ফরাসি মদ থেকে চোলাই বা ঝলমলে নিষিদ্ধপল্লি! চন্দননগরের অজানা রঙিন ইতিহাস
Noirajyer Neel Opera: চন্দননগরের নিম্নবর্গের কালচার বা ইতর সংস্কৃতির ইতিহাস যথেষ্ট শক্তিশালী।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘কোতরং’ নামে একটি ছড়া আছে, কলেজে পড়ার সময় সেটা হাতে এসেছিল, ‘হাঁসের প্রিয় গুগলি/ পোর্তুগিজের হুগলি/ গুণীর প্রিয় তানপুরা/ ওলন্দাজের চিনসুরা/ চোরের প্রিয় আঁধার ঘর/ ফরাসিদের চন্নগর’... বাকিটা ভুলে গিয়েছি। অন্নদাশঙ্কর এই যে চন্দননগরকে 'চন্নগর' বললেন, আমি স্কুলে পড়তে এখানকার পুরনো বাসিন্দাদের 'চন্নগর' বলতে শুনেছি। আর একটা ব্যাপার আমার মনে ধরেছিল যে, ছন্দ মেলাতে উনি লিখলেন ‘চোরের প্রিয় আঁধার ঘর’… এটাই আমাকে চন্দননগরের নিম্নবর্গের কালচারের খোঁজে প্ররোচনা দিয়েছিল, কেননা চোর, নিম্নবর্গের মানুষ আর তার পিছনে যারা আসে, তারা হলো নেশা, বেশ্যা, নাচ, গান।
'চন্দননগর' নামের উত্পত্তি নিয়ে নানারকম মত আছে। সেসব নিয়ে বিদ্বজনরা লিখেছেন, তার একটি মত হলো, এখানে গঙ্গার ঘাটের কাছে (এখন শ্মশানে যাবার রাস্তা) চণ্ডীর পুজো হতো, এখনও সে মন্দির আছে, অঞ্চলটির নাম বোড়াই চণ্ডীতলা। ওই ঘাট সেই সময় অন্যতম বাণিজ্য-পথ ছিল। তাই লোকমুখে 'চণ্ডীরনগর' বা ফরাসিতে 'চাণ্ডেরনাগোর' হয়ে থাকতে পারে। আমার কাছে এই মতটি গ্রহণযোগ্য। আরেকটি নাম ফরাসডাঙা, তবে সেটি সমগ্র চন্দননগরকে বোঝাত না, শুধুমাত্র ফরাসিদের বাসস্থানের অঞ্চলটিকে বলা হতো।
বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসের অধ্যাপক। চন্দননগরের স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে আসছেন। তাঁর কাছে আমি একজন বখাটে উৎসাহী হিসেবে জানতে চেয়েছি চন্দননগরের নিম্নবর্গের কালচার বা ইতর সংস্কৃতির ইতিহাস।
আরও পড়ুন: তিন হাজার গান! কোনও কপিরাইট রাখেননি নজরুল
আঠারো শতকের বাংলার কবিয়াল বা দাঁড়াকবিদের মধ্যে চন্দননগরের নিত্যানন্দ বা নিতে বৈরাগী, রাসু– নৃসিংহ দুই ভাই এবং অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন বিখ্যাত। এঁরা ছাড়া নীলমণি, বলরাম, ভবানী কবিয়ালরাও জনপ্রিয় ছিলেন- এঁরা মূলত নিম্নবর্গের মানুষ ছিলেন। কিন্তু এঁদের নাম আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে দিয়েছে লর্ড মেকলের ঔপনিবেশিক শিক্ষা আর লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আমরা ভুলে গেছি আমাদের সাহিত্যের অন্য স্বরগুলো, আমরা হারিয়ে ফেলেছি বাংলার কাউন্টারকালচার সাহিত্যের টেক্সট। আমাদের স্মৃতি বিপর্যয় ঘটে গেছে, ঔপনিবেশিক শাসক তাঁর নিজের সাহিত্যের টেক্সট আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে দিয়েছে। তাই ইংলন্ডের জনৈক ছুতোর কবি উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা পড়া আমাদের কাছে গর্বের বিষয়, কিন্তু রাসু বা নিতে