোনও গুরুত্ব রাখে বলে। গুরুত্ব রাখবে তখনই, যদি অনুবাদের মাধ্যমে সেইসব কাজ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্বীকৃত হয়।
নোবেল পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে বাঙালির এই উচ্ছ্বাসও কিন্তু একপ্রকার কদর্যতার সামিল। কারণ নোবেল পুরস্কারটি দিচ্ছে সুইডিশ কমিটি। তাদের কাছে অনুবাদ হওয়া যেসব সাহিত্য পৌঁছয়, তাদের বিচারকের দল সেইসব সাহিত্য পাঠ করেন, সেখান থেকে দেশকালের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে যেসব সাহিত্য, সেগুলিকে তাঁরা বিবেচনায় আনেন। এবারে তাঁদের কাছে কোনও দেশের বা কোনও জাতির সাহিত্যকর্ম যদি কোনও কারণে না পৌঁছয়, তাহলে কি নোবেল কমিটি বিভিন্ন দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে আর বলবে যে, 'দাও, আমাদের পড়তে দাও। পড়ে দেখি নোবেল দেওয়া যায় কি না?' বা তাঁরা বাঙালিদের কাছে এসে বলবেন কি যে, 'চলো বাংলা ভাষা শিখি, শিখে তোমাদের সাহিত্য পড়ে দেখি কেমন কী অবদান রাখতে পেরেছ?' বুঝতে হবে, তাদেরও রিসোর্স সীমিত। তাছাড়া এর মধ্যে অনেক অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও ব্যাপার থাকে। পিছিয়ে পড়া দেশ, বঞ্চিত জাতি, বর্ণবন্ধুর সাহিত্যিককে নোবেল দিলে তবেই না তা নোবেল! এই ধরনের রাজনীতি― ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই― সব মিলিয়েই নোবেল 'নোবেল' হয়। এই বছর সাহিত্যে নোবেলজয়ী আনি এরনোর কাজে সেই অর্থে কোনও বৈচিত্র্য নেই। তিনি গোটা জীবন ধরে আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখে গেছেন, নিজের অভিজ্ঞতাকে তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাহলে তো তসলিমা নাসরিন থেকে কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন, বাণী বসু- সকলকেই বিবেচনা করা যেত! এঁদের মধ্যে তসলিমা বাদে বাকিদের কাজকর্ম ভাষান্তরিত হয়নি সেভাবে। কে বলতে পারে যে, পরবর্তী সময়ে তসলিমার সাহিত্য নোবেলযোগ্য বিবেচিত হবে না? জানা যাবে হয়তো অর্ধশতাব্দী পরে।
তাই, মনে হয় না এত আফসোস বা এই ধরনের মানসিকতা রেখে কাজের কাজ হবে। আজকে অসীম রায়কে ক'জন চেনেন? চেনেন না। মণীন্দ্র গুপ্ত, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, নলিনী বেরা, সাধন চট্টোপাধ্যায়, কিন্নর রায়― এঁদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। আমরা গুটিকয়েক সাহিত্য নিয়েই কেবল মাতামাতি করি। অতীন মানেই যেন তাঁর 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' সিরিজ। আর যেন কিছু নেই। অথচ তিনি অজস্র ছোটগল্প লিখেছেন, সামুদ্রিক জীবন নিয়ে বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন, যা বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় স্থান পাওয়ার যোগ্য। সিরাজ বলতে আমরা বুঝি খালি কর্নেল, নয়তো উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ যেমন 'অলীক মানুষ', 'মায়ামৃদঙ্গ' ইত্যাদি। এর বাইরেও সিরাজের একটা বড় আকাশ রয়েছে, যে আকাশটা বাঙালিদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। প্রচুর সাহিত্যিক রয়েছেন, যাঁরা নোবেল বা আরও বড় সম্মান পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাওয়া উচিত বললেই কাজ হবে না। একটা গোটা জাতির দায়বদ্ধতা থাকে তাঁর সাহিত্যিকদের প্রতি। কারণ সাহিত্যিকরা পরিশ্রম করে সমাজকে চিনিয়েছেন, সমাজের ইতিহাসকে ধরে রেখেছেন। সেই দায়বদ্ধতা থেকে পিছু হঠতে পারে না বাঙালি। বাঙালির দৈন্য এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, তাঁরা যদি এখন এই ব্যাপারে সজাগও হয় বা হয়ে গিয়ে থাকেও, তা সত্ত্বেও বাঙালির আর কিছু করার নেই, কারণ এখন বর্তমানে চলা সাহিত্য কেবল নির্দিষ্ট কিছু জঁর ফিকশনেই আবদ্ধ কেবল। সমসময়ের বাংলায় বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের অভাব ভীষণই। লিটল ম্যাগাজিনের সেই সমৃদ্ধি নেই। বিক্রি খুবই কম। কে বলতে পারে যে, আগামিদিনের সর্বশ্রেষ্ঠ কোনও কাজ বর্তমানে বাংলার প্রত্যন্ত কোনও অঞ্চলে বসে কেউ করে চলেছেন কি না? তাঁদের কাজ আমাদের কাছে যেমন পৌঁছচ্ছে না, তেমনি আমরাও পৌঁছতে চাইছি না সেভাবে।
পাঠকের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে চললে আগামী একশো বছরেও বাঙালি সাহিত্যিকদের নোবেল অধরাই থেকে যাবে। হয়তো এটাই এই জাতির নিয়তি।