'যন্ত্রের কী দরকার, অন্তরে সব বাজতাসে!' প্রকৃত 'গুরু' ছিলেন সুবল দাস বাউল
তিনি নিজেকে কখনও 'গুরু' বলেননি। তিনি সব সময় বলতেন, "গুরুগিরি আমার কাম নয়। আসল গুরু হলো সময়।"
গত দুই দশক বা তার কিছু আগে থেকেই খেয়াল করেছি যে, শহুরে মানুষের মধ্যে 'গুরু' বা 'জয় গুরু' শব্দ ব্যবহারের একটা প্রচলন শুরু হয়েছে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলতে পারবেন তার নিহিত কারণসমূহ। তবে আমার সাধারণ ভাবনাচিন্তা ও সামান্য পর্যবেক্ষণে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, তা হলো, শহরে বাউল-ফকির গানের জনপ্রিয়তা ও প্রসারতাই হলো এর আপাত কারণ। এর পিছনে কোনও ধর্মীয় প্রবণতা না দেখাই ভালো। সবাই যে জেনেবুঝে বলছে, তা নাও হতে পারে। অনেকটাই লব্জ হয়ে উঠেছে।
মুল বিষয়ে প্রবেশ করার আগে এই নিয়ে খানিকটা লিখে রাখা ভালো। প্রথমে জানাই 'জয় গুরু' শব্দের অর্থ। 'জয়' শব্দটি এসেছে কোরআনে উল্লিখিত 'ফাতাহ' শব্দ থেকে। যার সরাসরি অর্থ, জয়। আর গুরু শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, 'গু' অর্থে অন্ধকার আর 'রু' অর্থে আলো। অর্থাৎ মোদ্দা কথা হলো, যিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন, তিনিই গুরু। ফলে এই শব্দের মধ্যে যেমন কোনও ধর্মীয় আধার নেই, তেমনই কোনও উচ্চকিত ভাবধারাও নেই।
তথাপি, ইদানীং স্বঘোষিত গুরু থেকে দু'দিনের যোগীও গুরুকল্পে নিজেদের অধিষ্টিত করছে এবং তারা গুরুকে অধ্যাত্মের গল্পে মুড়ে দিচ্ছে। এখন তো বাউলের সঙ্গে ধর্মও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে! সে আর কী করা যাবে। কিন্তু আমরা যখন প্রথম প্রথম বাউল পর্যবেক্ষণে নানা দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন এই গুরুবাজি,গুরুগিরিকে আমরা সন্দেহের চোখেই দেখেছি। শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে যে পরিসর বাউলরা তৈরি করে, তার জটিল পন্থা ও আনুষ্ঠানিক দিকটি সেসময় বোঝা খুবই দুরূহ ঠেকেছিল, সন্দেহ নেই। এখনও যে সবটা বুঝে ওঠা গেছে, তা নয়। এক-একজন বাউল সব সময়ই তাদের নিজেদের সাধনা অনুযায়ী তা ব্যাখ্যা করেছে। তাতে এর ব্যাপ্তি টের পাওয়া গেছে, এইমাত্রই। আসলে যেহেতু বাউলের যাপনচিত্রর অনেকটাই জুড়ে আছে তাদের সাধনা, তাই এর মধ্যে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই সেভাবে কোনও বাধ্যবাধকতাও।
আরও পড়ুন: মঞ্চ নয়, রাস্তা দখল করে নাচ-গান-নাটক চলে ইউরোপের এই উৎসবে
সেদিক থেকে বাউলরা অনেকানেক স্বাধীন।
আসলে এরকম একটা গৌরচন্দ্রিকা হয়তো না করলেও চলত। সরাসরি ঢুকে পড়া যেত বিষয়ে। কিন্তু এখানে যেহেতু এক দিকপাল বাউল গুরুকে নিয়ে লিখব, তাই এই ভূমিকার অবতারণা। তাতে যদি বুঝতে সুবিধে হয়।
তো সেই বাউল গুরু হলেন সুবল দাস বাউল।