বৈরাগীর কবিতা পড়ার কথা আমরা ভাবতে পারি না । এইসব কবিয়ালরা যে ভাষায় কবিতা লিখতেন বা তত্ক্ষণাত শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে যে ভাবে কবিতা রচনা করতেন তা এক কথায় বৈপ্লবিক সাহিত্য । দাঁড়িয়ে কবিতা বলতেন বলে এঁদের দাঁড়াকবি বলা হত। আজকে যারা বাংলায় র্যাপ করে তাদের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ে এই দাঁড়াকবিদের কথা, আজকের বাংলা র্যাপাররা হলো সেই সময়ের দাঁড়াকবিদের প্রকৃত উত্তরাধিকার।
এরপরে বলতে হয় চন্দননগরের পাঁচালিকারদের কথা। এতে গান, বাজনা, ছড়া কাটা, গানের লড়াই ও নাচ এই পঞ্চাঙ্গের সমাবেশ ঘটে বলে একে পাঁচালি বলা হয়। এই পাঁচালি আঠারো শতকের বাংলায় খুবই জনপ্রিয় মনোরঞ্জনের একটি মাধ্যম ছিল। চন্দননগরের পাঁচালিকারদের মধ্যে চিন্তামণি বা চিন্তেমালা, রামভাট, ঢ্যামনা গোপাল এঁরা ছিলেন বিখ্যাত। মেয়ে পাঁচালি সম্ভবত চন্দননগরেই প্রথম চালু করেন আনন্দমোহিনী বা আন্দি, এরপর এই মেয়ে পাঁচালি বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
উনিশ শতকে পাঁচালি নতুন ফর্ম নেয়। পাঁচালির কনটেন্টে যুক্ত হল সংলাপ, আরও চরিত্র, আরও ঘটনা, জন্ম হল একটি নতুন শিল্পের, যার নাম যাত্রা। চন্দননগরে সে আমলে বিখ্যাত যাত্রাপালাকাররা হলেন গুরুপ্রসাদ বল্লভ, এঁর চণ্ডীযাত্রা বিখ্যাত ছিল, এছাড়া মদন মাস্টার, নবীন মাস্টার এঁরা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তবে মদন মাস্টারের পুত্রবধূ বউ মাস্টারও পালাকার হিসেবে এতটাই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, যে তার নামে ‘বউ মাস্টার লেন’ নামে একটি রাস্তা আছে, উত্তর চন্দননগরে।
এরপর আসে নেশা। চন্দননগরে ফরাসি মদ, দিশি মদ অর্থাৎ, চোলাই মদ আর আফিম এই তিন ধরনের নেশার চল ছিল, বলা বাহুল্য, এগুলির উত্পাদনও এখানে হোত। 'বোসা' নামে একটি ফরাসি মদ খুবই জনপ্রিয় ছিল, আরও ফরাসি মদ নিশ্চয় ছিল, কিন্তু নাম পাইনি। চোলাই মদ তৈরিতে চন্দননগরের খ্যাতি সেই ফরাসি আমল থেকেই। চাঁপাকলা দিয়ে তৈরি চোলাই মদ আমি কলেজে পড়ার সময় চেখেছি, এছাড়া ভাত ও অন্যান্য বস্তু থেকে চোলাই মদ তৈরি হতো। এছাড়া ফরাসিরা আফিমের চাষ করত। একটি পুরোনো দলিলে দেখা গেছে ১৯২৩ সালে ফরাসি সরকার ব্রিটিশদের শুধু আফিম বেচে ২৮, ৪০৮ টাকা পেয়েছে এবং আবগারি শুল্কবাবদ পেয়েছে ৪,৩৯,০০০ টাকা। ইতিহাসবিদরা বলেন, ভারতের ফরাসি কলোনির মধ্যে আফিম উত্পাদনে চন্দননগর ছিলো প্রথম। ইংরেজ-ফরাসি জাতশত্রু হলেও কলকাতা বন্দর থেকে একসঙ্গে চিনে আফিম যেত।
