হেলায় নোবেল প্রত্যাখ্যান! ব্যতিক্রম তৈরি করেছিলেন যাঁরা
Nobel prize 2022: নোবেল পুরস্কারের মতো একটি লোভনীয় স্বীকৃতিও পায়ে ঠেলে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি কেউ কেউ, তাঁরাই তৈরি করেছেন ব্যতিক্রম।
সাধারণত কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার-প্রাপ্তিতে সর্বতোভাবেই খুশি হয় মানুষ, যা খুবই স্বাভাবিক। কোনও ছোট-বড় পুরস্কার পেলেও তা কখনও প্রত্যাখ্যান করে না মানুষ, সাধারণ ধারণা এমনই। বরং প্রাপ্ত পুরস্কার সাদরে গ্রহণ করে সযত্নে নিজের ঘরে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখার সংস্কৃতিই মূলধারার বলে গণ্য হয় বিশ্বজুড়ে। তবে সাধারণ পুরস্কারের সঙ্গে নোবেল পুরস্কারের অনেক তফাৎ। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে প্রচলিত যাবতীয় পুরস্কারের মধ্যে নাম, গুণ, মূল্য এবং ওজনে নোবেল সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এই পুরস্কার প্রদানের দাবিতে কোনও ব্যক্তির পক্ষে আন্দোলন, সংগ্রাম, লেখালেখির ইতিহাসও কম নয়। তবে নোবেল পুরস্কারের মতো একটি লোভনীয় স্বীকৃতিও পায়ে ঠেলে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি কেউ কেউ, তাঁরাই তৈরি করেছেন ব্যতিক্রম।
২১ অক্টোবর, ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক বিস্ফোরক ডিনামাইট। মূলত মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যেই ডিনামাইটের আবিষ্কার হলেও, পরবর্তীতে কার্যত যথেচ্ছ অপব্যবহার শুরু হয় তাঁর আবিষ্কারের। তাঁর আবিষ্কৃত এই যন্ত্রের মানববিধ্বংসী রূপ দেখে শেষ জীবনে ভেঙে পড়েন বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। গভীর অনুতাপে ভুগতে থাকেন তিনি। এই কারণেই মৃত্যুর পূর্বে তাঁর সম্পদের ৯৪% জনকল্যাণের অবদান রাখা ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করার জন্য দান করে দেন তিনি। সেই সময় এই পুরস্কারমূল্যের পরিমাণ ছিল ৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার। এই বিপুল সম্পত্তি থেকেই ১৯০১ সাল থেকে তাঁর নামেই শুরু হয় নোবেল পুরস্কার প্রদান। পৃথিবীতে নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সংস্থার তরফ থেকে প্রদান করা হয় বিভিন্ন রকমের পুরস্কার। তবে এই সমস্ত পুরস্কারের মধ্যে সবথেকে মূল্যবান এবং সবথেকে ওজনদার পুরস্কার হলো বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামে প্রচলিত এবং তাঁর দান করা অর্থে প্রদত্ত নোবেল পুরস্কার।
আরও পড়ুন: শান্তির নোবেল পেলেন বেলারুশের জেলবন্দি! বেলেৎস্কির জয় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
এই নোবেল পুরস্কারে থাকে ১৮ ক্যারেটের সবুজ সোনার ধাতবের ওপর ২৪ ক্যারেটের সোনার প্রলেপ দেওয়া একটি ক্রেস্ট, একটি সম্মাননা সনদ এবং মোটা অঙ্কের সাম্মানিক অর্থ। এই মুহূর্তে সম্মাননী অর্থের অঙ্ক ১১ লক্ষ মার্কিন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় ৮ কোটি টাকার থেকেও বেশি। সবচেয়ে সম্মানজনক এবং লোভনীয় এই পুরস্কারের জন্য ইতিহাসে বহুবার লবিবাজি, মিটিং-মিছিল এবং লেখালিখির ঘটনা ঘটে গিয়েছে। পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার পূর্বে এবং পরে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের বিরল ঘটনার সাক্ষীও রয়েছে পৃথিবী। নোবেল প্রত্যাখ্যানকারীদের নির্লোভ মানসিকতার ব্যাপারে হয়তো কারও অবকাশ থাকার কথা নয়। ফরাসি দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে থেকে শুরু করে, রুশ সাহিত্যিক বরিস পাস্তেরনাক এবং ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা লে দুক তো রয়েছেন এই তালিকায়।
জঁ পল সার্ত্রে
