বাংলার প্রথম দলিত বিদ্রোহ ও এক ভুলে যাওয়া সংগ্রামী লেখক

কৈবর্ত বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে প্রথম দলিত বিদ্রোহ এবং এটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম দলিত বিদ্রোহ নিয়ে উপন্যাস। আর লেখক সত্যেন সেনকেও একবার ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে, যখন আশপাশে তাকিয়ে দেখার মতো মানুষ কমে আসছে।

১৯৭০ সালে ঢাকায় একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়, নাম 'বিদ্রোহী কৈবর্ত’, লেখক– সত্যেন সেন। প্রকাশনা– খান ব্রাদার্স, প্রকাশক– কে এম ফারুক খান, ৬৭, প্যারী দাস রোড, ঢাকা– ১। প্রকাশকাল- ১১ আশ্বিন, ১৩৭৬। উৎসর্গপত্রে লেখা– প্রিয় বন্ধু শহিদুল্লা কায়সারকে। ২৭৪ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির একটি পশ্চিমবঙ্গ সংস্করণও হয়েছিল, প্রকাশনা– বুক হোম, প্রকাশক– তড়িৎকুমার মজুমদার, কিন্তু প্রকাশকাল সম্পর্কে কিছু লেখা নেই।

হঠাৎ এই উপন্যাসটির কথা উঠল, কারণ কৈবর্ত বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে প্রথম দলিত বিদ্রোহ এবং এটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম দলিত বিদ্রোহ নিয়ে উপন্যাস। আর লেখক সত্যেন সেনকেও একবার ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে, যখন আশপাশে তাকিয়ে দেখার মতো মানুষ কমে আসছে।

কৈবর্ত কারা? তাদের অভিধানিক ব্যাখ্যাগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক। ১. কৈবর্ত অর্থ দাস, ধীবর। যারা মৎস্য হিংসা করে, তারা কৈবর্ত। (বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খণ্ড- হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)। ২. জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসও তাঁর 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান'-এ প্রায় একই কথা বলেছেন। ৩. কৈবর্ত মানে হিন্দুজাতি-বিশেষ, জেলে ('চলন্তিকা'- রাজশেখর বসু)। ৪. কৈবর্ত: যে জলে বাস করে, জলের সহিত বিশেষ সম্বন্ধযুক্ত হিন্দুজাতিবিশেষ। ('ব্যবহারিক শব্দকোষ'- কাজী আবদুল ওদুদ) ৫. কৈবর্ত অর্থ জেলে, ধীবর, মেছো। ('সমকালীন বাংলাভাষার অভিধান'– আবু ইসহাক) ৬. কে বৃত্তির্যেষাং ইতি কৈবর্ত। ‘কে’ শব্দের অর্থ জল। জলে যাদের জীবিকা, তারা কৈবর্ত। (ভারতকোষ)।

আরও পড়ুন: সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হওয়া বিপ্লবী সঞ্জয় ঘোষ আজও নায়ক অসমে

সন্ধ্যাকর নন্দীর লেখা ‘রামচরিত’ গ্রন্থে এই বিদ্রোহের বিস্তারিত বিবরণ আছে। এছাড়া বৈদ্যদেবের ‘কামাউলী পট্ট’ , মদনপালের 'মানহালি দানপত্র' ও ভোজবর্মনের ‘বেলবা দানপত্র’- এই গ্রন্থত্রয়েও ওই বিদ্রোহের কথা আছে।

১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, কৈবর্তরা ছিল বরেন্দ্রের শক্তিশালী জাতি। দ্বিতীয় মহীপালের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা দিব্যোকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল।

২. এই বিদ্রোহের সামাজিক কারণ হল , বৌদ্ধধর্মে মৎস্য হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। ফলে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের আমলে কৈবর্তদের মৎস্যজীবিকার ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ হয়। দ্বিতীয় মহীপাল কঠোরভাবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চাইলে কৈবর্তরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

শেষেরটি ছিল প্রত‍্যক্ষ কারণ, পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের। তাঁরা তাঁদের কথিত অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী এবং জীবহত্যার বিরোধী ছিলেন। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে মানুষ হত্যায় এসব নীতি তাঁরা মানতেন না। তবে অন্যান্য প্রাণীহত্যার ক্ষেত্রে তাঁরা অহিংস নীতির ব্যত্যয় পছন্দ করতেন না।

কৈবর্তদের দুটো ভাগ। হালিক ও জালিক। দিব্যোক হালিক কৈবর্ত। হালিকদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন সত্যেন সেন, যিনি কৈবর্ত সম্প্রদায়ের নন। আর অদ্বৈত মল্লবর্মন জালিক কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষ, এঁদের নিয়ে তাঁর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’।

এবার ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’-র কথায় আসা যাক। লেখকের সাহিত্যজীবন স্বল্পকালীন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪০। এর মধ্যে উপন্যাসের সংখ্যা ১৫। এছাড়া গল্পগ্রন্থও আছে। তাঁর বাষট্টি বছর বয়সে ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ প্রকাশ হয়। প্রসঙ্গত, এই উপন্যাসটির জন্য তিনি বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পান। ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ উপন্যাসের সময়– পাল যুগ, স্থান– গৌড় ও বরেন্দ্রী, চরিত্র – পালরাজা ও শক্তিশালী অমাত্যরা, দলিত কৈবর্ত-সমাজ এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়, পটভূমি– পালরাজা মহীপালের সঙ্গে কৈবর্ত নেতা দিব্যোকের রাজনৈতিক সংঘাত। পরিণতি– মহীপালের পতন ও কৈবর্ত-সমাজ কর্তৃক গৌড় দখল।

