তাঁরা নোবেল হারাননি, নোবেলই হারিয়েছে তাঁদের! উল্টোস্রোতের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা
Nobel Prize 2022: জঁ পল সার্ত্রে বলেছিলেন, মূলত পশ্চিমের ও পূর্বের সমাজতন্ত্রবিরোধী লেখকদের জন্য এই পুরস্কার নির্ধারিত।
পুরস্কার এক বিষম বস্তু; বিশেষত যদি তা সাহিত্য বা শিল্পের কোনও মাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। প্রথম কথাই হলো, একজন শিল্পী বা সাহিত্যিক পুরস্কার পাওয়ার জন্য সৃষ্টি করেন না। দ্বিতীয়ত, শিল্পের কোনও প্রতিযোগিতাও সম্ভবপর নয়। তথাপি প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দেয় (তা সরকারি বা বেসরকারি, যা-ই হোক না কেন)।পুরস্কার দেয় তার আধিপত্য বজায় রাখতে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আবিশ্ব প্রাতিষ্ঠানিকতার ভারসাম্য-রক্ষার্থেই সম্ভবত 'পুরস্কার'-এর সূচনা।শেক্সপিয়র না কালিদাস, দস্তয়েভস্কি না টলস্টয়, হেমিংওয়ে না কামু- লেখক হিসেবে কে বড় কে ছোট, কে প্রথম কে দ্বিতীয়- তা কে ঠিক করবে? আদৌ কি তা বলা যায়! আসলে ভিন্ন প্রকরণ, আলাদা আলাদা শৈলি ও আঙ্গিকে কেউ শিক্ষক, কেউ দার্শনিক, তাও আবার ব্যক্তিবিশেষে তা পাল্টে যায়। এখানে কোনও প্রতিযোগিতা নেই।
লুইস ফর্দিনান্দ সেলিন থেকে ফ্রানৎস কাফকার মতো লেখকরা আজীবন লিখে গেলেও তাঁদের বই প্রকাশ করতে সম্মত হননি নির্ভার রুচি-উজ্জ্বল এক ব্রত শুদ্ধতায়। এই কারণেই তা উল্লেখ করছি যে, শিল্প (সাহিত্য রচনা) সৃষ্টিকে তাঁরা ব্যক্তিক পরিসরে মনোসংগঠনের চর্চা হিসেবেই দেখেছেন, যেখানে নাম, যশ, খ্যাতির বালাই ছিল না। তবে হ্যাঁ, এঁরা সব সময়েই শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী লেখক। কিন্তু স্মৃতিস্পন্দিত নিরাভরণ আত্ম-দার্শনিক। পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে খ্যাতি ও প্রচার-বিদ্বেষী বিস্ময়কর গৌরবও বটে।
আসলে এতটা গৌরচন্দ্রিকার অবতারণার কারণ হলো, অধুনা আলোচ্য (প্রচারমাধ্যমে) নোবেল পুরস্কার নিয়ে দুটো-চারটে কথা লেখালিখি। যা নিয়ে স্বল্প পরিসরে আমার এই নিবন্ধের আয়োজন। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে পৃথিবীজুড়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা ঘুরেফিরে আসে। সম্ভাব্য প্রাপকের নাম, কে এগিয়ে আর কে পিছিয়ে। একশো কুড়ি বছরের বেশি অতিক্রান্ত। এমন একটা ভাব, যেন বছর-প্রতি এই একজন নোবেল প্রাপকই বিশ্বসেরা, সাহিত্যের শেষ কথা। অথচ এমন অনেকানেক লেখক আছেন, যাঁদের কথা মনেই পড়েনি সুইডিশ অ্যাকাডেমির। তাতে অবশ্য ইতরবিশেষ কিছু ঘটেনি। যাঁরা পাননি, তাঁরা বহাল রয়েছেন- পাঠকের মনে, রাজ করছেন বিশ্বসাহিত্য।
আরও পড়ুন: ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান’ হয়ে রয়ে গেলেন, যে সুব্রত মিত্রকে চিনল না বাঙালি
