হিন্দু তান্ত্রিকের শিষ্য হয়েছিলেন খ্রিস্টান বিচারক, ইউরোপে ঝড় তুলেছিল তন্ত্রসাধনা
Tantra of Bengal: শিবচন্দ্র উডরফের মধ্যে তন্ত্রসাধনার উপযুক্ত লক্ষণগুলি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি উডরফকে তন্ত্রমতে দীক্ষা দেন।
এক হিন্দু তান্ত্রিকের কথা বলা হবে আজ, তিনি কুমারখালির প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব (১৮৬০-১৯১৩), যিনি ভারতের আধ্যাত্মিক আকাশের নক্ষত্র মহাসাধক হিসেবে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন। যে খ্রিস্টান শিষ্য ও বিচারকের কথা বলা হচ্ছে, তিনি স্যর জন উডরফ (১৮৬৫-১৯৩৬)।
নদিয়া জেলার কুমারখালি গ্রামের শাস্ত্রজ্ঞানী গোঁড়া ভট্টাচার্য পরিবারে শিবচন্দ্রর জন্ম। সনাতন গোস্বামী, পাগল হরনাথ ইত্যাদি সিদ্ধ-সাধকদের বাস ছিল ওই গ্রামে। চারদিকের দু'-দশটা গ্রাম থেকে এখানে মানুষ শাস্ত্রপাঠ নেওয়ার জন্য আসত। প্রসঙ্গত, কুমারখালির পাশের গ্রাম ভাঁড়ারাতে থাকতেন লালন ফকির। শিবচন্দ্রের বাবা চন্দ্রকুমার তর্কবাগীশ ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ। তাঁর বাড়িতে কখনও অশাস্ত্রীয় আচারকে প্রশ্রয় দেননি, ছোটবেলা থেকেই শিবচন্দ্রকেও এসব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। এ-প্রসঙ্গে শিবচন্দ্রের ছোট বয়সের একটা ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্যিক-সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথের কাছে হাতেখড়ি হওয়ার পর পাঁচ বছর বয়সে শিবচন্দ্র কাঙালেরই প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি হলেন। সেখানে বিভিন্ন মনীষীদের জীবন সম্পর্কে পাঠ দেওয়া হতো। একদিন শিবচন্দ্রের বাবা দেখলেন তার ছেলে বাড়িতে বসে বিদেশি এক মনীষীর জীবনী পড়ছে, সম্ভবত তার নাম ডুবাল। চন্দ্রকুমার ভীষণ রেগে গিয়ে ছেলের হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এই ডুবাল-ই দেশটাকে ডোবাবে, কেন এ দেশে কি মহাপুরুষ নেই?' সেই দিন থেকেই শিবচন্দ্রের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, শেষ হয়ে গেল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষালাভের আশা-আকাঙ্ক্ষা। পরের দিন চন্দ্রকুমার ছেলেকে নবদ্বীপের এক টোলে ভর্তি করে দিলেন। সেখানেই নিজের মেধা ও অধ্যাবসায়ের জোরে অল্প দিনের মধ্যেই ব্যাকরণ-সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন শিবচন্দ্র।
আরও পড়ুন: কেউ বলে বোহেমিয়ান, কেউ বলে মদ্যপ! আড়ালে আছেন অন্য এক শক্তি
খুব অল্প বয়সেই পণ্ডিতচূড়ামণি হর ভট্টাচার্যর শিক্ষাসম্মেলন থেকে শিবচন্দ্র ‘কবিরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হলেন। দেশের নামী পণ্ডিতসমাজ সম্পূর্ণ একমত হয়ে তাঁকে ‘কবিরত্ন’ বলে স্বীকার করে নিলেন। তাঁর মেধা ও পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে সম্মেলনে উপস্থিত অধ্যাপকরা একযোগে প্রস্তাব করলেন, শিবচন্দ্রকে সংস্কৃত কলেজে পড়ার সুযোগ দেওয়া হোক। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়াটা খুব গৌরবের হলেও তাঁর রক্ষণশীল বাবা পণ্ডিতদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন না, কারণ সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শিক্ষার ছোঁয়া রয়েছে। তার মতে ইংরেজি শিক্ষা শাস্ত্রবিরোধী, এই শিক্ষা একজন ছাত্রকে প্রকৃত অধ্যয়নের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে, ফলে সে যাত্রায় শিবচন্দ্রের আর সংস্কৃত কলেজে পড়া হলো না।