এ-ই হলো ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’-র সাদামাটা বিবরণ। কিন্তু এই উপন্যাসের ভেতরে প্রতিফলিত হচ্ছে শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব, অত্যাচারিত কৈবর্ত-সমাজের বিলাপ। এই উপন্যাসের একদিকে প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে কৈবর্ত-জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। লুণ্ঠিত হতে হতে কৈবর্তরা একসময় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। কৈবর্তরা মনে করত, বরেন্দ্রী তাদের নিজস্ব ভূমি। এই ভূমিতে ব্রাহ্মণ বা বৌদ্ধদের কখনও স্বাগত জানায়নি তারা।

কৈবর্তরা এমনিতে শান্তিপ্রিয় নিরীহ সম্প্রদায়, কিন্তু প্রয়োজনে যুদ্ধ জানে। গৌড়ের রাজাদের বিরুদ্ধে এরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম চালিয়েছে। চুরি বা ডাকাতি কাকে বলে, কৈবর্তরা জানত না। এই দুটো শব্দ তারা শিখেছে গৌড়ের লোকদের মুখে।

মহাভারতের কাল থেকে ‘দাসবংশ'-র মেয়েদের রূপ-যৌবন ব্রাহ্মণ ও অন্য বর্ণহিন্দুদের ভোগের সামগ্রী হয়েছে। এই অপমানের ইতিহাস লেখা আছে ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত'-তে। নারীর অপমান বুকে নিয়ে ভূমিহারা কৈবর্তরা একদিন জেগে উঠে রাজধানী গৌড় অধিকার করেছে। এই আক্রমণের নেতা দিব্যোক। দিব্যোক যতটুকু রাজা, তার অধিক মানবিক মানুষ। গৌড়জয়ের প্রথম দিনেই নিজ সৈন্যদের আদেশ দিয়েছে– "মেয়েদের আর বাচ্চাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না, কারো ঘরে আগুন দিতে পারবে না। যে এই নিষেধ মানবে না তার কঠিন শাস্তি হবে।"

কৈবর্ত-জনগোষ্ঠীর ওপর গভীর নিরীক্ষা না থাকলে এই উপন্যাস লেখা সম্ভব হতো না তাঁর পক্ষে। কৈবর্তদের সুরাপ্রিয়তার কথা, সুরা যে তাদের চৈতন্য লুণ্ঠন করেছে, তার কথা লিখতেও ভোলেননি লেখক।

সত্যেন ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৯৩৩ সালে গ্রেফতার হন। এই সময় তাঁর ৬ বছর জেল হয়। ১৯৩৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পান। জেল থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যেই নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় চলে আসেন। সত্যেন যে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন, তখন অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তার পরিসরে দলিতের আত্মপরিচয়টি সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের বিপুল তত্ত্বের নিচে চাপা পড়েছিল। যা প্রায় ৭০ বছর পর দুই পারের কমিউনিস্টদের ভাবনায় জায়গা পায়। কমিউনিস্ট হয়ে এবং দলিত না হয়েও সত্যেন এই দলিত আত্মপরিচয়টিকে চিহ্নিত করে, ঐতিহাসিক ঘটনায় ভিত্তি করে উপন্যাসটি লেখেন। তবে কি সত্যেন শেষ বয়সে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্বের পর্বতপ্রমাণ তত্ত্বটির সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরেছিলেন? আর ঐতিহাসিক সত্যকে মান্যতা দিয়ে দলিতের আত্মপরিচয়টিকে তুলে ধরেছিলেন? তাঁর উপন্যাসে সর্বহারা কৈবর্তদের বিজয়ের কথা লিখলেও, মনে রাখতে হবে, এই কৈবর্তরা দরবারি মার্ক্সীয় তত্ত্বের সংজ্ঞায় লিখিত সর্বহারা নয়। উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন বন্ধু, কমরেড ও সাহিত্যিক শহিদুল্লা কায়সারকে, হয়তো তাঁদের মধ্যে এই বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে একসময়।

এবার সত্যেনের জীবনের দিকে তাকানো যাক। সত্যেন ছিলেন ঢাকায় প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ ও 'উদীচী' সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ও সাহিত্যিক। জন্ম ঢাকার বিক্রমপুর জেলার সোনারং গ্রামে। সত্যেনের কাকা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য আর কাকার ছেলে অমর্ত্য সেন। সত্যেন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা বিভাগে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে ১৯৩১ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ পাশ করেন, পরের বছর ছাড়া পান। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে তার বিরুদ্ধে আবার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করে পূর্ব পাকিস্তান সরকার, এক বছর আত্মগোপন করার পর গ্রেফতার হন। ৪ বছর জেলে থাকার পর ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়ে নিজ গ্রাম সোনারাংয়ে ফিরে গিয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তান হিন্দুদের বসবাসের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে ওঠার কারণে তাঁদের পরিবারের সবাই কলকাতায় চলে আসেন, কিন্তু অবিবাহিত সত্যেন থেকে যান। ৬৩ বছর বয়সে সত্যেন ১৯৭১ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক পর্যায়ে তাঁর চোখের অসুখ মারাত্মক হয়ে উঠলে তিনি প্রায় অন্ধ হতে চলেন। এই সময় কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে চোখের চিকিৎসার জন্য মস্কো পাঠায়। মস্কো হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন তিনি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ পান। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালে। কিন্তু ১৯৭৩ সালে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসার জন্য চলে আসেন ভারতে। শান্তিনিকেতনের মেজদিদি প্রতিভা সেনের বাড়িতে ওঠেন। শান্তিনিকেতনেই ১৯৮১ সালে ৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

More Articles