সেক্স জার্নাল, জ্যোতিষ থেকে গোয়েন্দা গল্প! বর্ণময় জীবন ছিল স্বপনকুমারের
Swapankumar: স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি-রতনলালের রহস্য গল্প সিরিজের জনপ্রিয় বর্ণনা মিথ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি পাঠকের মনে।
আমরা যারা সত্তর দশকের অ্যানালগ যুগে বড় হয়েছি, তাদের স্কুলজীবনের শেষের দিকে মানে ক্লাস এইট-নাইনে লুকিয়ে শ্রীস্বপনকুমারের বই না পড়ে উপায় ছিল না।
এক হাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ, দীপক পাঁচতলা হইতে জলের পাইপ বাহিয়া বিদ্যুৎ-গতিতে নীচে নামিয়া গেল।
সত্যি হোক বা না হোক, স্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি-রতনলালের রহস্য গল্প সিরিজের এই জনপ্রিয় বর্ণনা মিথ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি পাঠকের মনে। তবে ‘কুহকিনীর চক্রান্ত’ গল্পের শুরুতেই একটি ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরার ভিতর দীপক মৃদু হেসে ওই কামরায় বসে থাকা এক মিলিটারি মেজর ও তার সহকারীকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, “আপনারা যে যেখানে বসে আছেন, সেখানেই থাকবেন। আমার দিকে সরে আসার চেষ্টা করলেই আমার এই দশনলা পিস্তলে দশটা টোটা ভরা আছে, সুতরাং, বুঝতেই পারছেন এটা কীরকম সাংঘাতিক অস্ত্র।" পড়ার সময় মনেই হয়নি দশনলা পিস্তল আদৌ হয় কি না আর সেটা পোশাকের ভেতর লুকিয়েই বা কী করে রাখা যাবে? যেমন মনে হয়নি বিএ পাস দীপক কী করে ক্রিমিনোলজিতে এমএ পাস করে ('অদৃশ্য সঙ্কেত')। 'বিশ্বচক্র' সিরিজের দীপকের গোয়েন্দা গল্পগুলোর নামও এমন হতো যে না পড়ে উপায় থাকতো না, যেমন, ‘বিকেল ছটার শোতে’, ‘বিজয়নী তন্দ্রা’, ‘চায়না লজ’ কি ‘বিষাক্ত হাসি’। ‘বিকেল ছটার শোতে’– এই গল্পে স্বপনকুমার ১৯৪৩ সালের কলকাতাকে লন্ডনের মতো ইস্ট এন্ড ও ওয়েস্ট এন্ড- দু'টি ভাগে ভাগ করেছেন। ইস্ট এন্ড-এর ছেলেরা স্বদেশি করে আর ওয়েস্ট এন্ড-এর ছেলেরা ইংরেজ-ঘেঁষা।
আরও পড়ুন: হিন্দু তান্ত্রিকের শিষ্য হয়েছিলেন খ্রিস্টান বিচারক, ইউরোপে ঝড় তুলেছিল তন্ত্রসাধনা
ক্রাউন সাইজের ৩ ফর্মা (৪৮ পৃষ্ঠা) বা ৪ ফর্মার (৬৪ পৃষ্ঠা) পাতলা একটি বই। চট করে প্যান্টের প্যাকেটে ঢুকে যাবে। দু'রং বা তিন রং–এর গ্লসি কাগজে ছাপা প্রচ্ছদে, বেশিরভাগ নারায়ণ দেবনাথের আঁকা। ভেতরে সস্তার হলুদ নিউজ প্রিন্ট কাগজে ছাপা, প্রচ্ছদ পেরোলেই টাইটেল পেজে ঘোষণা: ‘কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’ বলা বাহুল্য, তাঁর পাঠকেরা ছিল স্কুল স্টুডেন্টরা। দাম ৪০ পয়সা থেকে ৬০ পয়সা। প্রত্যেক মাসে একটি করে বই বেরোত।
শ্রীস্বপনকুমারের গোয়েন্দা গল্প সাধারণভাবে বাংলা সাহিত্যের জগতে অকুলীন ও পাল্প ফিকশন হিসেবে খ্যাত। যদিও তিন, চার দশক ধরে শ্রীস্বপনকুমারের বইয়ের বাজারে বিরাট চাহিদা ছিল। বটতলার বই হিসেবে খ্যাত হলেও জনপ্রিয়তা এবং বিক্রিতে দীপক চ্যাটার্জী সবার ওপরে ছিল। তার সহকারীর নাম রতনলাল। তার শত্রুরা ছিল ড্রাগন, কালনাগিনী, কালো নেকড়ে, মিসট্রিম্যান, কেউ আবার বাজপাখি।