চন্দননগরে বেশ কয়েকটি জুয়ার আড্ডা, শুঁড়িখানা ও গুলির আড্ডা ছিল, যারা সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই ব্যবসা চালাত। মধ্য চন্দননগরে বাগবাজার ও জিটি রোডের সংযোগস্থলের নাম ‘দিনু শুঁড়ির মোড়’ সেখানে একসময় বড় শুঁড়িখানা ছিল। দক্ষিণ চন্দননগরে একটি রাস্তার মোড়ের নাম ‘বারাসাত গুলির আড্ডার মোড়’, মানে এককালে সেখানে গুলির আড্ডা ছিল। গুলির বিষয়টা একটু বলি। পপি গাছের কাঁচা ফলের খোসা কাটলে যে সাদা রস পাওয়া যায় তা ২৪ ঘণ্টা রোদে শুকালে পাওয়া যায় আফিম, এটা কাঁচা আফিম। এর রং তখন হয়ে যায় কালো বা কালচে বেগুনী। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ১ কেজি আফিমের দাম ১৫ লক্ষ টাকা। এই আফিমকে পাকা করে তৈরি হয় গুলি।
সব শেষে বেশ্যাদের কথা। তার আগে বলতে হয় ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত কলকাতার বটতলার একটি ছোট প্রহসনের কথা, প্রাণকৃষ্ণ দত্তর লেখা ‘বদমায়েস জব্দ’। ১৮৬৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতায় কন্টাজিয়াস ডিজিজ অ্যাক্ট ফোর্টিন জারি করে, লোকমুখে যা চোদ্দো আইন নামে খ্যাত বা কুখ্যাত হয়। এই আইন ও তার প্রেক্ষিতটি অনেক বড়, সংক্ষেপে বলা যায় সোনাগাছির গরিব বেশ্যাদের সিফিলিস আছে কি না, তার বাধ্যতামূলক পরীক্ষার আইন। ব্রিটিশদের এই আইনের হাত থেকে বাঁচতে অনেক বেশ্যা তাদের দালাল-সহ ফরাসিদের শাসিত চন্দননগরে চলে আসে, যেখানে ব্রিটিশ আইন কার্যকর নয়। তারা পালিয়ে গেল জলপথে নৌকোয় বা রেলপথে। অবশ্য ১৮৮৮ সালে এই আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
প্রাণকৃষ্ণ দত্ত তাঁর 'বদমায়েস জব্দ’ বইতে লিখছেন,
সোনাগাছির প্রায় সকল বেশ্যালয়ই খালি পড়িয়া আছে, চন্দননগর গুলজার হইয়া উঠিল। যে বাড়িটার দশটাকা ভাড়া সে বাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ টাকা ছাড়ালো, কলিকাতার বেশ্যালয়ের বাড়িওলারা মাথায় হাত দিয়া কাঁদিতে লাগিল। চন্দননগরের বদ্মাএসদের দ্বিগুনতর বদ্মায়েসি বেড়ে উঠলো।
এবার আমরা চন্দননগরের বেশ্যাদের ইতিহাসটা একটু দেখে নেব। চন্দননগরে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের কাছে খেজুরতলা বা গঙ্গার ধারে হাটখোলা অঞ্চলে সবচেয়ে পুরোনো বারাঙ্গনা পল্লি ছিল। এই দু'টির কোনওটিই এখন নেই। ১৯৮৭/১৯৮৮ সালে খেজুরতলার বেশ্যাপল্লিটি উঠে যায়। ১৬৯৬ সালে ফরাসি দুর্গ তৈরির পরে পরে বিদ্রোহী শোভা সিং বর্ধমান দখল করে লুটপাট আরম্ত করলে বহু পরিবার এসে জড়ো হয় চন্দননগরে। তার মধ্যে নানা বৃত্তিজীবী, নিম্নবর্গের মানুষরাও ছিলেন। আর ছিল ফরাসি কেল্লার বহু সৈন্য, যাদের বেশিরভাগই দক্ষিণ ভারতীয়। ঘর ছাড়া এইসব মানুষের প্রয়োজনে খেজুরতলা বেশ্যাবসতি গড়ে ওঠে অষ্টাদশ শতকে। এইসব বারবনিতাদের খদ্দের ছিল মুলত পরিবার বিচ্ছিন্ন পুরুষ, সৈন্য, ফরাসি কর্মচারী এবং বহিরাগত ব্যবসায়ীর দল। উনিশ ও বিশ শতকে কলকাতার বহু মানুষ এইসব বারবনিতাদের কাছে আসতেন। কলকাতায় চোদ্দ আইন জারি হওয়ার পর যেসব প্রহসন প্রকাশিত হয়েছিল, তার মধ্যে অঘোরচন্দ্র ঘোষের পাঁচালি কমলকলি উল্লেখযোগ্য ।সেখানে বর্ণনা আছে চন্দননগরের বেশ্যারা কীভাবে দিনযাপন করেছিল-
