তিরিশ বছর ধরে বাংলা ফিল্মে একাই ছড়ি ঘুরিয়ে গেলাম: উত্তমকুমার

কথা প্রসঙ্গেই বললেন, ‘অভিনয় আমার প্রাণ। আমার বরাবরের অভাগী জীবনের জীবনী শক্তি, সেই শক্তি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বার অভিপ্রায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া কি কোনও সুস্থ মনের পরিচায়ক?'

 

আমি একজসটেড্ হয়ে পড়ছি না ত? কিংবা ডিকেয়িং স্টেজের মোকাবিলার মুখোমুখি? নানা কথা প্রসঙ্গে একসময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসলেন উত্তমকুমার।

বললাম, ‘নিশ্চয়ই না। এই মুহূর্তে আপনি যা ভাবছেন, যা বলতে চাইছেন, আপনার এই চেতনাই আপনাকে, আপনার পপুলারিটিকে আরও দীর্ঘায়ু করে তুলবে।'

বিন্দুমাত্র বিগলিত না হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরেই বললেন তিনি, ‘প্রত্যেক মানুষেরই কোনও কিছু দিয়ে যাবার একটা লিমিটেশন থাকে তো। সৃজনশীল শিল্পীরাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। আমার নিজেরও দিয়ে যাবার ভাণ্ডারটা নিশ্চয় অফুরন্ত নয়। ডিমান্ডের চাপে পড়ে সাপ্লাই করে যাবার চেষ্টা করে গেছি চাহিদার অতিরিক্ত। এখন আশঙ্কা হয়, এই অতিরিক্ত সাপ্লাই আমার ডিমান্ডের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে না তো?'

আরও পড়ুন: এক তরুণী লাল ব্লাউজ ছুড়েছিলেন উত্তমকুমারের দিকে

প্রসঙ্গক্রমে তিনি ইকনমিকসের বই ‘ইলাসটিসিটি অব ডিমান্ড’ আর ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন’-এর কথাও উল্লেখ করলেন।

তাঁর পরবর্তী বক্তব্যে আরও গভীরতার সুর ছিল। অনেকটা আক্ষেপের সুরেই তিনি বললেন, ‘তিরিশ বছর ধরে বাংলা ফিল্মে আমি একাই ছড়ি ঘুরিয়ে গেলাম, আজও পর্যন্ত আমাকে রিপ্লেস করার মতো কেউ এল না। দর্শকদের অসীম ধৈর্য, আমার এই বয়সে এখনও তাঁরা আমাকে রোমান্টিক নায়করূপে সহ্য করছেন। একেক সময় মনে হয়, তাঁদের প্রতি আমি দিনের পর দিন অবিচার করে চলেছি।'

বললাম, ‘ইচ্ছে করলে এখনও তো আপনি আপনার কোনও উত্তরসূরি তৈরি করে দিয়ে যেতে পারেন।'

‘না তেমন কোনও নিষ্ঠাবান ধৈর্যশীল ছেলের সন্ধান পাচ্ছি না।' অনেকটা বিক্ষোভের সুরে জবাব দিলেন উত্তমকুমার: ‘আর বাইরে থেকে পাব তেমন আশা করা তো অনেক দুরাশা। এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেই যারা সংশ্লিষ্ট, যাদের মধ্যে অনেক অনেক সম্ভাবনা ছিল, শুটিং এর সময়ে তাঁদের অনেককেই দেখি কাজে এতটুকু সিরিয়াস নয়। হাল্কা আড্ডায় সারাক্ষণই মশগুল। শটের ফাঁকে কখনও হয়তো ট্রানজিস্টারে খেলার খবর শুনছে, নয়তো বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে গল্প গুজবে বিভোর হয়ে থাকছে। নিজেদের অভিনয়ের চরিত্রটা সম্পর্কে ছিটেফোঁটা ভাববারও যেন কোনও দায়দায়িত্ব নেই তাঁদের। সব ভাবনাই পরিচালকের, এই অবাস্তব সত্যটি তারা জেনে বসে আছে।'