১৯৬৪ সালে একজন ফরাসি দার্শনিক এবং সাহিত্যিক তাঁর জগৎবিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ, 'বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস'-এর জন্য নোবেল কমিটি-কর্তৃক চূড়ান্ত মনোনীত হয়েও প্রকাশ্যে ঘোষণা করে এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইতিহাসে সর্বপ্রথম হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার কয়েকদিন পরেই নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করবেন না- এই মর্মে চিঠি দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সেই ফরাসি দার্শনিক, যাঁর নাম ছিল জঁ পল সার্ত্রে। বিংশ শতকের আলোচিত ফরাসি দর্শন এবং মার্কসবাদের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে তাঁর নাম ছিল জগৎজোড়া। সেই সূত্রেই লেখা গ্রন্থের জন্য তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে এই লোভনীয় পুরস্কারটিকে প্রত্যাখ্যান করে ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন এই ব্যক্তি।
ফরাসি চিন্তক, সাহিত্যিক এবং দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তবে এই পুরস্কারের স্বীকৃতি তিনি গ্রহণ তো দূরের কথা, বরং স্বীকার করতেও ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, একজন লেখকের জন্য কখনওই নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেওয়া উচিত নয়। সেই কারণেই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার গ্রহণকে জঁ পল সার্ত্রে নিজের বৌদ্ধিক বিকাশের পথে অন্তরায় হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর নোবেল পুরস্কার-বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। আর এই তালিকাতেই নাম ছিল এই ফরাসি দার্শনিকের। তবে ইতোপূর্বে তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হচ্ছেন জানতে পেরে জঁ পল সার্ত্রে ১৪ অক্টোবর নোবেল কমিটির কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন, যেখানে তিনি এই পুরস্কার অস্বীকৃতির কারণ স্পষ্টভাবে জানান। তিনি চিঠিতে নোবেল কমিটিকে সতর্ক করে দেন এই বলে, যদি তাঁকে পুরস্কার দেওয়াও হয়, তা তিনি গ্রহণ করবেন না। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত সেই সময় ওই চিঠি কেউ পড়েননি।
জঁ পল সার্ত্রে সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান, উপনিবেশবাদী তত্ত্ব, সাহিত্যতত্ত্ব এবং সাহিত্য গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। নিজের যোগ্যতায় সমকালীন দার্শনিক সমাজের সবথেকে উঁচু স্তরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তিনি। এখনও বিশ্বদর্শনের যে রাস্তায় মানুষ হাঁটুক না কেন, জঁ পল সার্ত্রে-কে একবার না একবার হলেও অধ্যয়ন করতে হবে। তাঁর এই প্রত্যয় তিনি দর্শনতত্ত্বর মাধ্যমেই অর্জন করেছিলেন। কোনও সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না রাখলেও, জঁ পল সার্ত্রের লেখনীতে সমাজতন্ত্রের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাওয়া যায়। পাশাপাশি, মার্কসবাদের প্রতিও তাঁর একটা আলগা সমর্থন ছিল। সাম্যবাদ এবং মানবতাবাদের সেনানী হিসেবে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। এসব কারণবশত তাঁর ফ্ল্যাটে বোমা ছোড়া হয়, এমনকী, তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয়।
