তিন হাজার গান! কোনও কপিরাইট রাখেননি নজরুল
যাঁর নামের আগে ‘বিদ্রোহী’ বিশেষণটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো আমৃত্যু রয়ে গেল তাঁর জীবনের দিকে একটু তাকানো যাক।
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরেসে কি বাস্ করলে তাড়া
বলি থাম্ একটু দাঁড়া
এই ছড়া না বলে কারই বা বালকবয়স পরিত্রাণ পেয়েছে, বিশেষত যারা গত শতকের ছয়ের দশকে জন্মেছেন। কোথায় না বলতে হয়েছে এই ছড়াটি? স্কুলে, পাড়ার ও বেপাড়ার ক্লাবে, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়, আত্মীয়দের সামনে, রসুন [রবীন্দ্র, সুকান্ত, নজরুল] সন্ধ্যায়, এমনকী, একজনকে চিনি, যাকে মেয়ে দেখতে আসা পাত্রপক্ষের সামনেও এটি বলতে হয়েছে, কেননা পাত্রীর সাজ তখনও শেষ হয়নি, তাই সামান্য মনোরঞ্জন আর কী! ‘লিচুচোর’ নামে এই ছড়াটির রচয়িতা কাজি নজরুল ইসলাম। ছড়াটির লিচুচোর বালকটি যেমন নিরন্তর বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়, নজরুলকে তাঁর ব্যক্তিজীবনেও নিরন্তর বাধা পেরিয়ে যেতে হয়েছে। দুঃখের বিষয়, তিনি মুক্তি পেয়েছেন ৪৩ বছর বয়সে, যখন তিনি বাকরহিত হয়ে পড়লেন এবং যে কোনও মহাকাব্যের ট্র্যাজিক চরিত্রের মতো নির্বাক নজরুল ৩৪ বছর বেঁচে ছিলেন। প্রসঙ্গত, ২৯ অগাস্ট তাঁর ৪৬তম প্রয়াণ দিবস।
বালক বয়স পেরিয়ে কৈশোরে পৌঁছে জানলাম আসলে উনি বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম, কেননা উনি ২৩ বছর বয়সে 'বিদ্রোহী’ নামে একটি অতি দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন, যেটি বহু বাঙালি রাজদ্বার ও শ্মশান-সহ নানা জায়গায় আবৃত্তি করে বেড়ায়। এটা জানার পর যে কোনও বাঙালি কবির নামের আগে বিদ্রোহী বা অন্য কিছু লেখা আছে কি না, জানার চেষ্টা করতাম, সেই চেষ্টা মাঠে মারা গেছে। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি, এর আগে জেনেছি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আর অনেক পরে জেনেছি কাস্তে-কবি দীনেশ দাসের কথা, বলা বাহুল্য, এই বিশেষণ দুটিতে বিদ্রোহীর মতো উত্তেজনা নেই। কীভাবে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলি, নজর আলি থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজি নজরুল ইসলাম, কাজি নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজি নজরুল ইসলাম এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম হলেন- সেই বিচিত্র ইতিহাসের সবটা জানা যায় না। প্রসঙ্গত, কাজি নজরুল ইসলাম নামটির একত্রে কোনও অর্থ বহন করে না, ৩টি আলাদা অর্থ আছে শব্দগুলোর, যেমন, কাজি- যাহার দ্বারা প্রকৃত কাজ হবে এমন মানুষ, নজরুল– যিনি মুক্তির কাণ্ডারি আর ইসলাম শব্দের অর্থ– শান্তি। নামের ৩টি আলাদা অর্থের মতো জীবনেও তিনি ৩টি দেশের নাগরিক ছিলেন, যথাক্রমে ব্রিটিশ ভারত (১৮৯৯-১৯৪৭), স্বাধীন ভারত (১৯৪৭-১৯৭৬), স্বাধীন বাংলাদেশ (১৯৭২-১৯৭৬)। নাম ও নাগরিকত্বের মতো তাঁর জীবন মাত্র ৩টি নয়, আরও অনেক বেশি খাতে বয়েছে। বোধহয় এই সবই হয়েছে তাঁর বিদ্রোহী চরিত্রকে মান্যতা দেওয়ার জন্য; আর বেশি বিদ্রোহ সমাজের পছন্দ নয় বলেই তাঁকে ৩৪ বছর মানসিক ভারসাম্যহীন নির্বাক হয়ে থাকতে হয়েছিল সম্ভবত। তো যাঁর নামের আগে ‘বিদ্রোহী’ বিশেষণটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো আমৃত্যু রয়ে গেল তাঁর জীবনের দিকে একটু তাকানো যাক।