যিনি নিজেকে কখনও 'গুরু' বলেননি। তিনি সব সময় বলতেন, "গুরুগিরি আমার কাম নয়। আসল গুরু হলো সময়। বর্তমানের মধ্যে থাকো তবেই পাবে আলোর সন্ধান। সেই আলো খুঁজে নিতে হবে। অর্জন করতে হবে।" এমন গভীর দার্শনিক কথা আমি বাউল সমাজে খুব কম লোককেই বলতে শুনেছি। আটের দশকের শুরুতে যখন এই বাউলের সাক্ষাৎ পাই, তখন তার চারপাশের তথাকথিত কোট আন কোট সমস্ত 'স্টার বাউল'-রাই তার অনুগামী। প্রত্যেকেই তার আশ্রমে দিনের পর দিন থেকে গান শিখেছে। সেই নামের লিস্টে কে নেই? গৌর ক্ষ্যাপা থেকে গোষ্ঠগোপাল, পবন দাস থেকে নিমাইচাঁদ, তিনকড়ি থেকে নিত্যানন্দ, তারক থেকে কার্তিক, উমা থেকে সাবিত্রী, কালীপদ অধিকারী থেকে অশোককৃষ্ণ, নিমাই দাস, নীলকমল- আরও কত নাম। তখন এই সমস্ত বাউল শিল্পীই দেশে-বিদেশে মঞ্চসফল। এরা প্রত্যেকেই সুবল দাসকে গুরু মানে বা মানত। তাহলে কি দাঁড়াল? সুবল গোঁসাই গুরু ছিলেন না কি শিক্ষক? সে যাই হোন। তিনি যে দশকের পর দশক এইসব বিশিষ্ট গায়কদের দীক্ষা না দিয়েও দীক্ষিত করেছিলেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
সুবল গোঁসাইয়ের ওপর একটা ছবি করেছিলাম। উনি বেশি সময় দেননি। ছবির কাজ চলার মাঝপথে সুবল দেহ রাখেন। তার সঙ্গে ছিল আমার চার দশকের একান্ত নিবিড় এক যোগাযোগ। স্বল্পভাষী গোঁসাইয়ের কাছে শুনেছি যে, অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায় তার জন্ম। মাত্র বারো বছর বয়সে উনি বাড়ি ছাড়েন গানের টানে। প্রায় পুরো বাংলাদেশ ঘুরে অত্যন্ত কম বয়সে এপারে চলে আসেন। এখানে জেলা থেকে জেলা ঘুরে উনি পৌঁছে যান ভবাপাগলার আশ্রমে। সেখানে ভবা-র সান্নিধ্যে বেশ কিছু দিন কাটানোর পর নবাসনের হরিপদ গোস্বামী আশ্রমে আশ্রয় নেন। এরপর কিছু দিন বাঁকুড়ার সনাতন দাস বাউলের আশ্রমেও সংগীতচর্চায় থাকেন। অবশেষে নদিয়ার আড়ংঘাটায় আশ্রম তৈরি করেন।
লিখতে-পড়তে জানতেন না। কিন্তু বহু গান তিনি রচনা করেছেন। নিজে যেমন অসাধারণ গাইতেন, তেমনই নানা সুরের কারবারি গোঁসাই অনন্য এক প্রেমের ভাবে থাকতেন। কম বয়সের শিল্পীদের বলতেন, "সুরটারে খামচাইয়া ধরতে হইব। যাতে পলাইয়া না যায়।" উনি মনে করতেন, গান শেখার বা শোনার কোনও সময় হয় না। যখন মনে হবে, তখনই গানের সুরতালে ঢুকে যেতে হবে। শোনানো অনেক পরের বিষয়।
আগে নিজেকে তৈরি করতে হবে। তিনি ছিলেন সুর ও তাদের ক্ষেত্রে অসম্ভব আগ্রাসী ও বেপরোয়া। অথচ কোনও দিন শুনিনি, সামান্য বেসুরে বাজছে তার কণ্ঠস্বর। একবার একজন বিদেশি শ্রোতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, "আপনি কি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সাধারণত গান করেন?" তাতে সুবল গোঁসাই উত্তর দিয়েছিলেন, "যন্ত্রের কী দরকার? অন্তরে সব বাজতাসে।" এমন সরল কথার ইংরেজি ভাবানুবাদ করতে গিয়ে আমি হিমশিম খেয়ে যাই। প্রায় পঞ্চাশের ওপর নানা দেশে গান শোনাতে গেছেন। তার বাড়িতে হাজির হয়েছেন জের্সি গ্রোটস্কি, পিটার ব্রুক, অ্যালান গিনসবার্গ, দীপক মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মীরা মুখোপাধ্যায় থেকে পূর্ণদাস বাউল, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতো আরও অনেক প্রোথিতযশা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু স্বভাবসরল গোঁসাইকে কখনও রাগতে দেখিনি।
শুনেছি, প্রথমবার যখন বিদেশ যান, তখন ঠান্ডায় মোজা-জুতো পড়তে চাননি। বলেছিলেন, "মাটির সঙ্গে যোগ না থাকলে গান কিভাবে হবে?" সেবার উদ্যোক্তাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এও এক স্বভাবসুন্দর কথা।
আজ কি আর মাটির যোগের কথা কেউ ভাবে?
কী জানি...