জঁ পল সার্ত্রে-কে ফরাসি অস্তিবাদের জনক মনে করা হয়ে থাকে। তাঁর দর্শন অস্তিত্ববাদ এবং নান্দনিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁর মূল বক্তব্য হলো, প্রকৃতপক্ষে মানুষের সত্তা বা অধিবিদ্যক ধারণার তেমন কোনও প্রয়োজন নেই। এই ধরনের ধারণা মানুষের জীবনে পরিপূর্ণভাবে সুখ দিতে পারে না। মানুষের জীবনে সবথেকে বেশি যেটা দরকার, তা হলো নিজের অস্তিত্বকে স্বীকার করা। অস্তিত্ব স্বীকৃত হলেই মানুষের জীবনের সত্য অর্জিত হয়। মানুষ সব অবস্থায় একটি স্বাধীন প্রাণী; আর এই স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাই মানুষকে সাহায্য করে সবকিছুকে চিনতে, ভাবতে এবং অর্জন করতে। জঁ পল সার্ত্রে তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বারংবার প্রমাণ করেছেন, বিবেচনাহীনতার কাছে ব্যক্তিমানুষ কতটা অসহায়। তবে মানুষ যদি অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন হয়, তবে তাকে শোষণ করা খুব একটা সহজ নয়।
বিংশ শতকের বিখ্যাত এই ফরাসি লেখক প্রথম থেকেই ছিলেন প্রথাবিরোধী। তাঁর চিন্তা ও চেতনাজুড়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক প্রথা ভাঙার প্রবল ঝড় ছিল। প্রচলিত সামাজিক রীতি-নীতির তোয়াক্কা তিনি কখনোই করেননি। বরং, যে সময়ে যে বিষয়টাকে সঠিক মনে হয়েছে, তা তিনি অকপটে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন। তিনি বিখ্যাত তাঁর অস্তিত্ববাদ বিষয়ক দর্শনের জন্য, বিখ্যাত তাঁর দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী দর্শন গ্রন্থ 'বিইং অ্যান্ড নাথিংনেস'-এর জন্য, যার জন্য তিনি মনোনীত হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারে। তবে তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনই তাঁকে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানে বাধ্য করে। ব্যক্তিগত দর্শনের সঙ্গে সংঘর্ষে করে তিনি নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, নোবেল পেলেই যে ইতিহাস মনে রাখবে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। অনেকেই এমন রয়েছেন, যাঁরা নোবেল না পেলেও, পুরস্কার প্রাপকদের থেকে অনেক বড় কাজ করে গিয়েছেন। কাজটাই আসল, যদি কোনও ব্যক্তির কাজ মানুষের মনে দাগ কাটতে পারে, তাহলে সেই ব্যক্তি হয়ে থাকবেন অমর।
তবে, অনেকে এমন বলেন, সার্ত্রে-র এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে আছে তাঁর আগে আলব্যের কামু-র নোবেল পুরস্কার লাভ। কামু ওই পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে এবং খবরটি পাওয়ার পরে খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে নোবেল কমিটিকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ একটি পত্র লিখেছিলেন তিনি। তবে, সার্ত্রে ও কামু-র মধ্যে সেই সময় সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ। আগে পুরস্কার পেয়ে কামু কিছুটা এগিয়ে গেলেও, কয়েক বছর পরে ওই একই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে সার্ত্রে হয়তো বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি আসলে তেমন মহান কিছু নয়। তবে নিজের দীর্ঘ বিবৃতিতে পুরস্কার গ্রহণে নিজের অনীহার কারণ হিসেবে অবশ্য এই বিষয়টি তুলে ধরেননি সার্ত্রে।
বরিস পাস্তেরনাক
তিনি ছিলেন রুশ দেশের একজন বিতর্কিত সাহিত্যিক। দু'টি আপাতবিরোধী ধারার এক বিচিত্র সংমিশ্রণ ঘটে গিয়েছিল তাঁর মধ্যে। তিনি একদিকে ছিলেন গীতিধর্মী কবিতা লেখায় সিদ্ধহস্ত, পাশাপাশি রাশিয়ার সুপ্রাচীন এপিকধর্মী গদ্যরচনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এরকম ঘটনা খুব একটা বেশি দেখা যায় না। তাঁর জন্ম হয়েছিল রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরে, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি। সুসংস্কৃত ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো-র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল তাঁর সম্পূর্ণ শৈশব। মস্কো তখন স্বাধীন চিন্তাধারার একটি মহান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। শহরজুড়ে তখন সাম্যবাদী ভাবনা ভাসছে। বরিসের বাবা ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী। আর মা ছিলেন একজন পিয়ানো-বাদিকা। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বরিস যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন সাদা ক্যানভাসের দিকে। মাত্র কয়েকটা তুলির ছোঁয়ায় সাদা ক্যানভাস পরিণত হতো সূর্যাস্তের রক্তরাগে। ব্যাপারটা সেই সময় অবাক করে দিয়েছিল বালক বরিসকে। বাবা যখন স্টুডিও থেকে বাইরে চলে যেতেন, সেখানে চুপি চুপি ঢুকে পড়তেন বরিস। বাবার আঁকা ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন, দেখতে দেখতে কেটে যেত সময়। কখন বাবা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তিনি বুঝতেই পারতেন না। তাঁর চেতনা ফিরত বাবার সস্নেহ হাতের পরশে।
বাবা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রং-তুলি, এবং বলেছিলেন, একদিন তুমি আমার থেকেও বড় শিল্পী হতে পারবে। বাবার পাশাপাশি, বরিসের মা-ও তাঁর চরিত্র গঠনে নিয়েছিলেন বড় ভূমিকা। মধ্যরাতে বরিস জেগে থাকতেন এবং তাকিয়ে থাকতেন তাঁর পিয়ানোবাদিকা মায়ের দিকে। মোমবাতির আলোতে মায়ের ছায়া তখন কাঁপছে, আর মা পিয়ানোতে হাত রেখে সুর তুলছেন। সেই সুরের মধ্যে যেন লুকিয়ে রয়েছে মানুষের ব্যথা আর যন্ত্রণার স্বরূপ। হাজার হাজার বছর ধরে সেই সমস্ত অবহেলিত, অবদমিত আত্মা, যারা হারিয়ে গিয়েছিল, তারা বুঝি জেগে উঠছে।
ছোটবেলা থেকেই এরকম পরিবেশ পাওয়াতে হয়তো দর্শনের প্রতি একটা ঝোঁক জেগে উঠেছিল বরিসের মনে। স্কুল পাশ করার পরীক্ষায় দর্শন ছিল তাঁর অন্যতম বিষয়। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন কবিতা লেখা। আর এইসব কবিতার মধ্যে জীবনের ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কের ব্যাপারে রয়েছে অনেক বড় বড় কথা। একজন কিশোর হলে কী হবে, জীবন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতোই।
পরিণত বয়সে এসে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বরিস পাস্তেরনাক। তার পাশাপাশি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর লেখা অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ছিল জীবনের শেষ ভাগে এসে লেখা উপন্যাস 'ডক্টর জিভাগো' (১৯৫৭)। এটি রাশিয়ার সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত বইগুলির মধ্যে ছিল একটি। বইটি প্রকাশের পরের বছরই ২৩ অক্টোবর তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে সুইডিশ অ্যাকাডেমি। পুরস্কারের সাইটেশনে লেখা হয়, রুশ গীতিকারদের অবদান এবং রাশিয়ার মহাকাব্যের ঐতিহ্যকে জারি রাখার জন্যই এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বরিস পাস্তেরনাককে।
এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশ খুশি হয়েছিলেন বরিস পাস্তেরনাক। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যথারীতি ২৫ অক্টোবর টেলিগ্রাম করে সুইডিশ অ্যাকাডেমি-কে ধন্যবাদ জানান তিনি। তবে এই পুরস্কারে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার মোটেও খুশি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী স্থায়ী যুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তখন ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে ইউরোপের এবং আমেরিকার অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশগুলোর। সেই পরিস্থিতিতে নোবেল পুরস্কারকে সমাজতান্ত্রিক শাসকরা পুঁজিবাদের প্রকাশ হিসেবে দেখলেন। ফলে ২৫ তারিখে বরিস পাস্তেরনাকের পুরস্কার নেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করল মস্কো সরকার।