‘ফিল্ম অ্যাক্টিং এর ক্ষেত্রে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত খণ্ড বিচ্ছিন্ন দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে পরিচালকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা ছাড়া শিল্পীর আর কোনও গতান্তর থাকে কি?' প্রশ্ন করলাম উত্তমকুমারকে। স্পষ্ট করেই তিনি জবাব দিলেন, ‘পরিচালকের উপর নিশ্চয়ই নির্ভরশীল হতে হয় যে কোনও শিল্পীকে। কিন্তু অভিনয়ের ব্যাপারে কনসেনট্রেশনটাই বড় কথা। সেই মানসিক ধৈর্য ও সংযমই যেন আজ নেই আর কোনও আর্টিস্টের।' প্রসঙ্গক্রমে তিনি ছবি বিশ্বাস এবং আরও কয়েকজন বিগত দিনের বিখ্যাত অভিনেতার নাম উল্লেখ করলেন। সারা রাত্রি মদ্যপান করলেও তাঁরা কখনোই ফ্লোরে এসে হাই তুলতেন না। অভিনেয় চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়বার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। তাই তাঁরা আজও সবার নমস্য।

হঠাৎই উত্তমকুমার একটি পজিটিভ প্রশ্ন করলেন– ‘ফাঁকি দিয়ে কখনও কোনও মহৎ কাজ হয়, না হয়েছে?' তিনি বলে চললেন তাঁর নিজের কথা, তাঁর এই সময়কার মানসিকতার কথা। মাঝে মাঝে কিছুটা কাব্যের সুরও ধ্বনিত হতে শুনলাম তাঁর উক্তিতে।

বলছিলেন তিনি, ‘আজ আর বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর স্বাদ গ্রহণ করবার মতো মনের উদারতা আমার নেই। সেই অকারণ পুলকে পুলকিত হয়ে উঠতে পারার মতো মনটাই যেন হারিয়ে গেছে। যে ফুল দেখে একদিন অনায়াসে অকারণেই পুলকিত হয়ে উঠতে পারতাম, সেই ফুল নিয়েও আজ আমার মনে হাজারো জিজ্ঞাসা। ফুলের জেনাস্ কি, স্পেসিস্ কি ইত্যাদি প্রভৃতি। অথচ বুঝতে পারি, সৌন্দর্যের ওপর এমনিতর সার্জারি কোনও সুস্থ শিল্পীর পক্ষে শোভা পায় না। বোটানিকসের কোনও গবেষণাকারীরই কাজ সেটা।'

Nayak Scene

'নায়ক' ছবির একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার

অতি সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ময়রা স্ট্রীটে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে যেখানে তিনি আছেন, সেখানেই। খবরের কাগজে প্রকাশিত সুপ্রিয়া দেবীর সেই উক্তি বিষয়ে কোনও প্রশ্নই উত্থাপন করবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। কারণ আমাদের কথার মাঝে সুপ্রিয়া দেবী মাঝে মধ্যেই আসছিলেন, যাচ্ছিলেন। তাঁকে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। বললেন, ‘কী সংবাদ? নতুন কোনও সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা হয়েছে বুঝতেই পারছি। তবে আমার তরফ থেকেও কিন্তু কিছু বলার আছে‌।'

‘নিশ্চয়ই বলবেন।'

কথা প্রসঙ্গেই বললেন, ‘অভিনয় আমার প্রাণ। আমার বরাবরের অভাগী জীবনের জীবনী শক্তি, সেই শক্তি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বার অভিপ্রায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া কি কোনও সুস্থ মনের পরিচায়ক?'

সুস্থ স্বাভাবিক কণ্ঠেই খানিকটা বেদনার সুর নিয়ে অতঃপর সুপ্রিয়া দেবী বললেন, ‘একটু বিলম্বে হলেও এখন আমি বুঝতে পারছি, মানসিক কোনও স্থিরতা ছিল না আমার। তাই যাঁকে ছাড়া কোনোদিনই আমি বাঁচব না, মনের দিক থেকে যাঁর সঙ্গে আমি আঠারো বছর ধরেই কি বাঁধনে বাধা পড়ে গিয়েছি, সেই আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার গাইড উত্তমকুমারের মূল্যায়ন করতে গিয়েও আমি মিস্-গাইডেড হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে মিস্-গাইডেড করা হয়েছিল। কে অথবা কারা, তাঁদের নাম আমি উল্লেখ করতে চাই না। ঈশ্বর ওদের মঙ্গল করুন।'