আরও পড়ুন: ‘তাসের দেশ’-এর রাজপুত্র এখনও যুদ্ধ ঘোষণা করে সব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
নজরুলের প্রথম কবিতা ['মুক্তি'] প্রকাশ হয়েছিল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’-য় ১৯১৯ সালে। উনি তখন সেনানিবাসে, সেখান থেকে সম্পাদক মহম্মদ শহীদুল্লাহকে চিঠি লিখেছেন, ‘আপনার এরূপ উত্সাহ থাকলে আমি যে একটি মস্ত জবর কবি ও লেখক হব, তা হাতে কলমে প্রমাণ করে দিব, এ নির্ঘাত সত্যি কথা।' এই চিঠি লেখার তিন বছরের মধ্যে [১৯২২/৬ জানুয়ারি] তিনি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখে বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন তৈরি করেন। লিখে ফেলার ১০ দিনের মধ্যে ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, কবিতাটি এতই জনপ্রিয় হয় যে, ‘মোসলেম ভারত’, ‘প্রবাসী’ আর ‘সাধনা’ পরপর ৩টি পত্রিকায় ছাপা হয়। ঝোড়ো হাওয়ার মতো কবিতাটি বঙ্গমানসে ছড়িয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত, 'বিদ্রোহী' লেখার আগেই ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে নজরুল ইসলাম একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান, তখন থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় কুড়ি বছর, বাংলার এই দুই প্রধান কবির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল।
নজরুলকে ঔপনিবেশিক, সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে বুঝতে গেলে আমরা দেখব, যে, বাঙালি এলিট সংস্কৃতির প্রফেসর ও অফিসাররা তাকে এক অমীমাংসিত অস্বস্তিকর বিতর্কের মতো একপাশে রেখে দিয়েছে, শুধু ‘মোরা একই বৃন্তে দুইটি কুসুম...’-এর প্রয়োজনীয় ব্যবহার ছাড়া। শাসক ইংরেজের শিক্ষায়, তাদেরই মাপকাঠিতে কলকাতার মুৎসুদ্দি, বেনিয়ান, গ্রাম-ছাড়া ভূস্বামী, উচ্চবর্গ বাঙালির হাইব্রিড মূল্যবোধটি গড়ে উঠেছিল। বাঙালির এই শিল্প-সাহিত্যের মানদণ্ডটি ফুলে-ফলে ভরে উঠেছিল হিন্দু কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রশ্রয়ে। নজরুল এসেছিলেন এই শহুরে এলিট বৃত্তের বাইরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির লৌকিক জগৎ থেকে এবং সেহেতু উচ্চবর্গের মানদণ্ডে থেকে গেলেন বিতর্কিত ও প্রান্তিক । সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ততদিনে ব্রিটিশ কালচারের অনুপ্রবেশ পুরোদমে ঘটেছে। বিলিতি পুঁজিবাদের প্রথম শিকার ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতির সনাতন ধারাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন নজরুল, তাই তিনি পদে-পদে আক্রান্ত হয়েছেন, শাসকের আর্টের পৃষ্ঠপোষকদের দ্বারা, ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা, নব্য হিন্দু কর্তাদের দ্বারা, শহুরে সাহিত্যিকদের দ্বারা। নজরুলের পক্ষে লোকসংস্কৃতির চরিত্রস্বভাবকে ত্যাগ করে মেট্রোপলিটন সংস্কৃতিতে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। তাই মেট্রোপলিটন সংস্কৃতির মানদণ্ডে তিনি চিহ্নিত হলেন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে। মেট্রোপলিটন সংস্কৃতি বাধ্য হয়েছিল নজরুলের জন্য এই ‘বিদ্রোহী কবি’ ক্যাটেগরি তৈরি করতে, কারণ তাদের তৈরি করা কোনও ক্যাটেগরিতেই নজরুল খাপ খায় না, মনে রাখতে হবে, আর কোনও বাঙালি কবির নামের আগে এর আগে বা পরেও এই ধরনের বিশেষণ বসেনি।