'মস্কো লিটারারি সোসাইটি' নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের দাবি তুলে রীতিমতো স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি শুরু করল। রাশিয়াজুড়ে শুরু হলো বরিস পাস্তেরনাক-বিরোধী আন্দোলন এবং প্রচারণা। অতি দ্রুত এবং একপর্যায়ে অতিরিক্ত তিক্ততায় পৌঁছে গেল সেই আন্দোলন। বরিস পাস্তেরনাককে 'রাষ্ট্রদ্রোহী' এবং 'শত্রুর সঙ্গে আঁতাঁতকারী' ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দিতে শুরু করলেন উত্তপ্ত ছাত্র-জনতাসহ সোভিয়েত রাশিয়ার বেশ কিছু বিশিষ্ট নাগরিক। গুঞ্জন রয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকেও নাকি পরোক্ষভাবে তাঁকে জানানো হয়েছিল, যদি তিনি একবার স্টকহোমে গিয়ে পুরস্কার আনতে যান, তাহলে তিনি আর কোনও দিন নিজ দেশে ফিরতে পারবেন না। এই বাস্তবতায় শেষমেশ হার মানলেন এই রুশ লেখক। নোবেল কমিটিকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে অ্যাকাডেমিকে চিঠি লিখতে বাধ্য হলেন তিনি। নোবেল কমিটি বলেছিল, তিনি সমকালীন গীতিধর্মী কবিতা এবং মহান রাশিয়ান এপিকধর্মী গদ্য রচনার ক্ষেত্রে সমান কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তবে রাশিয়ায় সেই সময় লেখনী এবং রাজনীতি ছিল পরস্পরের পরিপন্থী। তাই রাজনীতির কাছে হার মেনে নোবেল প্রত্যাখ্যানে বাধ্য হলেন বরিস পাস্তেরনাক। তবে এটাও সত্যি ছিল, ক্যাপিটালিজমকে কোনও ছাড় দিতে তিনি কখনও রাজি ছিলেন না।
লে দুক তো
১৯৭৩ সালেও এই রকমই একটি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান এর ঘটনা ঘটেছিল। ভিয়েতনামের ক্রান্তিকালে ভিয়েতনামি বিপ্লবী লে দুক তো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকার কথা বিবেচনা করে ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য দু'জনকে মনোনীত করা হয়েছিল। তবে হেনরি কিসিঞ্জার নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করলেও, লে দুক তো রীতিমতো বেঁকে বসেন এবং এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যানের সপক্ষে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ভিয়েতনামে এখনও পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এবং সেই কারণে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি হয়েছিল, তা ছিল স্রেফ একটি লোকদেখানো উদ্যোগ। কেননা, চুক্তির পরেও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বুর্জোয়া প্রেসিডেন্ট নুয়েন ভ্যান থিওকে উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবীদের দমনে সহযোগিতা করে আসছিল। হো চি মিনের নেতৃত্বে লে দুক তো এবং তাঁর সমর্থকরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থা সরিয়ে ১৯৭৫ সালে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠা করেছিল।
ভিয়েতনামের অন্যতম নেতৃস্থানীয় বিপ্লবী নেতা লে দুক তো জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১১ সালে। ১৯৩০ সালের দিকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন তিনি। এরপর ভিয়েতনামে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি কারাবাস করেছিলেন দুই দফায়, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ এবং ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৪৫ সালে হ্যানয়-এ এসে হো টি সিন এবং তা নূয়েন গিরাপের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন ভিয়েতনাম রেভলিউশনারি লিগ। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভিয়েতনামের নেতা ছিলেন লে দুক তো। ভিয়েতনাম ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্য ছিলেন বলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএলএফ। এই সংগঠনের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৪৫ সালে দেশি-বিদেশি প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করে ভিয়েতনাম। তবে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও, ভিয়েতনামে সমস্যা ছিলই। উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে ছিল গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, ১৯৫৫ সালে জন্ম দিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের। দীর্ঘ ২০ বছরের অন্তর্কলহের পর ১৯৭৫ সালে অবশেষে এই যুদ্ধ শেষ হয় এবং প্রতিষ্ঠা হয় সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের। ভিয়েতনামের অন্তর্দ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কারণেই ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কারে মনোনীত করা হয়েছিল লে দুক তো-কে, যে পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর সঙ্গেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।
যদিও, হেনরি কিসিঞ্জারের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি হাস্যকর একটি বিষয় ছিল। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম চরম রূপ ধারণ করেছে, সেই সময় তিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে গিয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন। এমনকী, পাকিস্তানের নির্মম গণহত্যাকে সমর্থন করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশকে নিয়ে বিষোদগার করতে দেখা গিয়েছিল তাকে। স্বাধীনতাস-পরবর্তী বাংলাদেশকে 'বটমলেস বাস্কেট' বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। এইরকম অমানবিক মন্তব্য প্রদানকারী একজন বিতর্কিত রাজনীতিকে শান্তিতে নোবেল প্রদান করার জন্য নোবেল কমিটি ব্যাপক সমালোচিত হয় সারা বিশ্বের কাছে।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী মার্কিন গীতিকবি বব ডিলান প্রথমে পুরস্কার গ্রহণ না করলেও পরবর্তীতে পুরস্কার গ্রহণ করেন।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসের এই তিনটি বিস্ময়কর ঘটনা পুরস্কার আর সেই ব্যক্তির জটিল সম্পর্ককে আরও জটিলভাবে দেখায়। 'মহান কাজের স্বীকৃতি মহান পুরস্কার'- এই ধরনের সহজ, চিরাচরিত সমীকরণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই খাটে না। পাস্তেরনাকের পুরস্কার নিয়ে দেশ, সরকার বা গোষ্ঠীর অস্বস্তি এবং ক্ষোভ প্রমাণ করে পুরস্কারের রং অনেক সময় হয়ে থাকে রাজনৈতিক। আবার সার্ত্রে কিংবা লে দুক তো-র উদাহরণ প্রমাণ করে, পুরস্কার গ্রহণকারীর ইচ্ছা এবং অনিচ্ছার গুরুত্ব কিন্তু প্রবল। হয়তো তিনজন তিনটি আলাদা কারণে প্রত্যাখ্যান করেছেন নোবেল পুরস্কার। হয়তো সার্ত্রে বা লে দুক তো নিজের ব্যক্তিগত মতামতকে আসলে বৈশ্বিক প্রতিবাদ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও পুরস্কার গ্রহণে অনীহার এই উদাহরণ মূলত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠান ও সমাজের স্বীকৃতির থেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এক অপূর্ব মহিমায়। এর ফলে পুরস্কারের গুরুত্ব হারায় না কোনওভাবেই, তবে ব্যক্তিস্বকীয়তার গুরুত্ব অবশ্যই বাড়ে বইকি।
পুরস্কার গ্রহণ এবং বর্জনের এই দ্বন্দ্বমূলক আলোচনা অবশ্যই জন্ম দিল একটি বড় প্রশ্নের, পুরস্কার বর্জন করা মানেই কি শুধুমাত্র প্রতিবাদ? না কি অনেক সময় পুরস্কার গ্রহণের থেকে বর্জনে সম্মান বা খ্যাতি বৃদ্ধি পায়? উত্তর যাই হোক না কেন, নোবেল পুরস্কার গ্রহণের থেকে বর্জনের ইতিহাস অনেক ক্ষুদ্র। হয়তো সেই কারণেই সাধারণ মানুষ এবং পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এই বর্জনকারী ব্যক্তিকে মনে রাখতে বাধ্য হয়।