উত্তমকুমার তখন একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটু অন্যমনস্ক হলেন।

ক্লান্ত কণ্ঠেই বললেন তিনি, ‘নিজের সঙ্গে নিজের আর কোনও কম্প্রোমাইজ নয়, দর্শকের প্রতি আর কোনও অবিচার নয়, প্রণয়ী নায়ক রূপে রূপোলী পর্দায় আর কখনই আমি আসছি না। ক্যারেকটার রোলে অভিনয় করব। পরিচালনা ও প্রযোজনায় মনোনিবেশ করব।' প্রসঙ্গত আরও জানালেন, সুন্দরবনের পটভূমিকায় একটি সুন্দর গল্প নিয়ে নিজেই একটি ছবির প্রযোজনা ও পরিচালনার কথা ভাবছেন তিনি। নিজে ওই ছবির কোনও ভূমিকায় অংশ নেবেন না, নতুন লেখকের গল্প এবং ছবির একটি পিভোটাল ক্যারেকটারে জনৈক নতুন শিল্পীর সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেবার অভিপ্রায় তাঁর আছে।

তারপরের উক্তি তাঁর অনেকটা স্বগত প্রকারের, ‘সৃষ্টির আনন্দের মধ্য দিয়েই শিল্পী তাঁর অতৃপ্ত ক্ষুধার মাংস খুঁজে বেড়ায়। ‘অ্যাক্টরস মিট’ বলে একটা কথা আছে তো? আজও আমি সেই অমৃত কুম্ভের সন্ধান খুঁজে পাইনি। না অভিনয় জীবনে না ব্যক্তি জীবনে।'

সময় সংক্ষেপে আলোচনা আর বাড়াতে পারলাম না। কারণ তখন তাঁর শুটিংয়ের তাড়া ছিল। চলে আসার আগে শেষ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম– ‘আপনার বোম্বাই অভিজ্ঞতার কথা বলুন।'

‘বোম্বাই অনেক মেথডিক্যাল, বাংলার তুলনায় অনেক বেশি সিসটেমেটিক’, বললেন উত্তমকুমার, "হিন্দি ফিল্মে যাওয়ার আকর্ষণ কোনও কালেই আমার ছিল না। সত্যি বলতে, ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর ডিফিটটাই আসলে মনের দিক থেকে আমায় বোম্বাইমুখী করে দিয়েছে। ওই ছবির ‘পরাজয়’টা মনের দিক থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই অপেক্ষা করে বসেছিলাম আর একটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করে সর্বভারতীয় দর্শকের কাছাকাছি আসার জন্য। এবং এও সত্যি– শক্তি সামন্তর অমানুষের হিন্দি ভার্সনের মাধ্যমে আমি অনেকের মনের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছি। শক্তিবাবুর এই ছবির সাফল্যই আমাকে বোম্বাইগামী করেছে। হিন্দি ছবির অফারও এসেছে। অনেক কাজ করেছি অনেক ছবিতেই, ইতিমধ্যে রিলিজও করে গিয়েছে অনেক ছবি। হয়তো তার মধ্যে অনেক ছবিতেই দর্শকের মনোরঞ্জন করে উঠতে পারিনি একাধিক টেকনিক্যাল কারণে।"

আড়াই তিন শতাধিক বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি, নিজেই নিজের শিল্পী জীবনের স্ট্যাটিস্টিকস উদ্ঘাটিত করে অতঃপর বললেন, অনেকটা অভিমানের সুরেই, ‘আজও আড়াই তিনজন পরিচালক ছাড়া কারুর সঙ্গেই কাজ করে নতুন কিছু শেখার খোরাক পাই নি।'


বিমল চক্রবর্তী সম্পাদিত 'মহানায়ক উত্তমকুমার' ('চারুপ্রকাশ', ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০) বই থেকে পুনর্মুদ্রিত

বানান অপরিবর্তিত

নামকরণ সম্পাদকীয় দফতরের

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অভীক চট্টোপাধ্যায়

More Articles