সুতরাং, উপযুক্ত মেধা ও অধ্যবসায় থাকা সত্ত্বেও বাবার প্রবল আপত্তিতে কবিরত্ন শিবচন্দ্রের সংস্কৃত কলেজে যাওয়া হল না, ফলে নবদ্বীপের টোলে পড়াশুনা করে তিনি দর্শনশাস্ত্র, ব্যাকরণ, সাহিত্য ও স্মৃতিশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। এই সময়ের একটি ঘটনা বাংলার পণ্ডিতসমাজে আলোড়ন ফেলেছিল।
টোলের পড়াশোনা শেষ করে শিবচন্দ্র কলকাতায় ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভের কঠিন পরীক্ষায় বসলেন। সেখানে তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ তো হলেনই সঙ্গে এই পরীক্ষায় আগের পাওয়া সব নম্বরকে পেরিয়ে গেলেন, অর্থাৎ তিনি এই পরীক্ষায় সর্বকালের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত হলেন কিন্তু এরপরেই সমস্যা শুরু হলো। এত কষ্ট করে পাওয়া ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি তিনি গ্রহণ করলেন না। সকলের সামনে তিনি বললেন, ‘আমার গুরু স্থানীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় বেঁচে থাকতে আমার পক্ষে নামের আগে বিদ্যাসাগর শব্দটা বসানো সমীচীন হবে না। আমার মনে হয়, এতে তাঁর অসম্মান হবে। কাজেই সবিনয়ে এই উপাধি আমি বর্জন করলাম।'
উপস্থিত পণ্ডিতরা খুব মুশকিলে পড়লেন। এই অবস্থায় তারা কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারলেন না। এই উপাধি তো যে কাউকে ডেকে দেওয়া হয় না। উপযুক্ত মেধা এবং অধ্যবসায়ের জোরে এই উপাধি অর্জন করতে হয়। শিবচন্দ্র সেটা পেরেছেন এবং যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গেই বিদ্যাসাগর উপাধি অর্জন করেছেন। এখন তিনি যদি এই উপাধি না নেন, তাহলে এতদিনের একটা নিয়মে ছেদ পড়বে। পণ্ডিতরা আলোচনা করে একটা সমাধান বের করলেন। তাঁরা শিবচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’-এর বদলে ‘বিদ্যার্ণব’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। সেই দিন থেকে শিবচন্দ্র ভট্টাচার্য হলেন শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব।
এরপর কুলপ্রথানুসারে দীক্ষাগ্রহণ করে তিনি ভারতের বিভিন্ন তীর্থভ্রমণ করে হিমালয়ে চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন সাধনা করার পর তিনি গির্নারের এক গুহায় কয়েক বছর সাধনা করে আত্মকাম ও সিদ্ধ হয়ে বারাণসীতে ফিরে এলেন। ততদিনে তিনি ভারতের সাধকমহলে সিদ্ধতান্ত্রিক বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বারাণসীতে সন্ন্যাসী রামরাম স্বামীর কাছে বেদান্তশাস্ত্রের পাঠ নিয়ে পরবর্তী সাধনা করতে চলে যান তিব্বতের কৈলাস ও মানস সরোবরে। এরপর ফিরে আসেন নিজের গ্রাম কুমারখালিতে। এই সময় তন্ত্রতত্ত্ব প্রচারের জন্য দুই খণ্ডে ‘তন্ত্রতত্ত্ব’ নামে আকর গ্রন্থটি লেখেন। গ্রন্থটি এখন দুই খণ্ডে একত্রে (প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠা) পাওয়া যায়। সাধনপীঠ বিষয়ে তাঁর ‘পীঠমালা’ গ্রন্থটিও সাধনমার্গের মানুষের কাছে আদরণীয়।
বারাণসী থেকে ফিরে এসে সাধক শিবচন্দ্র সেই সময় বাংলায় এক অভিনব দুর্গা পূজার প্রচলন করলেন। বাংলার মানুষ তখন এমন দুর্গা পূজা দেখেনি। তিনি দেবীর পাঁচটি রূপকে একসঙ্গে এনে পঞ্চদুর্গার আরাধনা করলেন, বাংলায় সেটাই সম্ভবত প্রথম পঞ্চদুর্গা পুজা। শিবচন্দ্রের সেই পঞ্চদুর্গার মূর্তিতে ছিল, সিংহবাহিনী দুর্গা, অকালবোধনের দুর্গা, দশপ্রহরণধারিণী দেবী দুর্গা, শ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত দেবী দুর্গা এবং চৌষট্টি যোগিনী ও দশমহাবিদ্যাবেষ্টিতা মহাচণ্ডী। আজ আমরা বাড়িতে ও বারোয়ারিতে দুর্গার যে মূর্তি পুজো করি, সেই দুর্গার রূপটি দিয়েছিলেন তিনি।
