রাতের অন্ধকারে চোরাগোপ্তা আঁকা হয়, শাসকের চোখে এখনও এই শিল্প 'সন্ত্রাসবাদ'

নর্মানের মতো এইসব গ্রাফিত্তির আর্টিস্টরা মূলত রাতের অন্ধকারে তাদের কাজটি সম্পন্ন করে। এমনভাবে পরিকল্পনা করে, যাতে রাতারাতি কাজ শেষ করে চম্পট দেওয়া যায়।

 

প্রতিটি রাস্তার নিজস্ব ভাষা আছে। পথ গন্তব্যে পৌঁছয় আবার কখনও নিরুদ্দিষ্ট, নির্জন, অজানা, সর্পিল। বাঁকে বাঁকে ভিন্ন ভিন্ন আবহ।

কখনও সে দ্রুততার প্রতীক, কখনও মন্থর, নিমগ্ন, আত্মভোলা। আমরা পথ খুঁজি, হারাই, পথভ্রষ্ট হই। তারপরেও পথে থাকি, পথ ধরি।

যে পথের শুরু আছে, শেষ আছে মনে করি। ঠিক ভাবি না ভুল ভাবি, তাও জানি না। কিন্তু পথ একটা ধরতেই হয়। কখনও উন্মুক্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে যায় অবরোধের ছেঁড়াকানি, পরিত্যক্ত ঝান্ডা। যা আমার চোখে আজ একটা স্থিরচিত্র ছাড়া কিছু নয়। অথচ সেই ছবির কথা আছে। যে কথা জব্দ হয়ে আছে।

আরও পড়ুন: ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান’ হয়ে রয়ে গেলেন, যে সুব্রত মিত্রকে চিনল না বাঙালি

সে ভাষা পড়ে ওঠা যায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে এইসব কাব্যময় অসাড় ভাষার আলপনা কাটতে এই লেখা নয়। একটা ভাব বোঝাতে, একটা দৃশ্যসুন্দর অবস্থান কীভাবে রাজনৈতিক কারণে নির্মিত হচ্ছে, তা শনাক্ত করতে এই গৌরচন্দ্রিকা।

বরং সরাসরি বিষয়ে আসা যাক। রাস্তাও প্রতিবাদের ভাষাকে ধারণ করে। প্রথম এই বিষয়ে অবগত হই প্রাচ্যর বিভিন্ন শহরে গিয়ে। নানা বাড়ি, দোকানের বন্ধ দরজা, গ্যারাজের শাটার, ইতিউতি দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচিল, এমনকী, বাস বা পুরনো ট্রামের চারপাশ, সবই যেন ক্যানভাস।

কোথাও বর্ণময়, কোথাও বর্ণচোরা, কোথাও মূর্ত আবার কোথাও বিমূর্ত রংরেখায় আর অক্ষরবাক্যে সেজে ওঠা রাস্তার দুই পাশ। কী এর নির্মাণ রহস্য, কারা এই শিল্পী, এর উদ্দেশ্যই বা কী? এই ছিল আমার প্রাথমিক অন্বেষণ।

Grafitti

ছবি সৌজন্য: লেখক

এই যে পথে-ঘাটে, নানা জায়গাতে চিত্রিত ছবি- একে বলা হয় গ্রাফিত্তি। যার ভাষায় আছে আবেগ, সামাজিক ন্যায়-অন্যায় নিয়ে প্রতিবাদ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা। গ্রাফিত্তি সার্বিকভাবেই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। সে-বিষয়ে পরে আসছি।

শুরু করা যাক এর ইতিহাস থেকে। প্রাচীন ইজিপ্ট, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে এই প্রতিবাদমূলক শিল্পিত প্রকাশ দেখা যায়। রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধিস্থলের দেয়াল ও ধ্বংসাবশেষেও নানা গ্রাফিত্তির প্রমাণ মিলেছে। এদিকে দক্ষিণ সিরিয়া, পূর্ব জর্ডান এবং উত্তর সৌদি আরবে পাথরের ওপরে কিছু লেখা ও চিহ্ন-সংকেত পাওয়া গিয়েছে স্যাফাইটিক ভাষায়। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেছেন যে, এই গ্রাফিত্তির উৎপত্তি হলো স্যাফাইটিক ভাষার থেকে। আধুনিক বিশ্ব এই গ্রাফিত্তিকে বিস্তৃত যেমন করেছে, তেমনই নতুন নতুন আঙ্গিকে আরও উন্নত প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, পরিণত করেছে।