শ্রীস্বপনকুমারের বই পড়া যেন এক রোলার কোস্টার রাইড। শুরু করলে শেষ না করে থামা যাবে না। চরিত্রগুলো সব দৌড়চ্ছে। দ্রুত ঘটে যাচ্ছে একের পর এক ঘটনা। ধাঁ করে গুলি চালিয়ে দিল, তার পরই অপরাধীর পিছু ধাওয়া করল গোয়েন্দা, চলন্ত গাড়িতে বদলে নিল ছদ্মবেশ। প্রতিটি গল্পেই বেজে ওঠে টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ, বহুবার। একপাতা পর পরই হয় কেউ খুন হচ্ছে, নয়তো অপহৃত হচ্ছে, গোয়েন্দা ধরা পড়ছে ভিলেনের হাতে আবার পরের পাতায় ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে! গোয়েন্দা ভিলেনের হাতে ধরা পড়তে পড়তে পড়ছে না এমন এক উত্তেজনার মূহুর্তে গল্প শেষ। স্টাইলটা অনেকটা জেমস বন্ডের মতো।
এই শ্রীস্বপনকুমার কিন্তু একজন নন, সেটা আমরা পরে দেখব, কীভাবে এবং কেন তিনি বহু হলেন। আসল নাম সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। এই পাণ্ডে পরিবারটি ছিল কনৌজের ব্রাহ্মণ। আদি বসতবাড়ি বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা। সমরেন্দ্রনাথের জন্ম ২৬ অক্টোবর, ১৯২৭, মৃত্যু ১৫ নভেম্বর ২০০১। বাপ, ঠাকুরদারা ছিলেন উকিল, তবে ততটা স্বাছল্য ছিল না। আইনজীবী পরিবারে জন্ম হলেও সমরেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার। কৈশোরেই চলে আসেন কলকাতায়। এক সময় ভর্তিও হন আর জি কর মেডিকেল কলেজে। এক বছর পরেই বাড়ি থেকে খবর এল, সংসারে অভাব, ডাক্তারি পড়ার খরচ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। বাধ্য হয়েই কলম ধরলেন ‘শ্রীস্বপনকুমার’। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারি পাশ করেন। কিন্তু অর্থকষ্ট পিছু ছাড়েনি।
শ্রীস্বপনকুমার যখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন, সেই সময় একদিন প্রকাশকের কাছে গিয়েছেন পাওনা টাকা আনতে। প্রকাশক তাঁকে বসিয়ে রেখে অন্য আরেক লেখকের টাকার হিসেব নিকেশ করছেন। স্বপনকুমার অধৈর্য হয়ে বলে ফেলেছিলেন,‘‘আরে, আমিও তো লিখি! আমাকে বসিয়ে রেখেছেন কেন?’’ উত্তরে সেই প্রকাশক নাকি বলেছিলেন, ‘‘দেখুন, গোয়েন্দা গল্প তো সবাই লিখতে পারে। উনি জ্যোতিষের বই লেখেন, অনেক টাকার ব্যবসা দেন। ওঁকে আগে ছাড়তেই হবে”। সেদিন নাকি প্রকাশকের দপ্তরে বসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, জ্যোতিষ শিখে একদিন দেখিয়ে দেবেন এবং দিয়েও ছিলেন।
জ্যোতিষ শেখার পর, শ্রীভৃগু নামে জ্যোতিষচর্চার বই লিখতে শুরু করলেন এবং বাজারে আসামাত্র তা হিট। শুধু তাই নয়, পেশাদার জ্যোতিষী হয়ে এতোটাই সাফল্য পেয়েছিলেন যে, পাশ করা ডাক্তার হয়েও বাড়ির বাইরে কোনও দিন ডাক্তারি করেননি। শ্রীভৃগুর বইয়ের এতোই খ্যাতি ছড়ায় যে এক সময় শ্রীভৃগুরও একাধিক নকল বেরিয়ে গিয়েছিল বাজারে। সবাই বিজ্ঞাপনে দাবি করত, তারাই ‘আদি এবং অকৃত্রিম’!