প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই এই পুরস্কারের নিয়ন্তা বড় ভাইয়ের রাজনীতি। ঠান্ডা লড়াইয়ে নোবেল কে পাবে আর কেন পাবে, তা সূচিত হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর নজর দিয়ে। লেখা বাহুল্য, মার্কিনিরা এখানে সব সময়ই অগ্রগণ্য। যাঁরা সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের যেমন পুরস্কৃত করা হয়েছে, তেমনই প্রতিবাদী লেখকের যাবতীয় আক্রমণকে প্রতিহত করতে, খর্ব করতে তাঁদেরও শামিল করা হয়েছে। এরা সলঝেনিৎসিনের মতো দ্বিতীয় সারির লেখককে খুঁজে পেয়েছে কিন্তু মায়াকোভস্কির নামোচ্চারণ করেনি। আবার পাস্তেরনাকের মতো প্রথম সারির চিন্তককে নির্বাচিত করেছে রুশ বিরোধিতার জন্য। যদিও পাস্তেরনাক প্রত্যাখ্যান করেন। সেও এক রুশি ঢালাওতন্ত্রের অন্য গল্প। পড়েছি যে, ওঁকে রুশ প্রশাসন বাধ্য করে এরকম সাম্রাজ্যবাদী পুরস্কার না নেওয়ার জন্য।
হ্যাঁ, নেরুদা থেকে মার্কেজকে পুরস্কৃত করা হয়েছে স্পেন থেকে লাতিন আমেরিকার লাগাতার সর্বব্যাপী গৃহযুদ্ধ, আন্দোলনকে নিষ্প্রভ করার জন্য, লঘু করার জন্য। কাজেই এই অভিযোগ বারে বারেই উঠেছে, বিশেষত বিংশ শতকে, যে নোবেল কমিটি বেছে নিয়েছে মধ্যমেধার সাহিত্যিকদের। তারপরে বলতে হবে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের কথা। তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষ করে আফ্রিকার, ভারতীয় উপমহাদেশের লেখকেরা এখনও কোনও কল্কে পান না, তাঁদের পিছনে ঠেলা হয়। সেখানে অকারণ যুক্তি দেওয়া হয় যে, তাঁদের সৃষ্টিকর্ম ইংরেজিতে যথেষ্ট অনূদিত নয়। যা প্রকৃতই আংশিক সত্য। অনুবাদের সমস্যার মূল অনেক গভীরে, অনুবাদ সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত সবাই সেকথা স্বীকার করবেন। এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে প্রথিতযশা আফ্রিকান সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে-র কথা। নাইজেরিয়ান এই কবি, সমালোচক ও কথাসাহিত্যিক আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের এক অনন্য মাইলফলক। তাঁকে এই নোবেল কমিটি সম্পূর্ণতই অগ্রাহ্য করেছে। এখানে কিন্তু অনুবাদের দোহাই ধোপে টেকে না।
এই ধারা কিন্তু এই শতকেও জারি আছে। এই কিছুদিন আগেই ২০১৮ সালে নোবেল কমিটির এক সদস্য ও তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে যৌন অপরাধ, আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত অপরাধ ও গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ উঠেছিল। তার অভিঘাতে গোটা কমিটির টালমাটাল অবস্থা হয়েছিল। সেই সময়ের কমিটির সভাপতি অ্যান্ডারস ওলসন পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপকেন্দ্রিকতা ও পিতৃতান্ত্রিকতার অভিযোগ স্বীকার করে নেন।
তো যাই হোক, এই নিবন্ধ শেষ করব অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ও লেখক জাঁ পল সার্ত্রেকে দিয়ে। আমরণ বামপন্থী সার্ত্রেকে নোবেল কমিটি ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করে। সার্ত্রে সপাট সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যে লেখক, তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক তথা সামাজিক এবং সুনির্দিষ্ট সাহিত্যিক অবস্থান রয়েছে, তাঁর উচিত নিজের সামর্থ ও অর্থে লিখিত শব্দের শক্তি দিয়ে লিখে যাওয়া। পুরস্কৃত হওয়ার ফলে লেখকের ওপর এক প্রাতিষ্ঠানিক চাপ সৃষ্টি হয়। যা কখনওই কোনও লেখকের ক্ষেত্রে কাম্য নয়।
তিনি আরও বলেন, মূলত পশ্চিমের ও পূর্বের সমাজতন্ত্রবিরোধী লেখকদের জন্য এই পুরস্কার নির্ধারিত। 'এ রাইটার শুড নট অ্যালাও হিমসেলফ টু বি টার্নড ইনটু অ্যান ইনস্টিটিউশন।'
এই হলো গিয়ে মোদ্দা কথা।