এইবার স্যার জন উডরফের কথা। উডরফ ছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি। কিন্তু বাংলা ও ইউরোপের ইতিহাসে তিনি খ্যাত সম্পূর্ণ অন্যকারণে। এই ব্রিটিশ আইনজ্ঞ ছিলেন তন্ত্রসাধক, বাংলার তন্ত্র সাধনা ও দর্শনকে ইউরোপের সঙ্গে পরিচয় করানোর কাজটি তিনিই করেছিলেন। তাঁর বাবা জেমস উডরফ ছিলেন বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৮৯৯-১৯০৪)। তাঁর মা ফ্লোরেন্স হিউম ছিলেন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের ভাইঝি।
স্যার উডরফের সঙ্গে শিবচন্দ্রের আলাপ হয় হাই কোর্টে। উডরফ তখন হাই কোর্টের বিচারপতি। ভারতের অধ্যাত্ম ও তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে তাঁর কৌতূহল ছিল। সেই সময় হাই কোর্টের সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ ছিলেন হরিদেব শাস্ত্রী। উডরফ তাঁর কাছে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন এবং ভারতের তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। একই সঙ্গে সেই সময় হাই কোর্টের প্রবীন উকিল অটলবিহারী ঘোষের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। অটলবিহারী দীর্ঘদিন তন্ত্রসাধনা করতেন এবং তিনি ‘আগম অনুসন্ধান সমিতি’-র সদস্য। তাঁর সঙ্গেও উডরফ তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতেন। সবকিছু সঠিকভাবে এগোলেও তিনি একজন প্রকৃত গুরুর সন্ধান করছিলেন, যিনি তাঁকে তন্ত্রশাস্ত্র সম্পর্কে পাঠ দিতে পারবেন।
সেই সময়, হাই কোর্টে তাঁর এজলাসে একটি মামলায় তন্ত্রশাস্ত্রের কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবকে নিয়ে আসা হয়। তখন হরিদেব শাস্ত্রী তাঁকে বলেন, ‘আপনি যে গুরুর সন্ধান করছিলেন তিনি এসে গিয়েছেন। আপনি নিজেকে তাঁর কাছে সমর্পণ করুন।'
হাই কোর্টেই শিবচন্দ্র ও স্যর জন উডরফের সাক্ষাৎ। শিবচন্দ্র উডরফের মধ্যে তন্ত্রসাধনার উপযুক্ত লক্ষণগুলি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি উডরফকে তন্ত্রমতে দীক্ষা দেন। কিন্তু উডরফের মনে সন্দেহ ছিল, যে, শিবচন্দ্রই তাঁর প্রকৃত গুরু কি না। তখন শিবচন্দ্র বলেন, যে, উডরফের উচিত প্রকৃত গুরুর সন্ধান করা। এরপর উডরফ চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রকৃত গুরুর সন্ধানে, সঙ্গী হরিদেব শাস্ত্রী। হৃষিকেশ, হরিদ্বার, গুপ্তকাশী, হিমালয় ও বারাণসী ভ্রমণ করে, বিভিন্ন মার্গের সাধক ও বৌদ্ধতান্ত্রিকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, সকলেই জানান শিবচন্দ্রই তাঁর প্রকৃত গুরু। এরপর উডরফ জয়কালী দেবী নামে এক ভৈরবীর সঙ্গে দীর্ঘদিন তন্ত্রের দেহতত্ত্বের সাধনা করেন।
১৯১৩ সাল থেকে বন্ধু ও তন্ত্রসাধক অটলবিহারী ঘোষের সাহায্যে ‘আর্থার অ্যাভালন’ (অনেকে মনে করেন এটি দুই বন্ধুর যৌথ ছদ্মনাম) শিবচন্দ্রর ‘তন্ত্রশাস্ত্র’ গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেন। ১৯১৫ সালে নাইট উপাধি পেয়ে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি ফ্রান্সে চলে যান। জীবনের শেষ ক'টা বছর তন্ত্র-সংক্রান্ত গবেষণা, অনুবাদ ও তন্ত্রগ্রন্থের সম্পাদনায় কাটিয়ে দেন। আরেকটি অদ্ভুত সমাপতন, ১৯৩৬ সালের ১২ জানুয়ারি অটলবিহারী প্রয়াত হন আর ১৬ জানুয়ারি উডরফ প্রয়াত হন।
পরবর্তীকালে যাঁদের যুগলবন্দিতে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, শিবচন্দ্র ও উডরফ-এর যৌথ প্রয়াস, সেই শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিবেকানন্দ যেভাবে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণর অধ্যাত্মবাদকে জগতের সামনে উপস্থাপিত করেন, ঠিক সেভাবেই উডরফ তাঁর গুরু শিবচন্দ্রের তন্ত্রতত্ত্বকে পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করে দেন। রহস্যে ঘেরা তন্ত্রশাস্ত্রের প্রতি বিশ্বের শিক্ষিত সমাজে যে ভীতি ও অবজ্ঞা ছিল, সেটা উডরফের প্রচেষ্টায় অনেকটাই দূর হয়।