যেহেতু লিখে টাকা রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো তাকে, তাই তিনি তাঁর ডাক্তারি বিদ্যাও কাজে লাগালেন, ডাঃ এস এন পান্ডে নামে বাংলায় ‘প্র্যাকটিস অব মেডিসিন’, ‘টেক্সট বুক অব প্যাথলজি’, ‘টেক্সট বুক অব অ্যানাটমি’ থেকে শুরু করে ফার্স্ট এড, হোম নার্সিং, অ্যালোপাথি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, এমনকী গাইনোকলজি, যৌনজীবন ইত্যাদি সব রকমের বই লিখেছেন আর সেগুলো দেদার বিক্রিও হয়েছিল। তারপর যখন দেখলেন তিনি লিখলেই সেই বইয়ের ভালো কাটতি হচ্ছে, তখন ডাঃ পান্ডে নামে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই, গাড়ি চালানো শেখা, হাঁস মুরগি পালন, সহজে ট্রান্সজিস্টর তৈরি, হারমোনিয়াম শিক্ষা, বাগানে সবজি চাষ, – এইসব নানা বিচিত্র বিষয় নিয়ে বই লিখলেন, সেগুলোও ভাল বিক্রি হতো, এভাবেই তিনি এক থেকে বহু হলেন অথচ সেই বইয়ের রয়ালটির না পেয়েছেন যথেষ্ট টাকা, না পেয়েছেন সাহিত্যিক হিসেবে সুনাম।
শোনা যায়, তাঁর লেখার ঘর ছিল শিয়ালদা স্টেশনের ওয়েটিং রুম, নিখরচায় আলো-পাখা পেতেন, সারা রাত ওখানেই বসে লিখে যেতেন, সকালে প্রকাশকের লোক এসে হাতে হাতে টাকা দিয়ে পান্ডুলিপি নিয়ে যেত। সে টাকা সংসার খরচের জন্য কাউকে দিয়ে শ্যামনগরের বাড়িতে পাঠিয়ে উনি আবার লিখতে বসে যেতেন।
টাকার জন্য অনেক সময়ই একসঙ্গে একাধিক সিরিজ লিখেছেন, আলাদা আলাদা প্রকাশকের জন্য। হয়তো ‘কুহেলিকা সিরিজ’ ‘ক্রাইম ওয়ার্ল্ড সিরিজ’ আর ‘ড্রাগন সিরিজ’ বা ‘কালনাগিনী সিরিজ’ কি ‘বিশ্বচক্র সিরিজ’ নয়তো ‘কালরুদ্র সিরিজ’ - একসঙ্গে লিখছেন। আপার চিত্পুর রোডের প্রকাশক জেনারেল লাইব্রেরির কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্ত প্রথম প্রকাশ করেন দীপক চ্যাটার্জির ‘বাজপাখি সিরিজ’। লেখকের ছদ্মনাম শ্রীস্বপনকুমার। এরপর দেব সাহিত্য কুটির, মহেশ পাবলিকেশন, আদিত্য পাবলিকেশন থেকেও তার বই প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীস্বপনকুমারের গোয়েন্দা কাহিনির সংখ্যা প্রায় ৭০০ - এর বেশি হবে বলে অনুমান করা হয়। উনি দীপক চ্যাটার্জিকে নিয়ে ১০টি সিরিজ লিখেছেন, যদ্দুর মনে পড়ে, এক একটি সিরিজে ৬০/৬৫ টি বই ছিল। মার্কিন পাল্প ফিকশন ঘরানার স্টাইলে দীপক চ্যাটার্জির সিরিজ সাজিয়ে ছিলেন। আর তাঁর বইয়ের বিপণন ছিল সর্বত্রগামী – স্টেশনের হুইলার থেকে খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা বা ট্রেনের হকার থেকে পাড়ার ছোট্ট বইয়ের দোকান পর্যন্ত। শোনা যায় প্রেস থেকে ঝাঁকামুটের মাথায় করে আসত শ্রীস্বপনকুমারের বই। কেউ হয়তো বেড়াতে যাচ্ছে, ট্রেনে ওঠার আগে এক ডজন শ্রীস্বপনকুমারের বই কিনে নিল।
গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির গল্পগুলো পড়লে প্রাণপণে লিখে যাওয়ার সেই তাড়নাটা প্রতি লাইনে স্পষ্ট। স্থান, কাল, পাত্র, ঘটনা বা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র যে মাথা ঘামাতেন না, সেই তাড়না ছিল খিদের। নামে, বেনামে প্রকাশকদের চাহিদা মতো অনেক ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদ করে দিতেন। এও শোনা যায়, তাঁকে দিয়ে এক বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের উপন্যাস, প্রসিদ্ধ নাট্যকারের নাটকও লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে, নামমাত্র পয়সায়।
বাংলা সাহিত্যে নানা বিষয়ে গবেষণা হয়, শ্রীস্বপনকুমারকে নিয়ে কেউ গবেষণা করেছেন কি না জানা নেই। কিন্তু এই বিচিত্র লেখককে বাংলা ভাষার পাঠক ভুলতে পারবে না।