ছয়ের দশকে শুরু হয়েছিল এই শিল্পের কর্মকাণ্ড। যা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাতের দশকে আরও তীক্ষ্ণতা পায়। মনে হয়, সেই সময়ের সারা পৃথিবীজুড়ে শান্তি আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এর প্রসার-প্রচার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আরবান আভাঁ গার্দ স্ট্রিট আর্টের ও গ্রাফিত্তির ক্ষেত্রে ইতালিকে মানা হয় পথিকৃৎ হিসেবে। সাতের দশকের শুরুতে আমেরিকা থেকে প্রথম গ্রাফিত্তি নিয়ে যে বই প্রকাশিত হয়, তা একজন ইতালিয়ানের লেখা। ইতালীয় কিউরেটর ফ্রান্সেসকা এলিনভি প্রথম গ্রাফিত্তির একজিবিশনের আয়োজন করেন ইউরোপে সাতের দশকের শেষ দিকে। কিন্তু এই কাজ করতে এত সময় কেন লাগল? তার কারণ এই শিল্পের কোনও রাষ্ট্রীয় গ্রহণযোগ্যতা ছিল না, আজও নেই। তার কারণ, রাষ্ট্র মনে করেছে এটা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। এই ধরনের কাজ রাষ্ট্রের নির্ধারিত নিয়ম-মোতাবেক বেআইনি। ফলে এই কাজে দুষ্ট ব্যাক্তির জন্য জেলখানার ঠিকানা লেখা আছে। দেশ অনুযায়ী সাজার তারতম্য আছে বটে। তবে জেল খাটতেই হবে। তার কারণ, এই প্রকাশ্য শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে এরা সরকারি কোনও আনুমোদন তো নেয়ই না। এমনকী, যার বাড়ির দেওয়ালে এই ক্রিয়াকর্ম ঘটবে, তারও অনুমতি নেয় না। গোপনে, রাতবিরেতে, গেরিলা কায়দায় এই শিল্পের জন্মকথা শুরু হয়। একটা রাত মানে একটা প্রতিবাদ।

এটা কোনও ন্যাকাভোলা আর্টিস্টদের কর্ম নয়।

নর্মান ছিল এমন এক শিল্পী। যার বাবা স্প্যনিশ আর মা ফরাসি। আমার সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয় এই দেশে। পরবর্তীকালে বিদেশেও দেখা হয়েছে। কিন্তু সেবার অদ্ভুত যোগাযোগ।

বহুদিন পর দেখা হবে বলে ফোন দিয়েছি। ওর বান্ধবী জানাল, নর্মান ব্যস্ত, তাই সে ফোন ধরতে পারছে না। তার সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে বলে। সেদিন আসলে নর্মান তিন বছরের জেল খেটে বাড়ি ফিরেছে, তা আমি জানতাম না। নর্মান এক স্বাধীনচেতা চিত্রকর। ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনজুড়ে সে কাজ করে। একা নয়, দল পাকিয়ে গ্রাফিত্তি ছড়িয়ে দেয় রাজপথে, শহর ও শহরতলির পথেঘাটে।

নর্মানের মতো এইসব গ্রাফিত্তির আর্টিস্টরা মূলত রাতের অন্ধকারে তাদের কাজটি সম্পন্ন করে। এমনভাবে পরিকল্পনা করে, যাতে রাতারাতি কাজ শেষ করে চম্পট দেওয়া যায়। নর্মানরা সেবার সারারাত কাজ করে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে একটি গ্যারেজে ঘুমিয়ে পড়ে। তাতেই পুলিশ। তাতেই বিপত্তি। কিন্তু তাতে তাদের কোনও অনুতাপ নেই। নর্মানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল, সে বোধহয় আবার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করবে। গ্রাফিত্তি আসলে লাগাতার আন্দোলনের ফলশ্রুতি।

শাসককে উত্যক্ত করা, চোরাগোপ্তা নিজেদের কাজটা হাসিল করাই এখানে মূল উপজীব্য।

গেরিলা তৎপরতায় এ যেন নাশকতার লুকোচুরি। ভিন্ন রাস্তার শিল্প। এই গ্রাফিত্তি এখন প্যাশন। ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন। তার মানেই নানা কথা, নানা রং, নানা রেখা। একঘেঁয়ে এক ছাঁচে ঢালা নয়।

সব মেনে নেওয়া নয়।

More Articles