গৌরাঙ্গ স্মরণ করে সিকায় তুলে ঝুলি।
রাঁড়ের বাড়ি উকিঝুঁকি মাচ্ছে কুলিকুলি॥
এক্ষণেতে নব্যবাবু আছেন তথা যারা।
দিব্য করে চুল ফিরায়ে বাহার দিয়ে তারা॥
পকেটে ফেলে পাঁচ পয়সা চুরুট গুঁজে মুখে।
রাঁড়ের বাড়ি এয়ারকিটি মাচ্ছে মনোসুখে॥
আট পয়সার মজুর যারা খাজুর চাটায় থাকে।
খাট পালঙ্কে খাসা বিছানায় শুচ্ছে লাখে লাখে॥
ভাই সাহেবরা কামিয়ে দাড়ি রাঁড়ের বাড়ি যায়।
হেঁদু বলে হোল নাইট নির্বিঘ্নে কাটায়॥
নায়ের মাঝি যারা তারা শুনে গুজব কথা ।
আল্লা রসুর স্মরণ করে নোঙর কচ্ছে তথা॥
বলে, হালা হর রোজ কি বেয়ে মরবো লা।
হরেশডাঙায় হ্যাকটা আত কাবার করে যা॥
এই কবিতাটিতে যা বলা হয়েছে তা হলো, বৈষ্ণবরা গৌরাঙ্গ স্মরণ করে সিকায় ঝুলি তুলে বেশ্যালয়ে আসছে। এদের মধ্যে অনেকেই কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা মানুষ যারা বৈষ্ণবের ছদ্মবেশ নিয়ে চন্দননগরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন, এঁদের সোনাগাছিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। চন্দননগরের যে নব্যবাবুদের কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ যারা চুলের বাহার দিয়ে, মুখে চুরুট দিয়ে বেশ্যাবাড়ি যেত, তাদের প্রসঙ্গে বলা যায়, উনিশ শতকে চন্দনগরে শিক্ষিত নব্য বাবুদের উত্থান হয়েছিল। তারা নাটক নিয়ে মেতে উঠেছিল। সেইসব বাবুদের (মুলত উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা) বেশ্যাবাড়ি যাতায়াত ছিল। চুরুটের সে সময় ব্যাপক প্রচলন ছিল চন্দননগরে। লক্ষ্মীগঞ্জ অঞ্চলে একটি তামাকের দোকানে কয়েক বছর আগেও চুরুট পাওয়া যেত। লক্ষ্মীগঞ্জ বলতে সেই এলাকার কথা বলা হচ্ছে যেখানে বিশ শতকের আটের দশক পর্যন্ত চন্দননগরের বেশ্যাবসতিটি (যা খেজুরতলা নামে পরিচিত) অবস্থিত ছিল। কবিতার পরের অংশটির সঙ্গে চন্দননগরের সমাজ মেলালে ছবিটি আরও পরিষ্কার হয়। ছবিটি প্রমাণ করে যে চন্দননগরের বেশ্যাদের অবস্থা কতখানি করুণ হয়ে গিয়েছিল । চন্দননগরের বেশ্যাদের রূপের খ্যাতি ছিল। কিন্তু কলকাতার চোদ্দ আইন জারি হওয়ায়, সোনাগাছির বেশ্যারা পালিয়ে এসে ভিড় করাতে চন্দননগরের বেশ্যাদের বাজারদর পড়তে শুরু করে। অঘোরচন্দ্র লিখছেন যে, আট পয়সার গরিব মজুর যারা খেজুরপাতার ঘরে থাকে, তারাও কম দরে রাজি হওয়া দামি বেশ্যাদের খাসা বিছানায় শুচ্ছে। চন্দননগরের বেশ্যাদের জাতবিচার ছিল। মুসলমান খদ্দেরদের এঁরা নিতে চাইতেন না। তারা অনেক সময় দাড়ি কামিয়ে হিন্দু সেজে বেশ্যালয়ে আসত এদিকে বেশ্যাদের বাজারদর সস্তা হওয়ায় দামি বেশ্যাদের শষ্যাসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে শুনে নৌকার মাঝিরা পর্যন্ত ফরাসডাঙায় (চন্দননগর) রাত কাটিয়ে যেত। সুতরাং মজুর, মাঝি এদের সকলকেই দেহে আমন্ত্রণ জানাতেই হত বেঁচে থাকার জন্য।