আর কোনও বাঙালি কবির লেখা এতো বই কি নিষিদ্ধ হয়েছে? ১৯২২ সালে তার প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয়, তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২৪ সালে 'বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’ এই দু'টি বই নিষিদ্ধ হয়। ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘প্রলয় শিখা’ আর অক্টোবরে ‘চন্দ্রবিন্দু’ নিষিদ্ধ হয়। ৫টি বই নিষিদ্ধ হলেও, কবিতা লেখার জন্য নজরুলের কারাদণ্ড হয়েছিল দু'টি ক্ষেত্রে, প্রথম কারাবাস ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আগমনী’ কবিতাটির জন্য ১ বছর আর ‘প্রলয় শিখা’ কবিতার বইটির জন্য ৬ মাস। বই নিষিদ্ধ ও কারাবাস- সবেরই কারণ ব্রিটিশ সরকারের না-পসন্দ।
অথচ গোঁড়া হিন্দু বাঙালির হাস্যকর অভিযোগ, নজরুলের কবিতা, সাহিত্যে ও সংগীতে ও আরবি ও ফার্সি শব্দ রয়েছে। তাই তিনি মুসলমানি কবি। সেই মুঘল আমল থেকেই বাংলা শব্দভাণ্ডার আরবি, ফার্সি ছাড়া কার্যত অচল, বাংলা শব্দভান্ডারের গড়ে ওঠার ইতিহাস সেই কথাই বলে।
১৯৩০ সালের ৭ মে বসন্ত রোগে কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের (অরিন্দম খালেদ) মৃত্যু হয়। পুত্রশোক সামলাতে নজরুল আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে ঝোঁকেন। এই সময় মানসিক সংকট থেকে বাঁচতে নজরুল একজন শাক্ত হিন্দু গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর নাম বরদাচরণ মজুমদার। ‘ভক্তিগীতি মাধুরী’ নামে নজরুলের ৫০১টি ভজন, কীর্তন, শ্যামাসংগীত এবং ইসলামি গানের নির্বাচিত সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর নজরুল কালীভক্ত হয়ে গেলেন, কালী দেবীর নামে অনেক ভক্তিমূলক শ্যামাসংগীত লিখতে লাগলেন, তাতে সুর লাগালেন, নিজে ভাবের সঙ্গে গেয়েও শোনালেন।
আজ বিদেশে কপিলেফট আন্দোলন নিয়ে মাতামাতি, সেই সময় উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক আধিপত্যটি যখন কপিরাইটের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীমানস কপিরাইটকেই পুজো করছে, তখন নজরুল তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া প্রায় ৩০০০ গানের স্বরলিপির কপিরাইট রাখেননি। ব্যতিক্রমী নজরুল নির্দ্বিধায় নিজের এপিটাফ লিখে গেছেন জীবিতকালেই, তাঁর ধর্মে নিষিদ্ধ পানীয়প্রেমে, আমার ধারণা, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এপিটাফ।
যেদিন লব বিদায় ধরা ছাড়ি প্রিয়ে।
ধুয়ো ‘লাশ’ আমার লাল পানি দিয়ে।।
শারাবী জামশেদি গজল ‘জানাজায়’ গাহিও আমার
দিবে গোর খুঁড়িয়া মাটি খারারী ঐ শরাব –খানার!
‘রোজ –কিয়ামতে’ তাজা উঠব জিয়ে।।
এমনি পিব শরাব ভেসে যাব তাহার স্রোতে
উঠিবে খুশবু শরাবের আমার ঐ গোরের পার হতে
টলি’ পড়বে পথিক সে নেশায় ঝিমিয়ে।।